দুর্ঘটনা-পর: গাড়ির অবস্থা। ইনসেটে গোবিন্দ ও রিম্পা। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক
প্রেমিকাকে পাশে বসিয়ে মদ্যপ অবস্থায় বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালাচ্ছিল এক যুবক। প্রায় ৮ কিলোমিটার রাস্তায় একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটাতে ঘটাতে এগোয় গাড়ি। ধাক্কা মারে ভ্যান, পুলিশের গাড়ি, টোটো, বাইক এবং পথচারীকে। গাড়ির ধাক্কায় মৃত্যু হয়েছে ২ জনের। জখম হয়েছেন এক মহিলা-সহ তিনজন। তাঁদের মধ্যে দু’জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
শুক্রবার সন্ধ্যায় ঘটনাটি ঘটেছে গোপালনগর এবং বনগাঁ থানা এলাকায়। ভর সন্ধ্যায় চোখের সামনে এমন ঘটনা দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন পথচারীরা। পুলিশ পড়ে গ্রেফতার করে বছর চব্বিশের এক যুবক তার বান্ধবীকে। আটক করা হয়েছে গাড়ি। সেখান থেকে মদের বোতল পেয়েছে পুলিশ।
পুলিশ জানিয়েছে, মৃতদের নাম মধুসূদন পাল (৫১) এবং হাফিজুর রহমান মণ্ডল (৪৮)। তাঁদের বাড়ি বনগাঁর পাইকপাড়া ও জয়পুর এলাকায়। জখমদের নাম, শিবাজী সিকদার, ঝন্টু রায় ও শেফালি দলপতি। তাঁদের বাড়ি গোপালনগর ও বনগাঁ থানা এলাকায়।
গাড়ির তাণ্ডব
• গোপালনগরের দাড়িঘাটা সেতুর কাছে গাড়িটি প্রথমে ধাক্কা মারে ভ্যানে। দু’জন জখম হন।
• বনগাঁ-চাকদা সড়ক ধরে বনগাঁ শহরের দিকে পালায় গাড়ি। লোকজন বাইক নিয়ে পিছু ধাওয়া করেন।
• গোপালনগর থানা থেকে বনগাঁ থানায় ঘটনার কথা জানানো হয়।
• বনগাঁ শহরের ত্রিকোণ পার্ক এলাকায় গাড়িটি থামানোর চেষ্টা করে পুলিশ। পুলিশের গাড়িতে ধাক্কা মেরে গাড়ি এগিয়ে যায়।
• বনগাঁ থানার সামনে গাড়ি আটকানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ পুলিশ।
• ৬টা নাগাদ মতিগঞ্জ এলাকায় গাড়িটি ধাক্কা মারে টোটোতে। চালক এবং এক মহিলা যাত্রী জখম হন।
• একই সময়ে এক পথচারী এবং বাইকে ধাক্কা মারে গাড়ি।
• বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন এক ব্যক্তি। তাঁকে ধাক্কা মারে গাড়ি। তিনিও জখম হন।
• লোকজন গাড়িটি আটকে দেন। চালক পালানোর চেষ্টা করলে জনতা ধরে ফেলে।
(শুক্রবার সন্ধে পৌনে ৬টা থেকে মিনিট পনেরো-কুড়ির মধ্যে ঘটেছে গোটা ঘটনা)
পুলিশ জানিয়েছে, গোবিন্দ বিশ্বাস ও রিম্পা ঘোষ নামে দুই যুবক-যুবতীর বাড়ি নদিয়ার রানাঘাটে। বনগাঁ থানার আইসি মানস চৌধুরী বলেন, ‘‘ধৃতদের বিরুদ্ধে ৩০৪ ধারায় অনিচ্ছাকৃত খুনের মামলা রুজু করে তদন্ত শুরু হয়েছে।’’ শনিবার ধৃতদের বনগাঁ মহকুমা আদালতে হাজির করানো হলে বিচারক জেল হেফাজতে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন।
পুলিশ জানিয়েছে, গোবিন্দ পেশায় গাড়ি চালক। যে গাড়িটি নিয়ে এ দিন বান্ধবীকে নিয়ে বেরিয়েছিল সে, সেটি অন্য একজনের।
পুলিশ জানতে পেরেছে, রিম্পার শ্বশুরবাড়ি বর্ধমানে। তবে অনেক দিন হল স্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক নেই। পুলিশকে গোবিন্দ জানিয়েছে, ফেসবুকের মাধ্যমে তার সঙ্গে রিম্পার পরিচয় হয়েছিল। পরে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, শুক্রবার বিকেলে প্রেমিকাকে সঙ্গে নিয়ে রানাঘাট থেকে গোপালনগরের দিকের রাস্তা ধরে ঘুরতে বেরিয়েছিল। মদ্যপান করছিল।
বাসিন্দারা জানিয়েছেন, বনগাঁ-চাকদা সড়ক ধরে সে গোপালনগরের দিকে আসার পথে গাড়ির মধ্যে প্রেমিকার সঙ্গে গোবিন্দকে অসংলগ্ন অবস্থায় দেখা যায়। লোকজন তাদের সেখান থেকে চলে যেতে বলেন। মদের নেশা তখন চড়ে গিয়েছে। তীব্র গতিতে গাড়ি চালাতে থাকে গোবিন্দ।
গোপালনগর থানার দাড়িঘাটা সেতুর কাছে নিজের ভ্যান নিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, শিবাজী। ভ্যানে ছিলেন ঝন্টু। গোবিন্দ গাড়ি নিয়ে এসে ভ্যানে ধাক্কা মেরে বেরিয়ে যায়। শিবাজী, ঝন্টু দু’জনেই ছিটকে পড়েন। পুলিশ আসে। উত্তেজিত জনতা পুলিশের কাছে ক্ষোভে ফেটে পড়েন। সড়ক অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। জখমদের বনগাঁ মহকুমা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আশঙ্কাজনক থাকায় ঝন্টুকে কলকাতার হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়।
ভ্যানে ধাক্কা মেরে গোবিন্দ গাড়ির গতি বাড়িয়ে বনগাঁ শহরের দিকে আসতে থাকে। পিছনে বাইক নিয়ে লোকজন ধাওয়া করায় গতি আরও বাড়িয়ে দেয়।
গোপালনগর থানার পুলিশ বনগাঁ থানার পুলিশকে ফোনে খবর দিয়ে গাড়িটি আটকাতে বলে। বনগাঁ থানার এসআই স্বরূপ পাল শহরের ত্রিকোণ পার্ক এলাকায় গাড়িটি আটকানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। উল্টে পুলিশের গাড়িতে ধাক্কা মেরে গোবিন্দ এগিয়ে যায়। বনগাঁ থানার সামনে পুলিশ গাড়িটি আটকানোর চেষ্টা করেও পারেনি।
রায়ব্রিজ পেরিয়ে গোবিন্দ গাড়ি নিয়ে বনগাঁ-বাগদা সড়ক ধরে এগোতে থাকে। শনিবার লকডাউন থাকায় শুক্রবার সন্ধ্যায় বাজারে ভিড় ছিল। গাড়ির গতি দেখে অনেকে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। চিৎকার করে সড়ক থেকে পাশে তাঁরা সরে যেতে থাকেন। মতিগঞ্জ এলাকায় নিজের টোটো নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন মধুসূদন। টোটোতে ছিলেন শেফালি। গোবিন্দ গাড়ি নিয়ে টোটোয় ধাক্কা মারে। দু’জনে ছিটকে পড়েন। অভিযোগ, মধুসূদনের শরীর উপর দিয়ে গাড়ির চাকা চলে যায়।
একটু এগিয়ে বাইকে ধাক্কা মারে গাড়ি। বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন হাফিজুর। তাঁকেও গোবিন্দ গাড়ি নিয়ে ধাক্কা মারে। চাপা পড়েন হাফিজুর।
লোকজন সেখানে গাড়িটি আটকে দেয়। গোবিন্দ পালানোর চেষ্টা করলে তাকে ধরে ফেলে জনতা। পুলিশ গিয়ে জখম মধুসূদন, হাফিজুর এবং শেফালিকে বনগাঁ মহকুমা হাসপাতালে আনার ব্যবস্থা করে। হাফিজুর ও মধুসূদনকে কলকাতায় স্থানান্তরিত করা হয়। পথেই তাঁরা মারা যান। কয়েকমাস আগে বনগাঁ শহরে একটি ট্রাক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে একই ভাবে পর পর সাইকেল, টোটো, আবক্ষ মূর্তি, তোরণে ধাক্কা মেরেছিল। একজনের মৃত্যু হয়েছিল।