লড়াকু: টিফিনের অবসরে দোকান খুলে বসেছে মহিম। নিজস্ব চিত্র।
টিফিনের ঘণ্টা পড়লেই হই হই করে ক্লাসঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে ছেলের দল। তাদের টপকে পাঁই পাঁই করে দৌড় দেয় মহিম।
স্কুলগেটের বাইরেই তার দোকান। সহপাঠীরা সেখানে পৌঁছনোর আগেই ঝাঁপ খুলে সাজিয়ে বসে মহিম। কয়েক মিনিটের মধ্যেই আচার, বিস্কুট, লজেন্স কিনতে তার দোকানে হামলে পড়ে স্কুলের বাকি পড়ুয়ারা।
লকডাউনে যখন বহু ছেলেমেয়ে রোজগারের আশায় পড়া ছেড়েছিল, তাদের থেকে লড়াইয়ে একটু ভিন্ন পথ বেছে নেয় অষ্টম শ্রেণির মহিম গাজি। বাবার আলু-পেঁয়াজের খুচরো কারবারে সংসার তখন আর চলেও চলে না। বাড়ির সকলে মিলে ঠিক করে, সামান্য পুঁজি দিয়ে মহিম তা হলে একটা দোকান দিক। অরাজি ছিল না, সে সময়ে ষষ্ঠ শ্রেণির পড়ুয়া মহিম। তবে জানিযে দেয়, পড়াশোনা ছাড়বে না। অনেক আলাপ-আলোচনা করে ঠিক হয়, হাসনাবাদের মহিষপুকুর হাইস্কুলের মূল ফটকের সামনে পাঁচিল ঘেঁষে দোকান দেওয়া হবে। সেই দোকান চালাবে মহিম। স্কুলের সামনে দোকান হওয়ায় স্কুল করতে করতেই এসে দোকান খুলতে পারবে সে। তবে ২০২০ সালে যে সময়ে মহিমের ব্যবসা শুরু হয়েছিল, তখনও স্কুলের দরজা খোলেনি। তবে কোনও না কোনও দিন তো খুলবে, আশায় ছিলেন মহিমের পরিবার। হয়েছেও তাই।
স্কুলের কাছে বেনা গ্রামে মা-বাবা, দাদা-বৌদি ও বোনের সঙ্গে থাকে মহিম। তার বাবা আমিন গাজি ৫০০০ টাকা খরচ করে ছেলেকে কাঠের ছোট্ট দোকানটি বানিয়ে দেন। মহিমের কথায়, ‘‘লকডাউনের সময়ে দোকান খোলা হলেও তেমন ব্যবসা হয়নি। স্কুল খোলার অপেক্ষায় ছিলাম। চলতি বছরে পুরোদমে স্কুল খোলার পর থেকে বিক্রি বেড়েছে।’’ মহিম বলে, “সকালে পড়াশোনা সেরে ৮টা নাগাদ বই নিয়েই দোকানে এসে বসি। স্কুল খোলার আগে পর্যন্ত প্রায় ৩০০-৩৫০ টাকার মতো কেনাবেচা হয়ে যায়। টিফিনের সময়ে দোকান খুললে আরও আড়াইশো টাকার মতো বিক্রি হয়।”
নিজের বন্ধুদের কাছে কেনাবেচা করতে সমস্যা হয় না? কোনও সংকোচ নেই এ কাজে?
একগাল হেসে ছিপছিপে ছোট্টখাট্ট চেহারার ছেলেটি বলে, ‘‘সংকোচের কীসের! তবে ক্লাসের বন্ধুরা নানা রকম জিনিস ফ্রিতে চায়। কেউ বলে, দু’টো বিস্কুট দে, কেউ একটা লজেন্স চায়। সকলের সঙ্গেই ভাল সম্পর্ক। সব সময়ে না-ও করতে পারি না।’’
দু’জন গৃহশিক্ষকের কাছেও পড়ে মহিম। মা শাহানারা বলেন, “স্বামীর উপার্জন সংসারের পক্ষে যথেষ্ট ছিল না। তাই এই দোকান খুলেছে ছোট ছেলে। দোকানের আয়ে ওর পড়াশোনার খরচ চলে। এ ছাড়া সংসার চালাতেও কিছুটা সুরাহা হয়েছে।”
স্কুলের প্রধান শিক্ষক বৈদ্যনাথ দাস বলেন, “যে ভাবে পড়াশোনার পাশাপাশি উপার্জনের কৌশল বের করেছে ছেলেটি, তা খুবই প্রশংসনীয়। ও লেখাপড়ায় বেশ মনোযোগী। ওর দোকান থেকে আমরাও মাঝে মধ্যে খাবার কিনি। মহিমের দাদা স্কুলছুট হয়ে রাজমিস্ত্রির কাজে যুক্ত হয়েছিল। কিন্তু মহিম সে পথে হাঁটেনি।”
মহিমের এখন একটাই চিন্তা ঘোরে মাথায়। মাধ্যমিকের পরে অন্য স্কুলে যেতে হবে। সে স্কুল যদি দূরে কোথাও হয়, তা হলে ব্যবসাটা ধরে রাখবে কী করে! ছেলেটির কথায়, “পড়াশোনাটা কোনও ভাবেই ছাড়া যাবে না।’’