কেরলে দিনমজুরি করছেন মাছ চাষি অমল। প্রতীকী ছবি।
বছর তিনেক আগে নিজের পাঁচ বিঘা পুকুরে বাগদা চিংড়ি চাষের জন্য স্থানীয় এক মহাজনের কাছ থেকে ২ লক্ষ টাকা সুদে ধার নিয়েছিলেন বাসন্তীর কুলতলি গ্রামের বাসিন্দা অমল সর্দার। কথা ছিল, এক বছরের মধ্যে সুদে-আসলে আড়াই লক্ষ টাকা ফেরত দেবেন। চাষ ভাল না হওয়ায় খরচের টাকাই তুলতে পারেননি অমল। কোনও মতে মহাজনের ১ লক্ষ টাকা শোধ করেন। বাকি দেড় লক্ষ টাকা দিতে পারেননি। এই অবস্থায় পরের বছর ফের সুদের বিনিময়ে টাকা চাইতে গেলে প্রথমে বেঁকে বসেন মহাজন। পরে এক লক্ষ টাকা দিলেও পরিবর্তে এক বছরের মধ্যে ৩ লক্ষ টাকা ফেরত দিতে হবে বলে শর্ত দেন।
করোনা সংক্রমণের জেরে লাগাতার লকডাউন ও বিদেশে চিংড়ির রফতানি অনেকদিন কার্যত বন্ধ থাকায় সে বছরও মাছ চাষ থেকে তেমন টাকা লাভ হয়নি অমলের। এ দিকে, সময় অতিক্রান্ত হতেই ক্রমাগত মহাজনের তাগাদা শুরু হয়।
বাধ্য হয়ে বাড়ি ছেড়ে ভিন্ রাজ্যে চলে গিয়েছেন অমল। কেরলে দিনমজুরি করছেন মাছ চাষি অমল। সেখান থেকেই প্রতিমাসে কিছু কিছু করে বকেয়া টাকা শোধ করছেন। ফোনে বললেন, ‘‘গ্রাম ছেড়ে চলে না এলে দেনার দায়ে আত্মহত্যা করতে হত। প্রতিদিন মহাজনের তাগাদা সহ্য করতে পারছিলাম না।’’
ক্যানিংয়ের নিকারিঘাটা পঞ্চায়েতের চাষি সতীশ মণ্ডলের আট বিঘা জমি আছে। প্রতি বছর মরশুমি আনাজের চাষ করেন। কিন্তু প্রতি বছরই চাষের সময়ে স্থানীয় কিছু বড় ব্যবসায়ীর কাছ থেকে টাকা ধার নিতে হয় তাঁকে। আর এই ধার নিয়ে চাষ করে কার্যত যা লাভ হয়, তা সুদের টাকা গুনতেই বেরিয়ে যায় বলে জানালেন। বছরের পর বছর চাষ করেও কার্যত আর্থিক ভাবে স্বচ্ছল হতে পারছেন না সতীশ। তাঁর কথায়, ‘‘আসলে মহাজনের থেকে টাকা নিয়ে চাষ করতে একটু দেরি হয়ে যায় প্রতি বছর। ফলে ফসল যখন ওঠে, তখন বাজারে দামও কিছুটা কমে যায়। ফসল বিক্রি করে সুদ-সহ মহাজনের টাকা দিতে গিয়ে হাতে আর কিছুই পুঁজি থাকে না।’’
ঋণ-চক্রে জড়িয়ে পড়েছে সতীশের পারিবারিক অর্থনীতি।
ক্যানিংয়ের দিঘিরপাড় পঞ্চায়েতের বাসিন্দা সুমঙ্গলা দাসের স্বামী বছর চারেক আগে মারা গিয়েছেন। দুই সন্তানকে নিয়ে বিপাকে পড়েন মহিলা। সংসার চালাতে ক্যানিং মাছের আড়ত থেকে মাছ কিনে গ্রামে ঘুরে বিক্রি শুরু করেন।
কিন্তু নিজস্ব পুঁজি না থাকায় প্রতিদিনই স্থানীয় এক সুদের কারবারির কাছ থেকে দু’হাজার টাকা ধার করে মাছ কিনতে হয় তাঁকে। মাছ বিক্রির পরে প্রতিদিন একশো টাকা করে অতিরিক্ত ফেরত দেন। কোনওদিন ক্ষতি হলে ওই টাকা শোধ দিতে মুশকিলে পড়তে হয়।
এ ভাবেই বছরের পর বছর ধরে চলছে বলে জানালেন সুমঙ্গলা। তাঁর কথায়, ‘‘আমার নিজের পুঁজি নেই। যা রোজগার করি, প্রতিদিনই খরচ হয়ে যায়। বাধ্য হয়েই দৈনিক সুদে টাকা ধার নিয়ে ব্যবসা করি।’’
এ ভাবেই নানা ধরনের মহাজনী প্রথা বা স্থানীয় সুদের কারবারিদের হাতে কার্যত সমান্তরাল অর্থনীতি চলছে গ্রামবাংলায়। মূলত গ্রাম বা শহরতলির প্রান্তিক মানুষজনই ঋণগ্রহীতা। এঁরা ব্যাঙ্কে যেতে ভয় পান বা নিয়ম-কানুনের সঙ্গে সড়গড় নন। ব্যাঙ্কঋণ নিতে গেলে যে সমস্ত তথ্য প্রয়োজন, তা দিতে চান না অনেকে বা অনেকের কাছে সে তথ্য থাকেও না।
অন্য দিকে, অত্যন্ত সহজে, কার্যত মুখের কথায় মহাজনদের কাছ থেকে টাকা ধার মেলে। বাড়তি সুদ গেলেও জটিলতা এড়াতে মহাজনেরাই ভরসা এই সব প্রান্তিক মানুষজনের।
তবে অনেক ক্ষেত্রে টাকা শোধ না করতে পারলে সুদের বোঝা বাড়তে থাকে। কেউ কেউ এলাকা ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হন। কেউ আত্মহত্যার পথ বেছে নেন বলেও শোনা গেল গ্রামের মানুষের কাছে।
প্রশাসনের দাবি, এই ধরনের সুদের কারবার বেআইনি। কিন্তু এ সম্পর্কে কেউ সে ভাবে কোনও অভিযোগ করে না। ফলে ব্যবস্থা নেওয়া যায় না।
ব্যাঙ্কেরও দাবি, মহাজনী প্রথা বেআইনি। তবে সঠিক তথ্য জমা দিতে না পারলে ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ দেওয়াও সম্ভব নয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের ক্যানিং শাখার ম্যানেজার বলেন, ‘‘বহু মানুষ আমাদের কাছে আসতে ভয় পান। আমরা গ্রামে গিয়ে অনেক সময়ে ক্যাম্প করে ঋণ দিয়ে থাকি। কিন্তু সঠিক তথ্য ছাড়া টাকা দেওয়ার এক্তিয়ার আমাদের নেই। ব্যাঙ্কে এই সমস্ত জটিলতা থাকে বলেই মানুষ বাধ্য হয়ে মহাজনদের কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা ধার নেন।’’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশ কর্তা বলেন, ‘‘কেউ এ সব ক্ষেত্রে কোনও অভিযোগ করেন না। অভিযোগ হলে ব্যবস্থা অবশ্যই নেওয়া হয়। তবে অনেক সময়ে কেউ দেনার দায়ে আত্মঘাতী হলে পুলিশ সুয়ো মোটো অভিযোগ দায়ের করে।’’