Inspirational Story

পুরুষের একচেটিয়া ব্যবসায় চার বাঙালিনীর সফল ঘোরাঘুরি

‘ট্যুর অপারেটর’ বলতেই মানুষ বোঝেন পুরুষ। কিন্তু মহিলারাও যে এই পেশায় সফল হতে পারেন, তার গল্প শুনুন তাঁদের মুখ থেকেই।

Advertisement

অমৃতা মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৩ মে ২০২৪ ২০:০১
Share:

বেড়ানো যখন নেশা এবং পেশা। ছবি: সংগৃহীত।

মহিলারা আজকাল অনেক কিছুই পেশা হিসেবে গ্রহণ করছেন। ধীরে ধীরে যেমন তাঁরা একের পর এক পুরুষতান্ত্রিক সমাজের গড়া ‘গ্লাস ওয়াল’ ভাঙছেন, তেমনই তাঁরা এমন-এমন পেশায় শামিল হচ্ছেন, যা মূলত এত দিন পুরুষের সম্পূর্ণ আয়ত্তে ছিল। যেমন ‘ট্যুর অপারেশন’-এর ব্যবসা। তাঁরা সকলেই বাঙালি নারী। তাঁরা কেবল ঘর বা সংসারের চার দেওয়ালের মধ্যেই আর নিজেদের আটকে রাখতে রাজি নন। তাঁরা নিজস্ব ‘সফর ব্যবসা’ চালাচ্ছেন, এবং কাঁধে পুরো দায়িত্ব নিয়ে কেদারনাথ থেকে কাশ্মীর বা তাইল্যান্ড থেকে মিশরের মতো জায়গায় ঘুরিয়ে আনছেন তাঁদের ‘ক্লায়েন্ট’দের। দিনের পর দিন হাসিমুখেই এই হ্যাপা সামলাচ্ছেন আর দাবি করছেন, যত অভিজ্ঞতা বাড়ছে, ততই হ্যাপা সামলানোর ক্ষমতাও বাড়ছে। স্বাগতা মুখোপাধ্যায়, মহুয়া মুখোপাধ্যায়, পার্বতী ভট্টাচার্য এবং ইন্দিরা সেন এমনই চার জন মহিলা, যাঁরা গভীর আবেগের সঙ্গে এই কঠিন কাজটি সামলাচ্ছেন।

Advertisement

শুরু

স্বাগতা মুখোপাধ্যায়, এই কাজ শুরু করেন ২০১৫ সালে। ২০১৩ সালে স্বাগতা দীর্ঘ দিন স্বামী-সন্তানের সঙ্গে জার্মানিতে থাকার পর কলকাতায় ফেরেন। ভীষণ বেড়াতে ভালবাসেন বলেই ইউরোপে নিজেরাই অনেক ঘুরেছেন। কিন্তু যখন রাজস্থান ঘুরতে যাবেন ঠিক করলেন, তখন এক ‘ট্যুর অপারেটর’-এর মাধ্যমেই গেলেন। ‘‘অনেক সুবিধা হল তাতে। আমরা টাকা দিয়ে দিলাম, ওঁরাই সব বুকিং, বেড়ানোর ব্যবস্থা করে দিলেন। তখনই আমি, ওঁরা কী ভাবে ব্যবস্থা করছেন, কী খামতি থাকছে, সেই সবগুলো দিক ভাল ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছিলাম। ফিরেই ঠিক করি আমার নিজের ব্যবসা শুরু করব,’’ জানালেন স্বাগতা।

Advertisement

মহুয়া মুখোপাধ্যায় ২০০৯ সালে, ‘স্বল্প খরচে বাঙালির বিদেশ ভ্রমণের স্বপ্নপূরণ’ স্লোগান দিয়ে তাঁর সংস্থা শুরু করেছিলেন। তিনি বলেন, ‘‘একজন সফল নারী উদ্যোক্তা হওয়া সত্ত্বেও মাঝেমাঝে এমন হয় যে, কিছু মানুষ এসে আমার ক্ষমতা বা জ্ঞান সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেন। আমরা এখনও একটি পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বাস করি। এই মনোভাব উপেক্ষা করেই আমাদের কাজে এগিয়ে যেতে হবে।”

স্বাগতার মতে সবচেয়ে কঠিন ‘ট্যুর’ ছিল কেদারনাথ যাত্রা। ‘‘কোভিডের পর ২০২২ সালে প্রথম মন্দির খোলা হল। অসম্ভব ভিড়, তার মধ্যে সবার মনের মতো থাকার জায়গা পাওয়া ভীষণ মুশকিল। তাও ব্যবস্থা করলাম। অনেক বয়স্ক মানুষ হেলিকপ্টার চড়ে উপরে উঠবেন, তার অগ্রিম বুকিং করা এবং সারা ক্ষণ খেয়াল রাখা এই দুর্গম পথে সবাই যেন শারীরিক ভাবে সুস্থ থাকেন। সব একসঙ্গে সামলানো সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল।’’

মহিলা ‘ট্যুর অপারেটর’ হওয়ার যেমন সুবিধে আছে, তেমনই আছে সমস্যা। ‘‘মহিলা হিসাবে আমার অনন্য দৃষ্টিকোণ আছে, আর আছে সহিষ্ণুতা। মানুষের অসুবিধাগুলি আমি ভাল বুঝতে পারি। যাঁরা আমার সঙ্গে যাচ্ছেন, তাঁরাও তাঁদের সমস্যা অতি সহজে আমায় বলতে পারেন। তবে মেয়েরা দৃঢ় প্রত্যয়ী হলে আমাদের সমাজে খুব মুশকিল। অথচ এই দৃঢ়তা না থাকলেও এ কাজ করা অসম্ভব,” স্বাগতার মত।

(বাঁ দিকে ) ইন্দিরা সেন এবং স্বাগতা মুখোপাধ্যায় (ডান দিকে)।। নিজস্ব চিত্র।

ইন্দিরা সেন তাঁর বেড়ানোর সংস্থা শুরু করেছিলেন ২০১৫ সালে, যখন তিনি নিজের ভ্রমণ সাংগঠনিক দক্ষতার প্রতি আত্মবিশ্বাসী হয়েছিলেন । ‘‘২০০৯ সাল থেকে আমি ইন্ডিয়ান লাইফ সেভিং সোসাইটির (অ্যান্ডারসন ক্লাব) কেন্দ্রীয় কমিটির মহিলা প্রতিনিধি পদে অধিষ্ঠিত এবং আমি ক্লাব থেকে ভ্রমণের আয়োজন করেছি বহু বার। ২০১৫ সালে আমি আমার নিজের সংস্থা শুরু করি এবং ৩২ জনের একটি দল নিয়ে যাই শ্রীলঙ্কায়।”

এ দিকে পার্বতী ভট্টাচার্য বেঙ্গালুরুতে একটি স্কুলের অধ্যক্ষা ছিলেন। তিনি চাকরি ছেড়ে দেন এবং ২০১৫ সালে নিজের সংস্থা শুরু করেন।

‘‘তিন বছর বয়স থেকে আমি, আমার মা এবং তাঁর সহকর্মীর সঙ্গে সারা ভারত ভ্রমণ করেছি ৷ আজকাল মহিলাদের গ্রুপ এবং একা ভ্রমণ আদর্শ হয়ে উঠেছে, কিন্তু সেই সময়ে ট্রেনে করে, রাতের বাস ধরে, এবং প্রত্যন্ত এলাকায় একটি শিশুর সঙ্গে দুই মহিলার ভ্রমণ বরং দুঃসাহসিক ছিল। তাই খুব অল্প বয়সে আমার মধ্যে ভ্রমণ আকাঙ্ক্ষার বীজ গেঁথেই যায়।”

পার্বতী যখন দিল্লিতে স্থানান্তরিত হন, তখন তিনি কুমায়ুনে একটি পারিবারিক ভ্রমণের আয়োজন করেন। তিনিই সমস্ত ব্যবস্থা করেছিলেন এবং সব কিছু নিখুঁত ভাবে হয়। ‘‘সেই সময় আমি ভেবেছিলাম আমার নিজের সংস্থা শুরু করা উচিত। আমার প্রথম ‘ট্রিপ’ বয়স্কদের একটি দলের সঙ্গে মধ্যপ্রদেশের পেঞ্চ জাতীয় উদ্যানে ছিল।”

অভিজ্ঞতা

মহুয়ার সংস্থা আয়োজিত কেনিয়া-তানজানিয়া সফরে একজন বয়স্ক ভদ্রলোক অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। মহুয়ার মতে, সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতির মুখোমুখি হন তখনই। ‘‘আমরা প্রাথমিক ভাবে তাঁকে ফেরত পাঠানোর কথা ভাবছিলাম, কারণ তিনি মদ্যপান করে, মাতাল অবস্থায় গভীর রাতে একটি সিংহের সন্ধানে জঙ্গলে দৌড়চ্ছিলেন। মাসাইরা তাঁকে ফিরিয়ে আনেন। পরে তাঁর বন্ধুরা বলেন যে তাঁরা নিশ্চিত করবেন, তিনি পান করবেন না এবং সফর চালিয়ে যাবেন, যে হেতু ইতিমধ্যেই তিনি ট্যুরের খরচ দিয়ে দিয়েছেন। তবুও তিনি মদ্যপান করে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং তাঁকে একটিহাসপাতালে ‘এয়ারলিফ্‌ট’ করে নিয়ে যেতে হয়েছিল। অবিলম্বে কেনিয়ায় তাঁর ছেলে যেন পৌঁছতে পারেন, আমরা তার ব্যবস্থা করেছিলাম। আফ্রিকায় প্রবেশের আগে হলুদ জ্বরের টিকা নেওয়া বাধ্যতামূলক, তাই ছেলের জন্য জরুরি অনুমতির ব্যবস্থা করতে আমাকে সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয়েছিল। পুরো খরচ আমার সংস্থা বহন করেছিল, কিন্তু ভদ্রলোক বিমার টাকা পেয়েছিলেন। পরে তিনি সেই টাকা আমাকে ফেরত দেন। এই কঠিন পরিস্থিতি আমাদের সামলাতে হয়েছিল, তবে তিনি যে সুস্থ হয়ে ফেরেন এটাই শান্তি।”

এই সমস্ত জটিলতা সত্ত্বেও যখন কেউ ভাল ‘রিভিউ’ দেন সফরের, মহুয়া মনে করেন যে, সেটিই সবচেয়ে মূল্যবান। পার্বতী ভট্টাচার্য তাঁর সঙ্গে একমত। তিনি বলেন, ‘‘আমি মানুষকে একটি সুন্দর স্মৃতি নিয়ে ফিরতে সাহায্য করছি।’’

ইন্দিরার এই বছরের ক্যালেন্ডার পূর্ণ। তিনি জুন মাসে তুরস্ক, জুলাই মাসে গ্রিস, সেপ্টেম্বরে মাসাইমারা, নভেম্বরে ভিয়েতনাম এবং কম্বোডিয়া এবং ডিসেম্বরে মিশর ভ্রমণ করবেন তাঁর ক্লায়েন্টদের নিয়ে। ‘‘আমি দলের সঙ্গে ভ্রমণ, ভিসা, বুকিং সব কিছু একাহাতে করি। এটা আমার সততা এবং পেশাদারিত্ব যে, আমার সংস্থার সঙ্গে বার বার সবাই যেতে চান বা বন্ধুবান্ধবকে বলেন, নির্দ্বিধায় যেন আমার সংস্থার সঙ্গে ‘ট্যুর বুকিং’ করেন।’’

এই কাজের চ্যালেঞ্জ নিয়ে যা বললেন ইন্দিরা, তা শুনে মনে হয় দেশ-বিদেশ ঘোরার সুযোগ থাকলেও এ কাজ সহজ নয়। ‘‘সম্প্রতি মিশরে আমরা কায়রো থেকে আসওয়ান পর্যন্ত ট্রেনে যাতায়াত করছিলাম। এক ভদ্রমহিলা ভুল বোঝাবুঝির কারণে হোটেলে তাঁর স্যুটকেস ফেলে আসেন। অন্য ভদ্রমহিলা প্ল্যাটফর্মে তাঁর ব্যাগ ফেলে আসেন। মাথা ঠান্ডা রেখে আমাদের আন্তর্জাতিক অপারেটরকে যোগাযোগ করি। তাঁরা উভয়ের ব্যাগ উদ্ধার করেন এবং পরবর্তী ট্রেনে আমাদের কাছে পৌঁছে দেন।’’

(বাঁ দিকে ) পার্বতী ভট্টাচার্য এবং মহুয়া মুখোপাধ্যায় (ডান দিকে) । নিজস্ব চিত্র।

আয়

এই রকম ট্যুর থেকে আয় কেমন হয় প্রশ্ন করাতে ইন্দিরা বলেন, ‘‘যে হেতু আমি একা কাজ করি, আমার অ্যাপার্টমেন্ট থেকেই আমার কাজ করি। আমার ‘ওভারহেড’ খরচ খুব কম আর আমার অনেক অর্থ রোজগারের আকাঙ্ক্ষাও নেই। উদাহরণস্বরূপ আমার সঙ্গে একটি ১০ দিনের মিশর ‘গ্রুপ’ সফরে মাথাপিছু ১,০৮০০০ টাকা খরচ হবে, অন্তর্ভুক্ত বিলাসবহুল হোটেলে থাকা, সমস্ত খাওয়াদাওয়া, দর্শনীয় স্থান ভ্রমণ, ট্রেনের টিকিট। তবে এয়ার টিকিট অন্তর্ভুক্ত নয়।”

পার্বতী বলছেন যে, তাঁর সংস্থার বার্ষিক প্রায় ২ কোটি টাকা। তাণর কথায়, ‘‘আমি জানি অন্য ভ্রমণ সংস্থাগুলি অনেক বেশি অর্থ উপার্জন করে, তবে আমি পরিষেবায় একটা বিশেষ মান বজায় রাখতে চেষ্টা করি।’’ স্বাগতা একটা বিষয়ে পরিষ্কার। ‘‘আবেগকে অনুসরণ করলেই এই কাজ আনন্দ করে করা যায়। টাকার পিছনে ছুটলে কাজে মন থাকবে না।’’

মহুয়া যেমন বলছিলেন, যখন লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছিল তখন একটি গ্রুপকে ইউরোপে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সব কিছু বাতিল করা হয়েছিল। ‘‘আমাকে ‘ক্রেডিট নোট’ দেওয়া হয়েছিল, যা আমি পরে ব্যবহার করতে পারি। লকডাউনের সময় কোনও আয় হয়নি, কিন্তু আমার কর্মীদের বেতন দিয়ে গিয়েছি। এ দিকে গ্রাহকদের প্রতিশ্রুতি দেওয়া ছিল যে, লোকডাউন শেষ হলেই যাব কোথাও। কথা রাখাটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই পেশায়।”

‘‘যখন আমরা গত বছর কাশ্মীর গিয়েছিলাম এবং কিছু প্রবীণ ব্যক্তি তাঁদের স্বপ্নপূরণ করার জন্য আমার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন, তখন উপলব্ধি করলাম যে জীবন কেবল এইটুকুর জন্যই সার্থক,’’ মনে করেন স্বাগতা। পার্বতীও এই প্রতিক্রিয়ায় সম্মত হন।

এই চার জনই কাজ করছেন একটি প্রতিযোগিতামূলক ক্ষেত্রে। কিন্তু কর্মদক্ষতা, সততা এঁবং ধৈর্যকেই প্রাধান্য দিয়ে এঁরা সফল হয়েছেন। এক একটি দলের সমস্ত দায়িত্ব নিয়ে নির্দ্বিধায়, নির্ভয়ে দেশের আনাচ-কানাচে বা বিদেশ-বিভুঁইয়ে ঘুরে এসেছেন, মানুষকে আনন্দ দিয়েছেন এবং দিচ্ছেন।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement