Football

অতিরিক্ত মেসি নির্ভরতা না জাভি-ইনিয়েস্তাদের অভাব, বার্সার মূল সমস্যা ঠিক কোথায়?

কিছু বুঝে ওঠার আগেই সব শেষ। চ্যাম্পিয়ন্স লিগে বায়ার্ন মিউনিখের কাছে বার্সেলোনার লজ্জাজনক হার দেখে অনেকেই বিস্মিত। আট গোল হজম করেছে বার্সা এটা অনেকেই বিশ্বাস করে উঠতে পারছেন না।

Advertisement

কৃশানু মজুমদার

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৫ অগস্ট ২০২০ ১৬:৫৩
Share:

বায়ার্নের কাছে বিধ্বস্ত মেসির বার্সেলোনা। ছবি—এএফপি।

কেউ বলছেন, অবাক করার মতো ফলাফল। কেউ বলছেন, ঐতিহাসিক রেজাল্ট। আবার কারও মতে, এটাই তো হওয়ার ছিল।

Advertisement

শুক্রবার রাতে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের কোয়ার্টার ফাইনালে জার্মানির ক্লাব বায়ার্ন মিউনিখের দাপট দেখে এমনটাই বলছেন ফুটবল-বিশেষজ্ঞরা।

লিসবনে লিও মেসির বার্সেলোনাকে নিয়ে ছেলেখেলা করল বায়ার্ন। আর জার্মান-ক্লাবের এই দৌরাত্ম্য বিশ্বাস করতে পারছেন না এটিকে-মোহনবাগানের কোচ আন্তোনিও লোপেজ হাবাস। তিনি বলছেন, ‘‘ঐতিহাসিক রেজাল্ট ছাড়া একে কী বলব বলুন তো! বার্সাকে গুঁড়িয়ে দিল বায়ার্ন।’’

Advertisement

আরও পড়ুন: দুই মহাতারকার বিদায়ে ১৫ বছর পর অভিনব রেকর্ড চ্যাম্পিয়ন্স লিগে

মেসির চোখ ঝলসানো স্কিল, সুয়ারেজের গোল খিদে নিয়ে কত কালি খরচ হয়, তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু জার্মান-ধাঁধার সমাধান করা সম্ভব হয়নি তাঁদের পক্ষে।

১০ বছর আগে দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে আর্জেন্তিনার রিমোট কন্ট্রোল ছিল দিয়েগো মারাদোনার হাতে। ‘এল দিয়েগো’র দল সে বারের বিশ্বকাপে আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলছিল। কিন্তু কোয়ার্টার ফাইনালে নীল-সাদা জার্সিধারীরা বিবর্ণ হয়ে যান। ম্যাচের আগে সাংবাদিক বৈঠকে মারাদোনা পর্যন্ত জার্মানদের বিরুদ্ধে মনস্তাত্বিক যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছিলেন। জার্মানির মাঝমাঠের প্রাণভোমরা বাস্তিয়ান সোয়েইনস্টেইগারকে উদ্দেশ করে মারাদোনা বলেছিলেন, ‘‘সোয়েইনস্টেইগার, আর ইউ নার্ভাস?’’ মাঠে নেমে আর্জেন্তিনাকে ০-৪ গোলে উড়িয়ে দেন টমাস মুলাররা।

বার্সায় ত্রিমূর্তি। জাভি, ইনিয়েস্তা ও মেসি। —ফাইল চিত্র।

চার বছর পরের বিশ্বকাপে ব্রাজিলের ঘরের মাঠে জার্মানি ৭-১ গোলে চূর্ণবিচূর্ণ করে সেলেকাওদের। দুঃস্বপ্নের সেই রাত আজও ভোলেননি ব্রাজিলীয়রা। গত কাল রাতে বায়ার্ন মেসিদের ভেঙে চুড়ে শেষ করে দেয়। ৩১ মিনিটের মধ্যেই ৪-১! তখনই ম্যাচ পকেটে নিয়ে ফেলেছিল বায়ার্ন। নব্বই মিনিটের শেষে সেটাই হয়ে ৮-২। হাবাস বলছেন, ‘‘জার্মানদের অভিধানে রিল্যাক্স বলে কোনও শব্দ নেই। বার্সে‌লোনাকে দেখে কেমন যেন ছাড়া ছাড়া মনে হয়েছে।’’

মোহনবাগানকে আই লিগ দেওয়া কোচ কিবু ভিকুনা আবার ক্লাব ফুটবল ও জাতীয় দলকে মেশাচ্ছেন না। আইএসএল ক্লাব কেরল ব্লাস্টার্সে সই করা স্পেনীয় কোচ বলছেন, ‘‘জাতীয় দল ও ক্লাব ফুটবলকে আলাদা করতে হবে। দুটোকে মেশালে চলবে না। যদি জাতীয় দলের কথা বলতে হয়, তা হলে আমি বলবো সেরা দল ফ্রান্স। কারণ ওরা গতবার বিশ্বকাপ জিতেছে। আর ক্লাব দল যদি বাছতে বলা হয়, তা হলে আমি বলবো এই মুহূর্তে শক্তিশালী দল বায়ার্ন। ওরা চেলসি, বার্সেলোনার মতো ক্লাবকে খুব সহজেই হারিয়ে দিয়েছে। কাল বায়ার্ন সব দিক থেকেই বার্সার থেকে এগিয়েছিল। গোটা ম্যাচে বার্সার থেকে ৯ কিমি বেশি দৌড়েছে বায়ার্ন। আমার মতে, রিয়াল মাদ্রিদ, বার্সেলোনা, অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের মতো সেরা স্প্যানিশ দলগুলো গত দু’ মরসুম ধরে সেরা ফর্মে নেই।’’

জার্মানির ক্লাব দল বোখুমের বিরুদ্ধে অতীতে খেলেছেন এশিয়ান অল-স্টার খ্যাত গোলকিপার অতনু ভট্টাচার্য। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলছিলেন, ‘‘জার্মানির ফুটবলের বিশেষত্ব হল, ওরা পাওয়ার ফুটবল খেলে। খুব সহজে গোলের কাছে পৌঁছে যায়। নিজেদের গুছিয়ে নিতে বেশি সময় খরচ করে না। ওদের খেলা সে ভাবে বললে দৃষ্টিনন্দন হয়তো নয়, কিন্তু খুবই কার্যকরী। এই কৌশলে জার্মানি বহু দিন ধরেই খেলছে। আর এই খেলার ধরনটাই অন্যরা ধরতে পারে না। সেই কারণেই বড় বড় দলগুলোকে বড় ব্যবধানে হারাতে পারে।’’

একটা সময়ে স্পেনের ‘তিকিতাকা’ ফুটবল বিশ্ব জুড়ে বিপ্লব ঘটিয়েছিল। পাসিং ফুটবলের বিচ্ছুরণ দেখা যেত স্পেনের বিশ্বজয়ী দলের ফুটবলে। পাস খেলতে খেলতেই গোটা দলটা এগিয়ে যেত। ব্রাজিলের ফুটবলে আবার শিল্পের গন্ধ। জার্মানরা দেখিয়ে দিচ্ছে অন্য রাস্তা। অতনু বলছিলেন, ‘‘বল পজেশন কার বেশি, তা এখন আর বিবেচ্য নয়। আসল কথা হল গোল। গোলের কাছে কে কত তাড়াতাড়ি পৌঁছতে পারে, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। জার্মানরা সেটাই প্রমাণ করে আসছে।’’

ফুটবলে স্পেস আর সময় সমার্থক। কোনও ফুটবলারকে জায়গা দিয়ে দেওয়া আর সময় দিয়ে দেওয়া একই ব্যাপার। মেসি-রোনাল্ডোদের মতো সৃজনশীল ফুটবলারদের জায়গা দিয়ে দিলে কী হয়, সেটা সবাই জানেন। জার্মান ক্লাব বা জাতীয় দলের বিরুদ্ধে কিন্তু এই জায়গা সহজে পাওয়া যায় না। জাতীয় দলের প্রাক্তন ফুটবলার অতনু বলছিলেন, ‘‘মেসি-রোনাল্ডোদের বিচরণ করার জায়গাটা বন্ধ করে দেয় জার্মানরা।শুধুমাত্র ব্যক্তিগত নৈপুণ্য দিয়ে এ সব দলের সঙ্গে এঁটে ওঠা কঠিন।’’

গতকাল ম্যাচ চলাকালীন অনেকেই বলছিলেন, বার্সার মাঝমাঠ বলে কিছু নেই। জাভি-ইনিয়েস্তারা বুট জোড়া তুলে রেখেছেন। পাসিং ফুটবলকে অন্য মাত্রা দিয়েছিলেন মাঝমাঠের দুই নেতা। জাভি-ইনিয়েস্তা প্রসঙ্গে শোনা যায়, অনুশীলনে দু’জন যখন নিজেদের মধ্যে বল পাস করার অনুশীলন করতেন, সেই শব্দ শুনে তাঁদের কোচ বুঝে যেতেন দুই শিল্পী সাধনায় মেতে উঠেছেন। মাঠে নেমে ফুল ফোটাতেন‌ জাভি-ইনিয়েস্তা। তাঁদের পাশে পেয়ে মেসি হয়ে উঠতেন আরও ভয়ঙ্কর। ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যেতেন ‘এলএম টেন’।

বার্সার সেই সোনায় মোড়ানো মাঝমাঠ কোথায়? কোথায় সেই পাসিং ফুটবলের ঝলকানি? জাভি-ইনিয়েস্তার অভাবে বহু দিন ধরেই বার্সার মাঝমাঠে রক্তাল্পতা দেখা যাচ্ছে। গতকাল হাহাকার দেখা দেয়। মেসির বিরুদ্ধে একসময়ে খেলা ইস্টবেঙ্গলের প্রাক্তন স্পেনীয় ফুটবলার টনি ডোভালে বলছেন, ‘‘জাভি-ইনিয়েস্তার অভাব পূরণ করতে পারেনি বার্সেলোনা। আর সেটা সম্ভবও নয়। ওদের অভাবটা প্রতি মুহূর্তে অনুভূত হচ্ছে।’’ জাভি-ইনিয়েস্তার মতো সৃজনশীল ফুটবলারের অভাবেই কি মেসিকে নিষ্প্রভ দেখিয়েছে? বার্সায় মেসি ম্যাজিক দেখান। কিন্তু জাতীয় দলের হয়ে আর্জেন্তাইন মহানায়ক সেই কক্ষপথে হাঁটতে পারেন না। নিন্দুকরা বলতেন, বন্যেরা বনে সুন্দর, মেসি সুন্দর বার্সেলোনায়।

সেই মেসি গতকাল রাতে মাঠে ছিলেন কি না, সেটাই ভাল করে বোঝা যায়নি বায়ার্নের দাপটে। টনি বলছেন, ‘‘মেসি বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়। এ বিষয়ে কোনও সন্দেহই নেই। যে কোনও মুহূর্তে ও ম্যাচের রং বদলে দিতে পারে। তবে ওকে সাপোর্ট দেওয়ার মতো ফুটবলারও তো দরকার। বার্সেলোনায় যে সাপোর্ট আগে পেত মেসি, সেটা এখন আর পাচ্ছে না। জাভি-ইনিয়েস্তার বিকল্প পাওয়া বার্সার পক্ষে কঠিন।’’ চ্যাম্পিয়ন্স লিগে বার্সার এই বিপর্যয় প্রমাণ করছে, দলে ব্যাপক পরিবর্তন দরকার। সবার আগে কোপ পড়বে কোচ সেতিয়েনের উপরে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট বার্তোমিউ চেয়ার ছাড়বেন না। সব জায়গাতেই একই ছবি। দল হারলে ‘ঘ্যাচাং ফু’ হন কোচ। হাবাস বলছেন, ‘‘এই বার্সেলোনা দলটাকে ঢেলে সাজানো দরকার। আশি শতাংশ পরিবর্তন দরকার।’’

আরও পড়ুন: লজ্জার হারের প্রথম বলি, বরখাস্ত হচ্ছেন বার্সার কোচ সেতিয়েন

বায়ার্নের ধ্বংসলীলা দেখে বিস্মিত ইস্টবেঙ্গলের প্রাক্তন কোচ ট্রেভর জেমস মর্গ্যানও। তিনি বলছেন, ‘‘এই রেজাল্ট আমায় অবাক করেছে। তবে ফুটবলে তো এ রকম অদ্ভুত ফলাফলও মাঝে মধ্যে ঘটে। যেমন ধরুন লেস্টার সিটি ৯-০ গোলে হারিয়েছিল সাউদাম্পটনকে। কালকের ম্যচটা সে রকমই একটা ছিল। আমার মনে হয় না কেউ এক বারও ভেবেছিল বার্সেলোনা এতগুলো গোল হজম করবে।’’

আর এখানেই তো টেক্কা দিয়ে গেল জার্মানির ক্লাব। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই বার্সেলোনাকে নক আউট করে দিল বায়ার্ন।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement