ভাবমূর্তিতে বরাবর বাল্যবন্ধুর বিপরীত মেরুতে। কিন্তু ক্রিকেট কেরিয়ারে কোনও দিনও বন্ধুর সঙ্গে তুলনা তাঁর পিছু ছাড়েনি। পরবর্তীতে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল সেই বন্ধুত্বও। কিন্তু সচিন তেন্ডুলকরের ছায়া থেকে কোনও দিন বার হতে পারেননি বিনোদ কাম্বলী।
মু্ম্বইয়ের শহরতলি কঞ্জুরমার্গে কাম্বলীর জন্ম ১৯৭২ সালের ১৮ জানুয়ারি। চাওলের ঘিঞ্জি ঘরে ৩ ভাই এবং ১ বোন-সহ বড় হয়ে ওঠা যৌথ পরিবারের মোট ১৮ জন সদস্যের সঙ্গে। দারিদ্রবিদ্ধ শৈশবে দাঁতে দাঁত চেপে ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন দেখে গিয়েছেন। ভিড় লোকাল ট্রেনে করে কঞ্জুরমার্গ থেকে আসতেন মুম্বইয়ের শিবাজি পার্কে। রমাকান্ত আচরেকরের কাছে ক্রিকেট শিখবেন বলে।
রমাকান্ত আচরেকরের শিষ্যত্বের সূত্রে সচিনের সতীর্থ কাম্বলী। তাঁদের অভিন্নহৃদয় বন্ধুত্ব এবং স্কুল ক্রিকেটে অসাধারণ পারফরম্যান্স মুম্বই ক্রিকেট মহলে বহুল চর্চিত। ১৯৮৮ সালে মু্ম্বইয়ের স্কুল ক্রিকেটে হ্যারিস শিল্ডে নিজেদের নাম রেকর্ড বইয়ে লিখে রাখে এই জুটি।
সে বছর সেন্ট জেভিয়ার্সের বিরুদ্ধে ৬৬৪ রানের ইনিংস উপহার দেয় তেন্ডুলকর-কাম্বলী জুটি। সেই ম্যাচে কাম্বলীর স্কোর ছিল ৩৪৯ রান। পরে তিনি বল হাতে ৩৭ রানে প্রতিপক্ষের ৬ উইকেট তুলে নেন।
স্কুল স্তর এবং ঘরোয়া ক্রিকেট পেরিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে কাম্বলীর অভিষেক হয় ১৯৯১-৯২ মরসুমে। ১৯৯১ সালের অক্টোবরে প্রথম ওয়ান ডে খেলেছিলেন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। তার ২ বছর পরে টেস্ট অভিষেক ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে।
১৭ টেস্টে তাঁর মোট সংগ্রহ ১০৮৪ রান। ব্যাটিং গড় ৫৪.২০। সর্বোচ্চ রান ২২৭। ১০৪টি ওয়ান ডে-তে তাঁর মোট রান ২,৪৭৭। সর্বোচ্চ ১০৬। উইকেট পেয়েছেন ১টি। খেলেছেন ১৯৯২ এবং ১৯৯৬ ক্রিকেট বিশ্বকাপে।
১৯৯৬ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে কাঁদতে কাঁদতে ইডেন গার্ডেন ছেড়ে কাম্বলীর বেরিয়ে যাওয়ার দৃশ্য এখনও ভুলতে পারেননি ক্রিকেটপ্রেমীরা। ধারাবাহিকতার অভাবে তাঁর টেস্ট কেরিয়ার স্থায়ী হয়েছিল মাত্র ২ বছর। শেষ দিকে ওয়ান ডে-তেও দলে নিয়মিত ছিলেন না। শেষ ওয়ান ডে খেলেন ২০০০ সালে। তার ১১ বছর পরে অবসর নেন ঘরোয়া ক্রিকেট থেকে। তার ২ বছর আগে ২০০৯-এ অবসর নেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে। পরে দক্ষিণ আফ্রিকার ঘরোয়া ক্রিকেটেও খেলেছেন কাম্বলী।
ব্যক্তিগত জীবনে বার বার বিতর্কের মুখোমুখি হয়েছেন কাম্বলী। নয়ের দশকে কাম্বলী বিয়ে করেন নোয়েলা লুইসকে। নোয়েলা ছিলেন হোটেলের রিসেপশনিস্ট। দাম্পত্যের কয়েক বছরের মধ্যেই তাঁদের সম্পর্কে ফাটল ধরা পড়ে। শেষে তাঁদের বিচ্ছেদ হয়ে যায়।
প্রথম বিয়ে ভেঙে যাওয়ার পরে কাম্বলী সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন মডেল অ্যান্দ্রিয়া হেউইটের সঙ্গে। তবে সম্পর্কের প্রথম কয়েক বছর তাঁরা অনুষ্ঠানিক বিয়ে করেননি। শুধু রেজিস্ট্রি ম্যারেজ করেছিলেন। দ্বিতীয় বিয়ের পরে ধর্মান্তরিত হন কাম্বলী।
২০১৪ সালে বান্দ্রার সেন্ট পিটার্স গির্জায় ক্যাথলিক মতে অ্যান্দ্রিয়াকে বিয়ে করেন কাম্বলী। শুধু নিকট পরিজনদের উপস্থিতিতে বিয়ের অনুষ্ঠান ছিল সম্পূর্ণ ঘরোয়া। এই বিয়ের সময় তাঁদের একমাত্র ছেলে জেসাস ক্রিস্টিয়ানোর বয়স ছিল কয়েক বছর।
২০১৩ সালের নভেম্বরে হৃদরোগে আক্রান্ত হন কাম্বলী। চেম্বুর থেকে গাড়ি চালিয়ে বান্দ্রা যাওয়ার পথে তিনি হৃদরোগের শিকার হন। এক পুলিশকর্মীর তৎপরতায় তাঁকে লীলাবতী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ঘনিষ্ঠ মহলের খবর, সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরার পরে আধ্যাত্মিক জীবনের প্রতি তাঁর আগ্রহ বাড়ে। সিদ্ধান্ত নেন ধর্মীয় মতে বিয়ে করার। কিন্তু এই দাম্পত্যেও বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন সস্ত্রীক কাম্বলী।
কয়েক বছর আগে অভিযোগ ওঠে, বাড়ির পরিচারিকা সোনি সরসলের উপর লাগাতার মানসিক নির্যাতন চালিয়ে গিয়েছেন বিনোদ কাম্বলী এবং তাঁর স্ত্রী অ্যান্দ্রিয়া। এমনই পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছিল, নির্যাতিত পরিচারিকা ফিনাইল পান করে আত্মহত্যা করারও চেষ্টা করেছিলেন।
পরিচারিকা সোনির অভিযোগ ছিল, তাঁকে বাড়ি ফিরতে দিতেন না কাম্বলী এবং তাঁর স্ত্রী। বেতন দাবি করলে আটকে রাখতেন তালাবন্ধ ঘরে। কাম্বলী দম্পতির বিরুদ্ধে এফআইআর-ও দায়ের করেন সোনি। এই ঘটনার বছর তিনেক পরে মুম্বইয়ের এক শপিং মলে গায়ক অঙ্কিত তিওয়ারির বাবা রাজ তিওয়ারিকে নিগ্রহ করার দায়ে অভিযুক্ত হন তাঁরা।
কৈশোরে যে তেন্ডুলকর-কাম্বলী বন্ধুত্ব ছিল সকলের আলোচনার বিষয়, কয়েক দশক পেরিয়ে ফাটল ধরা তাঁদের ভগ্নপ্রায় সম্পর্ক উঠে এসেছিল খবরে। দুই প্রাক্তন ক্রিকেটারের ঘনিষ্ঠ মহলের খবর, কাম্বলীর বিতর্কিত জীবন মেনে নিতে পারেননি তেন্ডুলকর। তিনি ধীরে ধীরে সম্পর্কে দূরত্ব বাড়িয়ে দেন।
২০০৯ সালে কাম্বলী এসেছিলেন টেলিভিশনের রিয়েলিটি শো ‘সচ কা সামনা’-য়। সেখানে তিনি আক্ষেপ প্রকাশ করেছিলেন যে ২০১৩ সালে নিজের শেষ টেস্টে বিদায়ী বক্তব্যে এক বারও তাঁর কথা উল্লেখ করেননি বাল্যবন্ধু তেন্ডুলকর। এমনকি, অবসর গ্রহণের পরে যে পার্টি তিনি দিয়েছিলেন, সেখানেও আমন্ত্রিত ছিলেন না কাম্বলী। জীবনের কঠিন সময়ে বন্ধু তেন্ডুলকর তাঁর পাশে ছিলেন না বলেও আক্ষেপ এই বাঁ-হাতি ব্যাটসম্যানের।
ক্রিকেট থেকে অবসর নেওয়ার পরে কাম্বলী অভিনয় করেন ‘অন্নর্থ’ এবং ‘পল পল দিল কে সাথ’ ছবিতে। ছোট পর্দাতেও দেখা গিয়েছে তাঁকে। ২০০২ সালে অভিনয় করেন দূরদর্শনের ধারাবাহিক ‘মিস ইন্ডিয়া’-য়। প্রতিযোগী হিসেবে অংশ নিয়েছেন ‘বিগ বস’-এও।
অবসর জীবনে যোগ দিয়েছেন রাজনীতিতেও। লোক ভারতী পার্টির হয়ে তিনি ২০০৯ বিধানসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন ভিখরোলি কেন্দ্র থেকে। কিন্তু পরাজিত হন বড় ব্যবধানে। পরবর্তী সময়ে তাঁর বিজেপিতে যোগদান নিয়েও গুঞ্জন ছড়ায়। তবে প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে না থাকলেও সমাজসেবায় অংশ নেন কাম্বলী।