রেনাতো স্যাঞ্চেস। ফাইল ছবি
সময়টা ২০১৬ সালে মে মাস। ফ্রান্সে ইউরো কাপ শুরু হতে মাত্র কয়েক সপ্তাহ বাকি। হঠাৎই গোটা বিশ্বে পড়ে গেল শোরগোল। পর্তুগাল নাকি পরবর্তী ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোকে খুঁজে পেয়েছে। ঝাঁকড়াচুলো, পেটানো চেহারার সেই তরুণের প্রতিভার কথা শুনে দেরি করেনি বায়ার্ন মিউনিখ। রেকর্ড অর্থের বিনিময়ে বেনফিকা থেকে তুলে নিয়েছে তাঁকে। লক্ষ্য, ইউরোপে বায়ার্নের দাপট পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করা।
পরের কয়েকটা সপ্তাহ যেন স্বপ্নের মতো গেল তরুণ ছেলেটার কাছে। পর্তুগাল জিতল প্রথম ইউরো কাপ। আর সেই জয়ে আগাগোড়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে গেলেন সেই তরুণ। ক্রোয়েশিয়ার বিরুদ্ধে গোল, পোলান্ডের বিরুদ্ধে পেনাল্টি শুট-আউটে গোল থেকে ফাইনালে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে রোনাল্ডোর অনুপস্থিতিতে দুরন্ত খেলা। ফাইনালের আগেই প্রতিযোগিতার সেরা তরুণ প্রতিভা হয়ে গিয়েছিলেন। হাতেগরম প্রতিভাকে পেয়ে বায়ার্ন-কর্তারা মুচকি হেসেছিলেন তখন।
আবার এসেছে ইউরো, আবার পর্তুগালের জার্সিতে দেখা যাচ্ছে তাঁকে। তিনি রেনাতো স্যাঞ্চেস। কিন্তু মাঝের পাঁচটা বছরে বদলে গিয়েছে অনেক কিছুই। খ্যাতির বিড়ম্বনা এবং জীবনের উত্থান-পতন দেখা হয়ে গিয়েছে স্যাঞ্চেসের। বেনফিকার অনূর্ধ্ব-১৯ দলে কোচ ছিলেন রেনাতো পাইভা। তিনি খুব কাছ থেকে দেখেছেন স্যাঞ্চেসকে। পাইভার মতে, স্যাঞ্চেসের ফুটবলমস্তিষ্ক নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু খামখেয়ালী মনোভাব যেন বরাবর তাঁকে তাড়া করে বেরিয়েছে।
ফুটবলজীবনের উত্থান কার্যত রকেটের মতো। ১৭ বছরেই বেনফিকার দ্বিতীয় দলে সুযোগ। পরের বছর প্রথম দলে ডাক। বেনফিকার প্রথম দলের হয়ে অভিষেক ম্যাচ খেলার ছ’মাসের মধ্যে ইউরোর দলে ডাক এবং বায়ার্ন মিউনিখের প্রস্তাব। বেনফিকা তাঁকে রাখতে চেয়েছিল। কিন্তু বায়ার্নের মোটা অঙ্কের প্রস্তাব ফেরানো তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। পাইভা পরে বলেছেন, বড্ড দ্রুত স্যাঞ্চেসকে ছেড়ে দিয়েছিল ক্লাব।
বায়ার্ন কিন্তু প্রথম দলে তাঁকে খেলায়নি। কারণ প্রথম দলে বড় নামের ভিড়ে সুযোগ পাওয়া কঠিন ছিল স্যাঞ্চেসের। তাঁকে সোয়ানসি সিটিতে লোনে পাঠানো হয়। মনে মনে হয়তো এই পরিবর্তন চাননি স্যাঞ্চেস। ক্রমশই মন খারাপের প্রভাব পড়তে থাকে খেলায়। সোয়ানসির তৎকালীন কোচিং স্টাফের সদস্য অ্যালান কার্টিস বলেছেন, “ও এখানে আসতে চায়নি। ওকে পাঠানো হয়েছিল। ও চেয়েছিল লন্ডনের কোনও ক্লাবে খেলতে। আমরা অনেক কিছু করতে পারি। কিন্তু সোয়ানসিকে তো আর লন্ডন বানিয়ে ফেলতে পারব না। কোনও ফুটবলার যদি মানসিক ভাবে খুশি না থাকে, তাহলে কোনওদিন তাঁকে দিয়ে ভাল খেলানো যাবে না।”
ছোট ক্লাবে খেলে নিজের প্রতিভার বিকাশ ঘটানোর সুযোগ ছিল স্যাঞ্চেসের সামনে। কিন্তু মন ভাল ছিল না। দিনের পর দিন ফ্ল্যাটে বসে থাকতেন। কার্লো আনচেলোত্তি বায়ার্ন ছাড়ার পর নিকো কোভাচ ফিরিয়ে আনলেন স্যাঞ্চেসকে। কথা দিয়েছিলেন নিয়মিত খেলানোর। কিন্তু কথা রাখলেন না। মাঝে সাঝে পরিবর্ত হিসেবে নামানো হতে থাকল তাঁকে। বিরক্ত স্যাঞ্চেস ম্যাচের পর একদিন বলেই দিলেন, তিনি আরও বেশি খেলতে চান, নাহলে ক্লাব ছাড়তে চান। বায়ার্ন দেরি করেনি। তাঁকে বেচে দেওয়া হয় লিলে-তে।
প্রথম ম্যাচে হাঙ্গেরিকে ৩-০ ব্যবধানে হারিয়েছিল পর্তুগাল। সুদূর ইকুয়েডরে বসে সেই ম্যাচ দেখছিলেন পাইভা। দ্বিতীয়ার্ধে নামার পরেই ডানদিকে স্যাঞ্চেস একটি বল ধরেন, এক দৌড়ে চারজনকে কাটিয়ে নিয়ে রাফা সিলভাকে পাস দেন। রাফাকে ফাউল করা হয়, পেনাল্টি পায় পর্তুগাল, গোল করেন রোনাল্ডো। পাইভা বলেছেন, “বহুদিন পরে নিখুঁত রেনাতোকে দেখলাম। ওর ক্ষমতা, দক্ষতা, জেতার খিদে— সব যেন একটা দৌড়েই বেরিয়ে এল। মাত্র ১০ মিনিট মাঠে ছিল। তাতেই কাঁপিয়ে দিল।” শুধু তাই নয়, জার্মানি ম্যাচেও দুরন্ত খেলেছেন স্যাঞ্চেস। তাঁর একটি গোলার মতো শট বার কাঁপিয়ে ফিরে আসে।
চলতি মরসুমে প্যারিস সঁ জঁ-কে টপকে ফরাসি লিগ জিতেছে লিলে। সেই দলে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছেন স্যাঞ্চেস। ইউরোয় তাঁর ছন্দ দেখে ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড, লিভারপুল তাঁর এজেন্টের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছে। বৃত্ত কি তবে সম্পূর্ণ হল?