রবের্তো মানচিনি। ছবি রয়টার্স
সাত বছর আগে জোহানেসবার্গের এলিস পার্কের সেই রাত বোধহয় এখনও ভুলতে পারেননি মার্সেলো লিপ্পি। চার বছর আগেই তাঁর কোচিংয়ে বিশ্বকাপ জিতেছিল ইটালি। ২০১০-এ অখ্যাত স্লোভাকিয়ার কাছে হেরে বিদায়! লিপ্পির একসময় মনে হয়েছিল, কোচিংই ছেড়ে দেবেন। কী দরকার আর!
জিয়াম পিয়েরো ভেঞ্চুরাও কি শান্তিতে রয়েছেন? ২০১৮-য় সুইডেনের বিপক্ষে বিশ্বকাপের যোগ্যতা অর্জন পর্বের মরণ-বাঁচন ম্যাচ। হারছে ইটালি। দলে যখন স্ট্রাইকার নামানোর দরকার, তখন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার ফ্রান্সেসকো তোত্তিকে ওয়ার্ম-আপ করতে বললেন ভেঞ্চুরা। তোত্তি বারবার অনুরোধ করলেন রিজার্ভ বেঞ্চে বসে থাকা লোরেনজো ইনসিনিয়েকে নামানোর। ভেঞ্চুরা কর্ণপাত করেননি। চার বারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইটালি ৬০ বছর পর বিশ্বকাপের যোগ্যতা অর্জন করতে পারল না।
২০০৬ থেকে ২০১৮— ইটালির ফুটবলের কাছে এই সময়টা কালো অধ্যায়। ২০১০-ই শুধু নয়, ২০১৪-তেও প্রথম রাউন্ডে বিদায় নিয়েছিল ইটালি। ২০০৬-এ বিশ্বকাপ জিতলেও ইটালীয় ফুটবল তখন কাঁপছে ‘ক্যালসিয়োপোলি’-তে। ভয়ঙ্কর ম্যাচ গড়াপেটায় বিদ্ধ জুভেন্টাস-সহ তিন নামী ক্লাব। সবাইকে নামিয়ে দেওয়া হল দ্বিতীয় ডিভিশনে। ২০১০-এ সেই হারের পর লিপ্পি সাংবাদিক বৈঠকে এসে বলেছিলেন, “ফুটবলাররা মনে হয় ভয়ঙ্কর কোনও সন্ত্রাস দেখার পর ভয় নিয়ে খেলতে নেমেছিল।” ২০১৪-এ প্রথম রাউন্ডে বিদায় নেওয়ার পর তৎকালীন ফুটবল সংস্থার কর্তারা সরাসরি টিভির সামনে পদত্যাগ করেন। পরিস্থিতি যে তাতেও পাল্টায়নি, সেটা বোঝা গিয়েছিল।
ইটালির সমস্যা লুকিয়ে ছিল অন্দরে। পাওলো রোসি, আরিগো সাক্কি, দিনো জফ, সালভাতোরে স্কিলাচ্চির দেশ থেকে প্রতিভাবান নতুন ফুটবলার উঠে আসছিল না। কারণ দেশের যুব ফুটবলটাই ছিল ভুলে ভরা। জুভেন্টাসের কোচ মাসিমিলিয়ানো আলেগ্রি প্রকাশ্যে বলেছিলেন, ইটালির কোচেরা চান শুধু চাকরি বাঁচাতে। তাই খুদে ফুটবলারদের নতুন কিছু শেখাতে ভয় পান। তাই আন্তর্জাতিক স্তরে যখন সেই ফুটবলাররা খেলতে যায়, তখন তাঁরা অপরিণত। ফল, স্লোভাকিয়ার মতো দেশের কাছে হেরে বিদায়। গোটা ব্যবস্থাটাকেই আমূল বদলানোর দরকার ছিল।
সেই কাজটাই করেছেন রবের্তো মানচিনি। ইটালির ফুটবলের স্বপ্নের সওদাগর। ২০১৮-য় দায়িত্ব নেওয়ার পর ইটালি হেরেছে মাত্র দুটি ম্যাচে। রবিবার ওয়েলসকে হারিয়ে টানা ৩০ ম্যাচে অপরাজিত তারা। ৮২ বছরের পুরনো রেকর্ড ছুয়েছে তারা। শেষবার ভিত্তোরিয়ো পোজ্জোর অধীনে টানা চার বছর এবং ৩০ ম্যাচ অপরাজিত ছিল ইটালি।
মানচিনি এসে শুধু দুটি কাজ করেছেন। দীর্ঘদিন ধরে পরিচিত ইটালির ‘কাতানেচ্চিয়ো’ কৌশল বদলে দলকে অনেক বেশি আক্রমণাত্মক করে তুলেছেন। পাশাপাশি নতুন মুখদের সুযোগ দিয়েছেন। তিনি কোচ হয়ে আসার পর দেশের জার্সিতে অভিষেক হয়েছে ৩৫ জনের। ইউরো কাপের দলে সুযোগ পেয়েছেন মূলত তরুণরাই। খেলোয়াড়দের ফিটনেসের উপরেও রয়েছে তাঁর কড়া নজর। মানচিনি এসে সিনিয়র দলের সঙ্গে বিভিন্ন যুব দলের একসঙ্গে অনুশীলন করান কয়েকদিন। পরিষ্কার করে দেন, যুব দলকে হেলাফেলা করা চলবে না। সেই কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছেন মরিসিও ভিসিদি। ইটালির বিভিন্ন যুব দলের খোলনলচে বদলে দিয়েছেন। ফলও ধীরে ধীরে মিলতে শুরু করেছে। ইটালি আবার জেগে উঠেছে।
ইউরো কাপের আগে মানচিনি বলেছিলেন, “আমি এসেই ফুটবলারদের বলেছিলাম, নিজেদের উপর বিশ্বাস রাখতে শেখো। যাঁরা বলেছিল ইটালিতে ভাল মানের ফুটবলার নেই, তাঁদের ভুল প্রমাণ করতে চেয়েছি। আমার লক্ষ্য ছিল বিশ্বকাপ। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ইউরো কাপের জন্যেও আমরা প্রস্তুত।”