সৌরভ মানেই আবেগ। সৌরভ মানে প্রতিবাদও। সৌরভ মানে হার-না-মানা লড়াই। বাঙালির চেতনায় তাই সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় নিছক ক্রিকেটের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ নন। দেশের অন্যতম সেরা অধিনায়ক তিনি। বুধবারই বোর্ড প্রেসিডেন্ট হিসেবে নতুন ইনিংস শুরু করলেন তিনি। এক ঝলকে দেখে নেওয়া যাক তাঁর কেরিয়ারের মোড়ঘোরানো কিছু মুহূর্ত।
১৯৯২ সালে অস্ট্রেলিয়াতে ওয়ানডে অভিষেক হয়েছিল সৌরভের। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে ৩ রান করেছিলেন। এর পর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের বাইরে থাকেন চার বছর। ১৯৯৬ সালে ইংল্যান্ডে প্রত্যাবর্তন। লর্ডস, নটিংহ্যামে প্রথম দুই টেস্টে সেঞ্চুরির পর আর ফিরে তাকাতে হয়নি সৌরভকে।
২০০১ সালে অস্ট্রেলিয়া এসেছিল ভারত। স্টিভ ওয়ার দল টানা ১৫ টেস্ট জিতেছিল। ভারতকে চিহ্নিত করা হয়েছিল ‘ফাইনাল ফ্রন্টিয়ার’ হিসেবে। সৌরভ কিন্তু সমীহ করেননি একটুও। টস হওয়ার সময় অপেক্ষা করিয়ে রেখেছিলেন স্টিভকে। যা ছিল তাঁর ট্যাকটিক্স।
সেই সিরিজে মুম্বইয়ে প্রথম টেস্ট জিতে গিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। তার পর ইডেনে ভিভিএস লক্ষ্মণের ২৮১ ও হরভজন সিংহের হ্যাটট্রিকের সুবাদে সিরিজে সমতা ফেরানো। চেন্নাইয়ে শেষ টেস্টে নাটকীয় ভাবে এল জয়। ২-১ ফলে টেস্ট সিরিজ জিতল সৌরভের ভারত।
২০০২ সালে ন্যাটওয়েস্ট ট্রফিতে চ্যাম্পিয়ন হয় টিম ইন্ডিয়া। ফাইনালে জয়ের পর লর্ডসের ব্যালকনিতে জামা খুলে ঘোরান সৌরভ। ওই দৃশ্য হয়ে ওঠে প্রতীকী। যা তুলে ধরে বিশ্বক্রিকেটে ভারতের এগিয়ে আসার ইঙ্গিত।
এর কয়েক মাস আগে ভারতে এসে মুম্বইয়ে ওয়ানডে সিরিজ জেতার পর জামা খুলে ঘুরিয়েছিলেন ইংল্যান্ডের অলরাউন্ডার অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফ। লর্ডসে তারই বদলা নিয়েছিলেন সৌরভ। সেই জামা ঘোরানোর ছবি হয়ে উঠেছিল বিতর্কিত। অনেক সমালোচনাও হয়েছিল।
অস্ট্রেলিয়ায় সৌরভের ব্যাটিং রেকর্ড তেমন উজ্জ্বল ছিল না। ২০০৩ সালে অজি সফরের প্রথম টেস্টে ১৪৪ রানের ইনিংস সেই কারণেই গুরুত্বপূর্ণ। ব্রিসবেনের গাব্বায় সেই ইনিংস এসেছিল ৬২ রানে তিন উইকেট পড়ে যাওয়ার পর। ১৯৬ বলের ইনিংসে ১৮ বাউন্ডারি মেরেছিলেন সৌরভ।
সৌরভের সেই ইনিংস উদ্দীপ্ত করেছিল পুরো দলকে। ক্রমাগত বাউন্সারে ‘চিন মিউজিক’ শোনানোর মনস্তাত্ত্বিক চাপ তৈরি করেছিল অস্ট্রেলিয়া। অধিনায়কোচিত ইনিংসে তা চুরমার করে দিয়েছিলেন সৌরভ। শুনিয়েছিলেন পাল্টা আগ্রাসনের সুর।
২০০৫ সালে জিম্বাবোয়ের বিরুদ্ধে বুলাআয়ো টেস্টে সেঞ্চুরি করেছিলেন সৌরভ। তার পরই সৌরভ বলেছিলেন, ম্যানেজমেন্টের কেউ কেউ তাঁকে সরাতে চাইছেন অধিনায়ক পদ থেকে। এর পরই জানা যায় নেতৃত্ব থেকে সৌরভের অপসারণ চেয়ে বোর্ডকে ইমেল করেছেন কোচ গ্রেগ চ্যাপেল।
গ্রেগ জানিয়েছিলেন, দলকে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো মানসিক অবস্থায় নেই সৌরভ। নেতৃত্বের প্রভাব পড়ছে ব্যাটিংয়েও। সৌরভের বিদায়ের সময় এসে গিয়েছে বলে মনে হয়েছিল গ্রেগের। এই মেলের জেরে দল থেকে বাদ পড়েন সৌরভ। এর জবাব হিসেবে ঘরোয়া ক্রিকেটে ধারাবাহিক থেকে জাতীয় দলে ফিরে এসেছিলেন তিনি।
গ্রেগ চ্যাপেল জমানায় বাদ পড়ে, নেতৃত্ব হারিয়ে হতাশায় অবসর নিতেই পারতেন সৌরভ। কিন্তু তিনি তা করেননি। নিজের প্রতি আস্থায় থেকেছেন অটুট। ফিরেও এসেছেন মহারাজকীয় ভঙ্গিতে। ২০০৬ সালে জোহানেসবার্গে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে অপরাজিত ৫১ রানের ইনিংস সেই কারণেই তাৎপর্যপূর্ণ।
ওই ইনিংস সৌরভকে ফের প্রতিষ্ঠিত করে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে। পরের বছর টেস্টে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ডাবল সেঞ্চুরি করেন তিনি। ২০০৮ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে টেস্ট সিরিজে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসরের সিদ্ধান্ত নেন সৌরভ।