Paris Olympics 2024

নিরাপত্তার বলয়ে ‘অপারেশন অলিম্পিক্স’, কিউআর কোডের জালে স্যেন-তীর

জুলাইয়ের শেষে যদি এসে থাকেন, দুমদাম প্যারিস ঘুরতে বেরোনোর দুঃসাহস দেখাবেন না। দুনিয়ার সেরা রাজপথ আপাতত চক্রব্যূহে পরিণত।

Advertisement

সুমিত ঘোষ

প্যারিস শেষ আপডেট: ২৬ জুলাই ২০২৪ ০৭:৫৩
Share:

সতর্ক: স্যেন নদীর ধারে নিরাপত্তারক্ষীদের কড়া নজরদারি। ছবি: রয়টার্স।

সকাল ১০টার সঁজে লিজে। বিশ্বের সব চেয়ে বৃহৎ রাজপথ বলা হয় যাকে। সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউকে যদি কারও প্রশস্ত মনে হয়, তা হলে বলা যাক, সঁজে লিজে মানে কল্পনায় অন্তত গোটা দশেক সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ পর পর যোগ করে নিন। প্যারিসে অসংখ্য দর্শনীয় স্থানের মধ্যে অন্যতম সেরা আকর্ষণ। যে কোনও দেশের ট্যুরিস্ট এসে প্রথমে সঁজে লিজে দেখতে ছোটেন।

Advertisement

দাঁড়ান। জুলাইয়ের শেষে যদি এসে থাকেন, দুমদাম প্যারিস ঘুরতে বেরোনোর দুঃসাহস দেখাবেন না। দুনিয়ার সেরা রাজপথ আপাতত চক্রব্যূহে পরিণত। যেখানে যদিও বা ঢুকে পড়তে পারেন, বেরোনোর উপায় জানা নেই। আলিবাবা ও চল্লিশ চোরের কাশেমের মতোই নানা সাঙ্কেতিক লেখা আউরে যেতে হবে। তবু গুহার দরজা খুলবে না। খুলবে একমাত্র যদি ‘কিউআর কোড’ হাতে থাকে। ‘গুগ্‌ল পে’-র মতোই তা তুলে ধরতে হবে পুলিশের সামনে। ঠিকঠাক হলে তবেই সামনের রাস্তা খুলবে। না হলে কাশেমের মতোই গুহার ভিতরে আটকে মরতে হবে।

এই প্রথম অলিম্পিক গেমসের উদ্বোধন হচ্ছে কোনও স্টেডিয়ামে নয়, খোলা আকাশের নীচে। ঐতিহাসিক স্যেন নদীতে। মধ্যযুগীয় রূপকথা থেকে ‘ইমপ্রেশনিস্ট’দের বিখ্যাত সব ছবির সাক্ষী যে নদী। একদিকে উৎসবের নদী হিসেবে যা চিহ্নিত। পিয়ের অগুস্ত রেনোয়ার বিখ্যাত পেন্টিং ‘লাঞ্চ অব দ্য বোটিং পার্টি’-তে এই উৎসবের আমেজ অমরত্ব লাভ করেছে। জোয়ান অব আর্কের চিতাভস্ম ছড়ানো হয়েছিল স্যেন নদীর পবিত্র জলে। আবার ভিক্তর য়ুগোর লিয়োপোল্ডাইন নৌকো দুর্ঘটনায় ডুবে মারা যান। নেপোলিয়ন ‘প্যারিসের প্রধান সড়ক’ বলতেন স্যেনকে।

Advertisement

বৃহস্পতিবার স্যেন‌ নদীর তিরে গিয়ে মনে হল, গেমসের বোধন নয়। যেন সম্রাট নেপোলিয়ন বেঁচে আছেন। বিশাল সামরিক সজ্জা চলছে তাঁরই নির্দেশে। প্যারিসের একটা বড়সড় অঞ্চলকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছে। বিশেষ করে নদীর চারপাশটা, যেখানে শুক্রবার উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হবে। ‘কিউআর কোড’ না থাকলে এই সব অঞ্চলে ঢোকা যাবে না। অলিম্পিক্স কভার করতে আসা সাংবাদিকদের কার্ডের সঙ্গে এই মহামূল্যবান বস্তুটি রয়েছে। তার পরেও যে রকম নিরাপত্তার বলয়ের মধ্যে পড়তে হল, ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচেও দেখা যায় না। শুধু সাংবাদিকের কাছে কিউআর কোড থাকলেই তো হবে না, গাড়িচালকের কাছেও থাকতে হবে। আর এক-একটা রাস্তার জন্য এক-এক রকম কোড। কোনও একটা দিয়ে ঢুকে পড়লেন মানে চতুর্দিকে যাওয়া যাবে, তার নিশ্চয়তা নেই। গাড়ি করে স্যেন‌ নদীর তীর দিয়ে বেরোতে গিয়ে পঁয়তাল্লিশ মিনিট ধরে ঘোরাঘুরি করে একই জায়গায় ফিরে আসতে হল। জায়গাটাকে যেন দুর্গে পরিণত করে ফেলা হয়েছে। রোজই কিছু না কিছু ঘটনা ঘটছে প্যারিসে। শোনা যাচ্ছে, জঙ্গি সংগঠন হুমকি দিয়েছে। যদিও সংগঠকেরা জানিয়েছেন, ইন্টেজিলেন্স বিভাগের কাছে এ রকম কোনও খবর নেই। তবু কখন কী হয়ে যায়, কে বলতে পারে? গোটা দুনিয়া তাকিয়ে রয়েছে প্যারিসের দিকে। স্থানীয়রা বলছেন, ‘‘প্রশাসন চায় না ব্যর্থ হতে। চায় না সারা দুনিয়া ছিছিক্কার করার সুযোগ পাক।’’ সঁজে লিজেতে গিয়ে দেখা গেল, অনেক ট্যুরিস্ট সেখানে ঘুরছেন। নিজস্বী তুলছেন। রাস্তার ধারে বাস স্টপেজ়ে বসে আড্ডা দিচ্ছেন। কিন্তু কেউ জানেন না, কী ভাবে নিজেদের হোটেলে ফিরবেন। সবাই ছুটছেন রাস্তায় কর্মরত পুলিশ বাহিনীর কাছে। বেরিয়ে তো পড়েছি,কিন্তু কী ভাবে এই গন্তব্যে ফিরব?

সবাই যে যুদ্ধের সাজগোজ দেখে খুশি, তা নয়। স্যেন নদীর তিরে অনেকে বসবাস করেন। তাঁদের আগে থেকে বলে দেওয়া হয়েছিল, ‘কিউআর কোড’ সংগ্রহ করে নিতে। কেউ কেউ আগাম খবর খেয়াল করেননি। উদ্বোধনের লগ্নে নিজের বাড়ি থেকেও বেরোতে পারছেন না। কলকাতায় বড় পুজোর পাড়ায় বসবাস করলে অনেকের এমন অভিজ্ঞতা হয়। স্থানীয় থানা থেকে আগাম কার স্টিকার নিয়ে রাখতে হয়। না হলে সন্ধ্যার পরে গাড়ি নিয়ে নিজের বাড়িতেই যেতে পারবে না। কলকাতার পুজোয় তা-ও তো ভোগান্তি সীমাবদ্ধ থাকে গাড়ি নিয়ে। এখানে নিজেও তো যেতে পারবে না। প্যারিসের এক সাংবাদিক বললেন, স্থানীয়রা নিরাপত্তার এই বাড়াবাড়িতে রীতিমতো ক্ষুব্ধ। তাঁরা নাকি নামকরণ করেছেন ‘কিউআর কোড অলিম্পিক্স’। বৃহস্পতিবার নদীর তীরে গিয়ে কোভিডের সময়কার লকডাউন মনে পড়ে গেল। শুনশান রাস্তা। আশেপাশের বাড়িগুলোতেও যেন সবাই নিজেদের গৃহবন্দী করে রেখেছেন। মুখ বার করলেও যদি সংক্রমণ হয়ে যায়। নদীর উপরে একটি বোট। সেখানে কয়েক জনকে পাওয়া গেল। কিন্তু তাঁরা উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের শিল্পী। মহড়া দিতে এসেছিলেন। গলায় ঝুলছে কার্ড। আর তাতে ওই মহার্ঘ বস্তু— কিউআর কোড।

নানা দেশের অন্তত ১০০ জন রাষ্ট্রপ্রধান আসছেন বলে শোনা যাচ্ছে। তিন লক্ষ পঁচিশ হাজার দর্শক এই অভিনব উদ্বোধনী অনুষ্ঠান দেখবেন নদীর তীর ধরে বসে। সংগঠকেরা সংখ্যাটা আরও বেশি রাখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু নিরাপত্তাজনিত কারণে কমাতে হয়েছে। প্রায় সাড়ে দশ হাজার প্রতিযোগী রয়েছেন এ বারের গেমসে। নদীবক্ষে মার্চপাস্টে এক-একটা দল আসবে বোটে করে। একশোর কাছাকাছি বোট থাকবে। ভারতের পতাকাবাহক যেমন পি ভি সিন্ধু ও শরৎ কমল। অন্তত তিন হাজার শিল্পী ও তাদের সহকারীরা উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন। আর কোথায় সেই অনুষ্ঠান? না, অশান্ত প্যারিসে। রোজই কোনও না কোনও ঘটনা ঘটছে। নির্বাচনের উত্তাল হাওয়া বইছে। ফ্রান্স এখন এককাট্টা নয়, বিভক্ত একটা দেশ। প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাকরঁ পর্যন্ত আবেদন জানিয়েছেন, গেমসের কুড়ি দিন অন্তত সব দূরত্ব, ভেদাভেদ, মতান্তর ভুলে সবাই এক হয়ে উঠুন। না হলে যে গৃহযুদ্ধ বেঁধে যাওয়ার মতো অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি। সেই আবহে অলিম্পিক্স মহাযজ্ঞেরও আগে অগ্নিপরীক্ষা। প্রেস সেন্টারে এক কর্তা বোঝাচ্ছিলেন, সেন্ট্রাল প্যারিসকে কী ভাবে নানা ‘জ়োনে’ ভাগ করা হয়েছে। কোনও ‘জ়োনে’ শুধু গাড়ি ঢুকতে পারবে, পথচারীদের প্রবেশ নিষেধ। আবার কোথাও শুধু পায়ে হেঁটেই যাওয়া যাবে, গাড়ি ঢুকতে পারবে না। সর্বোচ্চ নিরাপত্তা যে সব অঞ্চলে জারি হয়েছে, তাদের ভোগান্তি সব চেয়ে বেশি। অনেক রেস্তরাঁ, কাফে তার মধ্যে রয়েছে। অন্যান্য সময় চুটিয়ে ব্যবসা চলে। এখন মাছি তাড়াচ্ছে। দোকানীর কাছে ‘কিউআর কোড’ থাকতে পারে কিন্তু যারা দোকানে আসবে তারা সে সব কোথা থেকে পাবে? অনেকে অলিম্পিক্সের নাম শুনে শহর ছেড়ে পালিয়েছে। ছুটি কাটাতে চলে গিয়েছে ইউরোপের অন্যান্য শহরে। রোজকার নিয়ম হচ্ছে, স্যেন‌ নদীর আশপাশে ট্যুরিস্টের ভিড় গিজগিজ করবে। তার চারপাশে কত সব দর্শনীয় স্থান। লুভ্‌র মিউজিয়াম, নতরদাম গির্জা, আইফেল টাওয়ার। নদীপথে ঘোরার সময় প্যারিসের গর্বের এই সব ইমারতগুলো দেখা যায়। যে কারণে স্যেন্‌ নদীর ‘ক্রুজ়’ পৃথিবী বিখ্যাত। মাত্র এক ঘণ্টার মধ্যে নদীপথে চলতে চলতে সব কিছু দেখে নেওয়া যায়। এখন সে সবের কোনও প্রশ্ন নেই।অলিম্পিক্সের পাঁচটা রিং পাঁচটি মহাদেশের প্রতীক। কিন্তু প্যারিসে গেমসের ঐতিহ্যবাহী পাঁচটি গোলককে বলা হচ্ছে ‘রিংস অফ স্টিল’। কোন দেশ কটা মেডেল জিতল, তার চেয়েও বেশি করে জরিপ করা হবে আগামী কয়েক দিন ফরাসি নিরাপত্তা বিভাগের গলায় সাফল্যের পদক উঠল কি না। তারা লৌহকঠিন নিরাপত্তার বলয় তৈরি করতে পারলেন কি না। আঠারো হাজার সৈন্য কখনও কোনও গেমসে মোতায়েন হয়েছে বলে শোনা যায়নি। তিরিশ হাজার পুলিশ গোটা শহর টহল দিচ্ছে। শুক্রবার শুধু স্যেন নদীর তিরে উদ্বোধনের সময়েই সংখ্যাটা বেড়ে পঁয়তাল্লিশ হাজার হবে। শহর থেকে দূরে সেনার বিশেষ ক্যাম্পকরা হয়েছে।

এক-এক সময় মনে হচ্ছে, শুক্রবার প্যারিসে যে মহাযজ্ঞের উদ্বোধন হতে চলেছে, তার নাম অলিম্পিক গেমস নয়। বলা উচিত, অপারেশন অলিম্পিক্স!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement