অলিম্পিক্সের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্যেন নদীর উপরে বোটে জাতীয় পতাকা নিয়ে পিভি সিন্ধু, শরৎ কমলেরা। শুক্রবার প্যারিসে। ছবি: সংগৃহীত।
লেডি গাগা। জ়িনেদিন জ়িদান। গ্রেট ব্রিটেনের দুই পতাকাবাহক ডাইভার টম ডালে এবং রোয়ার হেলেন গ্লোবারের টাইটানিকের সেই বিখ্যাত পোজ়ের স্মৃতি ফিরিয়ে আনা। ফরাসি বিপ্লবকে শ্রদ্ধা জানানো।
ঐতিহাসিক স্যেন নদীতে নাটকীয় অভিনব এক অলিম্পিক্সের উদ্বোধন হয়ে গেল শুক্রবার। যে অনুষ্ঠানকে ঘিরে সারা বিশ্বের আগ্রহ ছিল। তা প্রত্যাশাপূরণ তো করলই, নতুন এক দিগন্ত খুলে দিয়ে গেল ক্রীড়া উদ্বোধনের ক্ষেত্রে। স্টেডিয়ামের বদ্ধ পরিবেশে কেন উদ্বোধন করতে হবে? প্যারিস দেখিয়ে দিল, উদার মনোভাব এনে মনের জানলা-দরজাগুলোকে খুলে দাও। ভয়কে জয় করো। স্যেন নদীর তীরে বসে সেই জমকালো উদ্বোধনী অনুষ্ঠান দেখতে দেখতে নিজেকে চিমটি কেটে দেখতে ইচ্ছা করছিল, ঠিক দেখছি? নাকি পুরোটাই ‘অ্যান ইভিনং ইন প্যারিস’-র মতো জনপ্রিয় সিনেমা। চরিত্রগুলো সামনে যা ফুটে উঠছে তা সত্যি নাকি যেমন পর্দায় অভিনয় চলে, তেমন হচ্ছে। কে বলবে, এই প্যারিসই আতঙ্কের শহর হয়ে দাঁড়াচ্ছিল গেমসের উদ্বোধনকে কেন্দ্র করে।
অনেকেই প্রশ্ন তুলছিল, এখানে এত রাজনৈতিক টানাপড়েন চলছে। সদ্য নির্বাচন হয়েছে এবং তাতে কোনও দল নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা পায়নি। একক ভাবে কেউ সরকার গড়তে পারছে না। নানা জঙ্গিহানার আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। এমনও নাকি হুমকি এসেছে যে, অলিম্পিক্সের মধ্যে রক্তগঙ্গা বইয়ে দেওয়া হবে, যেমন ২০১৫ সালের সেই ভয়ঙ্কর হামলায় বিধ্বস্ত হয়েছিল ফ্রান্স।
এই আবহের মধ্যে দাঁড়িয়ে প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাকরঁ এবং প্যারিস শহরের মেয়র অ্যানি ইরালগো তাঁদের সংকল্পে অনড় থেকেছেন। সারা বিশ্বের চাপের কাছে নতিস্বীকার না করে স্যেন নদীতে খোলা আকাশের নীচে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান করে দেখিয়ে দেব, জঙ্গিদের হুমকিতে পৃথিবী চলে না। চলে মনুষ্যজাতির ইচ্ছায়। আর সেই ইচ্ছা হল, ভয় না পেয়ে বুক চিতিয়ে এগিয়ে চলা। নানা রং, নানা আবেগ, নানা ইতিহাসের রামধনু দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, শুধু গেমসের উদ্বোধন হল না। প্যারিস যেন গোটা বিশ্বকে অনুপ্রাণিত করে বার্তা দিয়ে দিল যে, বাঁচো, প্রাণ খুলে বাঁচো। নিজের ইচ্ছামতো বাঁচো। ওরা ভয় দেখাবে কিন্তু দিনের শেষে জয় হবে আমাদের মেরুদণ্ডের।
সকাল থেকে প্যারিসে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আগে তা আরও বেড়ে গেল। মাঝপর্বে একবার তো মুষলধারে নামল। ভারতীয় সময় রাত পৌনে একটা নাগাদও কাউকে রণে ভঙ্গ দিতে দেখছি না। বললে কেউ বিশ্বাস করবে, অধিকাংশ দর্শক আসনে মাথার উপরে ছাদ পর্যন্ত নেই। অলিম্পিক্সের কয়েকজন ভলিন্টিয়ারকে দেখলাম ছুটে ছুটে রেনকোটের মতো পাতলা প্লাস্টিক বিতরণ করছেন। আর তাই মাথায় দিয়ে সকলে বসে স্যেন নদীর তীরে এই অভিনব সন্ধ্যা উপভোগ করছেন। জঙ্গি হানার হুমকি, বৃষ্টি, কোনও কিছুই যেন আজ প্যারিসিয়ানদের মনোবলে চিড় ধরাতে পারল না।
বৃহস্পতিবার স্যেন নজীর তীরে এসে মহড়া তেমন ভাবে দেখতে পাইনি বলে মনে হচ্ছিল, তা হলে কি কোনও রকম প্রস্তুতি ছাড়া এত বড় একটা বোধন হতে চলেছে? প্যারিসের যাবতীয় নজর কি শুধুই নিরাপত্তায়? একটা মাছিও যাতে গলতে না পারে। এ দিন ভুল ভাঙিয়ে দিলেন এক ফরাসী সাংবাদিক। জানালেন, এক অজ্ঞাত জায়গায় গত একমাস ধরে এই অনুষ্ঠানের মহড়া চলেছে, যাতে সারা বিশ্বের সামনে গেমস উদ্বোধনের মাধ্যমে ফরাসি দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করে তোলা যায়।
যেখানে বসে উদ্বোধন দেখলেন সবাই, তার পিছনেই আইফেল টাওয়ার। এরকম দোটানায় আর কখনও পড়তে হবে না বোধহয়, যখন ভাবতে হচ্ছে সামনে স্যেন নদীতে এই ‘অ্যান ইভিনিং ইন প্যারিস শো’ দেখব নাকি ঘাড় ঘুরিয়ে আইফেল টাওয়ারের দিকে তাকিয়ে থাকব। বোট নিয়ে নদীবক্ষে মার্চপাস্ট! বোটে করে এল ভারতীয় দল। দুই পতাকাবাহক পি ভি সিন্ধু এবং শরৎ কমল হাত নাড়ছেন। উচ্ছ্বসিত বাকিরাও। অলিম্পিক্স কেন, কোনও খেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানেই দেখা যায়নি। প্যারিসকে যে ফ্যাশন ক্যাপিটালও বলা হয়, সেটাও দ্রুত মনে করিয়ে দেওয়া হল। স্যেন নদীতে একটা ব্রিজের উপরে দেখা হল ‘ক্যাটওয়াক’ হচ্ছে। ও দিকে নদীর তীরে একজন পিয়ানো বাজাতে শুরু করলেন। প্যারিসে গেমসের উদ্বোধন হচ্ছে আর এরকম আবেগের ছোঁয়া থাকবে না, হয় না কি!
ফ্রান্সের বোট যখন ঢুকল, আইফেল টাওয়ার আলোয় ঝিকমিক করে উঠল, যা দেখতে ছুটে আসেন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ। সবচেয়ে নাটকীয় মুহূর্ত মনে হল আইফেল টাওয়ারের নীচ থেকে ঘোড়ায় করে বেরিয়ে আসা অজানা মহিলা। যাঁর গায়ে অলিম্পিক্সের পতাকা জড়ানো। আইফেল টাওয়ারকে ‘আয়রন লেডি’ বলা হয়। ইনিও কি তাই?
আলেকজান্দ্রে থ্রি থেকে উদ্বোধন শুরু হয়েছিল নদীবক্ষে ছয় কিলোমিটারের পথ বেয়ে। শেষ হল চোকাদহতে। ফরাসি প্রেসিডেন্ট মাকরঁ, আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির প্রধান টোমাস বাখ, আয়োজক কমিটির প্রধান টনি এস্তাঙ্গুয়েদ, সবাই উপস্থিত ছিলেন। যেখানে বসার ব্যবস্থা হয়েছিল আনন্দবাজার-সহ পৃথিবীর সব নামী সংবাদপত্রের। প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা ধরে অনুষ্ঠান চলল। মাথার উপরে সারাক্ষণ বৃষ্টি, তবু একবারের জন্যও কারও কাছে একঘেয়ে মনে হল না।
জিদান এসে অলিম্পিক মশাল তুলে দিলেন ফরাসি ওপেনের অবিসংবাদী নায়ক রাফায়েল নাদালের হাতে। সেই সময় সবচেয়ে তীব্র হল স্যেন নদীর ধারে বসে থাকা দর্শকদের গর্জন। জয়ধ্বনি উঠল, ‘জ়িজু, জ়িজু, জ়িজু’। তখনই শুরু হয়ে গেল লেজ়ার শো। আলোর ঝরনায় আরও মায়াবী করে তোলা হল আইফেল টাওয়ারকে।
শুধু স্যেন নদীর তীরে বলে তো নয়। গোটা শহরের নানা প্রান্তে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের উৎসব চলতে থাকল। কোথাও নাচের অনুষ্ঠান চলছে, কোথাও হয়তো কেউ গান গাইছেন। আবার কোথাও কেউ খেলা দেখাচ্ছেন। সম্পূর্ণ অন্য ভাবনার এক উদ্বোধনী অনুষ্ঠান, যা আগে কেউ ভাবতে পারেনি। মাতিয়ে দিয়ে গেল প্যারিস।
রোয়িং কিংবদন্তি এস্তাঙ্গুয়েদ মন মাতান উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মতোই হৃদয় জিতে নেওয়া বক্তব্যে, ‘‘সারা বিশ্বকে আমরা দেখাতে চেয়েছিলাম যে, এটা প্যারিস। এখানে সব দেশের মানুষ স্বাগত। সব ধর্ম স্বাগত। সবসম্প্রদায় স্বাগত।’’
প্রতিযোগীদের উদ্দেশে বললেন, ‘‘প্যারিস ভালবাসার শহর। আর আগামী কয়েকদিন এটা তোমাদের শহর। কাল থেকে তোমাদের জয় আমাদের জয়, তোমাদের পরাজয় আমাদের পরাজয়।’’
নোত্র দাম গির্জা ভয়াবহ আগুনে পুড়ে গিয়েছিল। সেই গির্জা মেরামতের কাজ চলছে। এখনও ট্যুরিস্টদের জন্য খোলা হয়নি। সেই গৌরবের গির্জা নিয়েও বার্তা দিয়ে দিল প্যারিস। সেই নোত্র দামকে আবার পুরনো ঔজ্জ্বল্য ফিরিয়ে আনব। কথা ছিল, উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের প্রধান আলোচ্য বিষয় হবে নিরাপত্তা। এ দিন বিকেলের দিকে অলিম্পিক্স কমিটির বিশেষ মিডিয়া বাসে করে আসতে গিয়ে মনে হল, গেমস নয়, যুদ্ধ দেখতে যাচ্ছি। স্যেন নদীর আশপাশ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে বাকি শহর থেকে। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ছিল কিউআর কোড। মিলে গেলেই ঢুকে পড়া যাবে। এ দিন সেই রক্ষাকবচও নেই। গেমসের উদ্বোধনের জন্য আলাদা কার্ড, তার সঙ্গে বিশেষ স্টিকার। যিনি যে অঞ্চলে বসবেন, তা রং দিয়ে চিহ্নিত করা। স্টিকারটি হবে সেই রংয়ের। শুনছিলাম, স্যেন নদীতে হাউজ়বোটে যাঁরা থাকেন, তাঁদেরও বলে দেওয়া হয়েছিল বেশি অতিথি রাখবেন না। নিরাপত্তা নিয়ে সমস্যা হতে পারে। আশেপাশে নদীর তীর জুড়ে অনেক আবাসন। সমস্ত ফ্ল্যাট মালিকদের বলে দেওয়া হয়েছিল, বাড়িতে চার-পাঁচজনের বেশি রাখবেন না।
কিন্তু উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার পর থেকে নিরাপত্তা নিয়ে চর্চা চলে গেল দুই নম্বরে। এক এবং নিঃসংশয় ভাবে একে থাকছে নদীবক্ষে বহমান এই উদ্বোধনী অনুষ্ঠান যার ‘থিম’ খেলা নয়। ‘থিম’ হল ভয়কে জয় করে জীবন উপভোগ করো।