উল্লাস: ওয়েডকে আউট করার পরে জাডেজা। গেটি ইমেজেস
রিকি পন্টিংও অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। দিনের শেষে অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট বোর্ডের টুইট করা একটি ভিডিয়োয় দেখা যায়, মাইলফলক ছোঁয়ার পরে ক্রিকেটারদের বিভিন্ন উৎসব। যেখানে রয়েছে সোমবার মেলবোর্নে হাফসেঞ্চুরির পরে রবীন্দ্র জাডেজার তলোয়ারের মতো করে ব্যাট ঘোরানোর দৃশ্য। যা দেখে পন্টিং বলে ওঠেন, ‘‘জাডেজার এই উৎসবের মানেটা কী, সেটা ঠিক বুঝতে পারছি না।’’
পন্টিং বুঝতে না পারলেও জাডেজার ঘনিষ্ঠরা জানেন, এই বিশেষ অসি-উৎসবের তাৎপর্য কী। তলোয়ার ঘোরানোর মাধ্যমে জাডেজা বুঝিয়ে গেলেন, এই লড়াইয়ে তাঁরই জয় হয়েছে।
ভারতীয় অলরাউন্ডারের বিশেষ এই উৎসবের নেপথ্য কাহিনিটা শোনা গেল জাডেজার দিদির মুখেই। এ দিন ফোনে নয়না জাডেজা বলছিলেন, ‘‘এটা আমাদের রাজপুত পরম্পরা। আমাদের পূর্বজনের পদাঙ্কই অনুসরণ করছে ভাই।’’ কী করতেন তাঁর পূর্বপুরুষেরা? নয়না বলছিলেন, ‘‘রাজপুতরা যখন কোনও যুদ্ধ জিতে আসতেন বা কোনও ভাল কাজ ঠিক মতো করতেন, তখন এই ভাবেই তলোয়ার ঘুরিয়ে উৎসব করতেন। লড়াই জেতার বার্তা থাকত এই উৎসবে। যখনই আনন্দ-উৎসব হয়, তখনই আমরা এই ভাবে তলোয়ার ঘোরাই। এই ভাবেই জাড্ডু ওর ধর্ম, ওর রীতি, ওর জাতিকে তুলে ধরছে বিশ্বের দরবারে।’’
জাডেজার ব্যাট ঘোরানো দেখে পরিষ্কার, অভ্যাস না থাকলে এটা সম্ভব নয়। বাড়িতে কি মাঝে মাঝে তলোয়ার ঘোরান ভাই? দিদির জবাব, ‘‘অবশ্যই। আমাদের বাড়িতে অনেক তলোয়ার আছে। তলোয়ার আর ঘোড়া, এই দুটো ভাইয়ের খুব প্রিয়। তলোয়ার আমাদের শৌর্যের প্রতীক।’’
এই তলোয়ার ঘুরিয়ে উৎসবটা এখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দেখা গেলেও জাডেজা শুরু করেছিলেন সেই রঞ্জি ট্রফি থেকে। তাঁর এক সময়কার সতীর্থ এবং পরবর্তী কালের সৌরাষ্ট্র দলের কোচ হয়ে যাওয়া সীতাংশু কোটাক বলছিলেন সে কথা। একই কথা শোনা গেল সৌরাষ্ট্র ক্রিকেট সংস্থার সচিব হিমাংশু শাহ-এর মুখেও। তাঁর কথায়, ‘‘জাডেজা কতটা লড়াকু ছেলে, আমরা জানি। তাই লড়াইয়ে জেতার পরে ও ওই ভাবে জয়ের বার্তা দেয়।’’
মেলবোর্নের উৎসবের চেয়েও সীতাংশুর মনে ধরেছে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে জাডেজার ব্যাটিং। এ দিন ফোনে বলছিলেন, ‘‘জাডেজার যা ব্যাটিং দক্ষতা, তার প্রতিফলন আন্তর্জাতিক স্তরে দেখা যায় না।’’ প্রাক্তন সতীর্থ এবং কোচের চোখে ধরা পড়েছে একটা সমস্যা। ‘‘ভারতীয় দলে জাডেজা সাধারণত সাত নম্বরে নামে। যে কারণে ও ভয় পেত, উল্টো দিকের উইকেট তাড়াতাড়ি পড়ে যাবে। আর ও ব্যাট করার সুযোগ পাবে না। তাই দ্রুত রান করার চেষ্টায় অনেক বার আউট হয়ে গিয়েছে। টেস্টে অশ্বিনের সেঞ্চুরি আছে, অথচ জাডেজার নেই!’’ আপনি কোনও পরামর্শ দেননি? সীতাংশুর জবাব, ‘‘আমি ওকে বলেছিলাম, তুমি কত নম্বরে নামছ, এটা ভুলে যাও। মনে করো, চারে নেমেছ। সেই মতো ইনিংস গড়ার কাজটা করো। মেলবোর্নে ওর ব্যাটিং দেখে মনে হল, ইনিংস গড়াতেই মনোযোগ দিয়েছে।’’
রঞ্জি ট্রফিতে তিনটি ট্রিপল সেঞ্চুরি করার রেকর্ড রয়েছে জাডেজার। ২০১১-১২ এবং ২০১২-১৩ মরসুমে। ওড়িশা, গুজরাত, রেলওয়েজের বিরুদ্ধে। যে তিনটে ম্যাচেই খেলেছিলেন সীতাংশু। জাডেজার ব্যাটিংয়ের সব চেয়ে বড় শক্তি কী? খুব কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতা থেকে সীতাংশুর জবাব, ‘‘ওর টাইমিং। এত ভাল টাইমিংয়ের পিছনে কিন্তু ওর ফিটনেসও কাজ করে। দারুণ ফিট হওয়ার কারণে ওর রিফ্লেক্সেও ভাল। সেকেন্ডের ভগ্নাংশ আগে বলের কাছে পৌঁছতে পারে।’’
নেটে কী রকম দেখতেন জাডেজাকে? সীতাংশু বললেন, ‘‘জাডেজা সব সময় ব্যাট করতে চাইত নেটে। শুরু থেকেই ব্যাটিংয়ের জন্য অনেক বেশি সময় দিত নেটে।’’ পাশাপাশি তিনি এও বলেন, ‘‘জাডেজা খুব ভাল স্পিনারও। এ দিন তো দু’উইকেট তুলে নিল।’’
চলতি টেস্ট সিরিজ শুরুর আগে রাজপুত-শৌর্যের প্রতীক জডেজাও ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন একটা ব্যাপারে। নয়না বলছিলেন, ‘‘পায়ের চোট নিয়ে খুব চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল ভাই। মাথাতেও বল লেগেছিল। ওই সময় আমার সঙ্গে ওর কথা হয়। ওকে সাহস দিয়েছিলাম। বলেছিলাম, তুই ঠিক ফিরে আসবি।’’
লকডাউনের পরে নিভৃতবাসে থাকতে হয়েছিল ক্রিকেটারদের। প্রথমে দুবাইয়ে, তার পরে সিডনিতে। এতে মানসিক ভাবে সমস্যা হয়নি জাডেজার? দিদির সাফ জবাব, ‘‘পরিবার ওর সঙ্গে ছিল। ভাই তো স্ত্রী আর মেয়েকে নিয়ে গিয়েছিল দুবাইয়ে। অস্ট্রেলিয়াতেও গিয়েছিল ওরা। ক’দিন আগে ফিরল। আর ও যা কঠিন মানসিকতার ছেলে, সব ঝড়-ঝাপ্টা সামলে নেয়।’’ সেটা প্রতিনিয়তই বুঝিয়ে দিয়ে চলেছেন ভারতীয় ক্রিকেটের ‘রকস্টার’।