বুধবার আরব সাগরের পারে দাপটের সঙ্গে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ৬৭ রানে হারিয়েছে ভারত। নির্ণায়ক টি-টোয়েন্টি পকেটে পুরে ছিনিয়ে নিয়েছে সিরিজ। পরের বছর অস্ট্রেলিয়ায় টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। তার আগে বছরের শেষ টি-টোয়েন্টিতে বিরাট কোহালির দলের প্রতাপ ক্রিকেটপ্রেমীদের অবশ্যই স্বস্তি দেবে। এই জয়ের বেশ কিছু ইতিবাচক দিক রয়েছে।
টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে রান তাড়া করাই পছন্দের টিম ইন্ডিয়ার। টস জিতে রান তাড়া এই ফরম্যাটে জয়ের সহজ রেসিপিও। ভারতীয় দল তাই এর আগে বেঙ্গালুরুতে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে সিরিজেও প্রথমে ব্যাট করার ঝুঁকি নিয়েছিল। কিন্তু তা সফল হয়নি। হেরে যেতে হয়েছিল। ওয়াংখেড়েতে টস হেরে প্রথমে ব্যাট করে এই জয় সেই কারণেই তৃপ্তির।
ওয়াংখেড়েতে প্রথম ওভার থেকেই মারমার কাটকাট ভঙ্গিতে শুরু করেছিলেন দুই ওপেনার। রোহিত শর্মা ও লোকেশ রাহুলের ব্যাটে আসতে থাকে বাউন্ডারি। অতীতে এই ফরম্যাটে শুরুর দিকে ভারত সতর্ক থাকত। প্রথম থেকেই চালিয়ে খেলা হত না। এ দিন পাওয়ারপ্লে-র ছয় ওভারে ওঠে ৭২ রান। মানে, ওভার প্রতি ১২ রান!
দুই ওপেনারের সাহসী ব্যাটিং সুর বেঁধে দিয়েছিল ইনিংসের। বিরাট কোহালিও ম্যাচের পর বলেছেন যে, কী ভাবে প্রথমে ব্যাটিং করা হবে, সেই পরিকল্পনার মধ্যে কোনও দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছিল না। রোহিত আগের দুই টি-টোয়েন্টিতে রান পাননি। এ দিন সেই আক্ষেপ পুষিয়ে নিলেন ঘরের মাঠে। ২৩ বলে পৌঁছলেন পঞ্চাশে।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে চারশো ছয় হয়ে গেল রোহিতের। এখন ক্রিস গেল (৫৩০ ইনিংসে ৫৩৪ ছয়) ও শাহিদ আফ্রিদি (৫০৮ ইনিংসে ৪৭৬ ছয়) শুধু সামনে আছেন রোহিতের (৩৬০ ইনিংসে ৪০৪ ছয়)। ২০১৩ সালের শুরু থেকে ধরলে হিটম্যান মেরেছেন ৩৬১ ছয়। এ দিন তিনি থামলেন ৩৪ বলে ৭১ রানে। যাতে রয়েছে পাঁচটি ছয়।
লোকেশ রাহুলের পঞ্চাশ এসেছিল ২৯ বলে। সেঞ্চুরির দোরগোড়ায় পৌঁছে গিয়েছিলেন তিনি। শেষ ওভারে থামলেন ৯১ রানে। ৫৬ বলের ইনিংসে মারলেন নয়টি চার ও চারটি ছয়। প্রথম উইকেটে রোহিতের সঙ্গে যোগ করেছিলেন ১৩৫ রান। তৃতীয় উইকেটে কোহালির সঙ্গে যোগ করেছিলেন ৯৫ রান। রাহুলই সারাক্ষণ একটা দিক ধরে রেখেছিলেন। ভারতের জয়ের অন্যতম কারণ রাহুলের ব্যাট।
ওয়াংখেড়েতে এই ফরম্যাটে শেষ তিন ইনিংসে রাহুলের ব্যাট থেকে এল ২৮৫ রান। এই ম্যাচে তিনি করলেন ৯১। এর আগে ২০১৮ সালের আইপিএল ও ২০১৯ সালের আইপিএলে এই মাঠে তিনি করেছিলেন যথাক্রমে ৯৪ ও অপরাজিত ১০০। টি-টোয়েন্টি কেরিয়ারে এই নিয়ে দ্বিতীয় বার নব্বইয়ের ঘরে আউট হলেন তিনি। ম্যান অফ দ্য ম্যাচ হলেন তিনিই।
পঞ্চাশে পৌঁছতে কোহালির লেগেছিল ২১ বল। যা টি-টোয়েন্টিতে তাঁর দ্রততম। কোনও ভারতীয় ব্যাটসম্যানের ক্ষেত্রে এটা এই ফরম্যাটে পঞ্চম দ্রুততম। এর চেয়ে কম বলে তিন বার এই ফরম্যাটে পঞ্চাশ করেছেন যুবরাজ সিংহ। আর একবার করেছেন গৌতম গম্ভীর। কোহালি শেষ পর্যন্ত ২৯ বলে অপরাজিত থাকলেন ৭০ রানে। যার মধ্যে রয়েছে সাতটি ছয়।
কোহালির ব্যাটিং সাধারণত জমি ঘেঁষা শটের উপর নির্ভরশীল। তিনি পাওয়ার হিটার নন। তুলে তুলে ছক্কা মারা তাঁর স্টাইল নয়। কিন্তু ওয়াংখেড়েতে কোহালি দেখালেন, তিনি এটাও পারেন। ওয়াংখেড়েতে টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে ১৩ ইনিংসে ৮৫.২৮ গড়ে ৫৯৭ রান করে ফেলেছেন তিনি। এর মধ্যে পাঁচটি পঞ্চাশ রয়েছে।
ভারতের পঞ্চাশ এল ২৫ বলে। একশো এল ৪৮ বলে। ১৫০ এল ৮৪ বলে। আর ২০০ এল ১০৬ বলে। পরের ১৪ বলে এল ৪০ রান। তিরুঅনন্তপুরে দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টিতেই বোঝা গিয়েছিল, জেতার জন্য অন্তত দুশো রান তুলতেই হবে। ওয়াংখেড়ের পাটা উইকেটে সেই লক্ষ্যেই এগিয়েছিল ভারত। ম্যান অফ দ্য সিরিজ কোহালি সেটাই নিশ্চিত করলেন।
রোহিত, রাহুল ও কোহালি, ভারতের তিন ব্যাটসম্যান এ দিন সত্তরের বেশি রান করেছেন। টি-টোয়েন্টি আন্তর্জাতিকে এই প্রথম বার কোনও দলের তিনজন সত্তরের বেশি রান করলেন এক ইনিংসে। শুধু আন্তর্জাতিকেই নয়, সমস্ত রকম টি-টোয়েন্টি ম্যাচেই এমন ঘটনা আগে হয়নি। ওয়াংখেড়েতে এটাই টি-টোয়েন্টিতে সর্বাধিক স্কোর।
ক্যারিবিয়ান বোলারদের মধ্যে চার ওভারে ৫৪ রান দেন জেসন হোল্ডার। শেলডন কটরেন দেন ৪০ রান, নেন এক উইকেট। খারি পিয়েরে (দুই ওভারে ৩৫ রান), কিয়েরন পোলার্ড (দুই ওভারে ৩৩ রানে এক উইকেট), হেডেন ওয়ালশ (চার ওভারে ৩৮ রান) দেন। তুলনায় কেসরিক উইলিয়ামস (চার ওভারে ৩৭ রানে এক উইকেট) কিছুটা সমীহ কেড়েছিলেন।
ওয়াংখেড়েতে প্রথমে ব্যাট করে তিন উইকেটে ২৪০ তুলেছিল ভারত। টি-টোয়েন্টিতে এর চেয়ে বেশি মাত্র দু’বার তুলেছে ভারত। ২০১৭ সালের ২২ ডিসেম্বর ইনদওরে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে পাঁচ উইকেটে ২৬০ তুলেছিল টিম ইন্ডিয়া। আর ২০১৬ সালের ২৭ অগস্ট লডারহিলে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে রান তাড়া করে চার উইকেটে ২৪৪ তুলেও হেরেছিল ভারত।
রান তাড়া করতে নেমে পাওয়ারপ্লে-র ছয় ওভারে আটকে গিয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ১৭ রানের মধ্যে পড়ে যান লেন্ডল সিমন্স, ব্র্যান্ডন কিং ও নিকোলাস পুরান। এর মধ্যে ওপেনার ইভিন লুইস আবার চোটের জন্য ব্যাট করতে নামতেই পারেননি। ফলে ব্যাটিং অর্ডার ঘেঁটে গিয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের।
কিয়েরন পোলার্ড (৩৯ বলে ৬৮) ও শিমরন হেটমায়ার (২৪ বলে ৪১) মরিয়া চেষ্টা চালালেও তা যথেষ্ট ছিল না। ভুবনেশ্বর কুমারের বলে পোলার্ড ফিরতেই দাঁড়ি পড়ে ক্যারিবিয়ানদের লড়াইয়ে। কারণ, মুম্বই ইন্ডিয়ান্সে খেলার সুবাদে ওয়াংখেড়ের মাঠ পোলার্ডের পরিচিত। আর তাই ছয় ছক্কা মেরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেনও। ভুবি তাই হানেন মোক্ষম আঘাত।
ভারতের চার জন বোলার দুটো করে উইকেট নিয়েছেন। দীপক চাহার ২০ রানে নিয়েছেন দুই উইকেট। মহম্মদ শামি (২৫ রানে দুই উইকেট), ভুবনেশ্বর কুমার (৪১ রানে দুই উইকেট) ও কুলদীপ যাদব (৪৫ রানে দুই উইকেট)। শিবম দুবে (তিন ওভারে ৩২ রান) ও ওয়াশিংটন সুন্দর (এক ওভারে পাঁচ রান) সাফল্য পাননি।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ নির্ধারিত ২০ ওভারে শেষ পর্যন্ত আট উইকেটে ১৭৩ রানে থামে। ভারত জেতে ৬৭ রানে। একই সঙ্গে তিন ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজ ২-১ ফলে দখল করে। এর পর রবিবার শুরু হচ্ছে তিন ম্যাচের একদিনের সিরিজ। যেখানে এই জয়ের আত্মবিশ্বাস সঙ্গী হবে কোহালিদের।