জিমন্যাস্টিক্সে আমেরিকার সোনা জয়ী দল। (বাঁ দিক থেকে) সিমোন বাইলস, জর্ডন চিলেস, জেড ক্যারে, হেজ়লি রিভেরা ও সুনিসা লি। ছবি: রয়টার্স।
মহিলাদের জিমন্যাস্টিক্সের দলগত ফাইনালে সোনা জেতার পরে তখন দেশের জাতীয় পতাকা নিয়ে উল্লাস করছেন আমেরিকার পাঁচ জিমন্যাস্ট। সেই পাঁচ জনের মধ্যে একমাত্র সিমোন বাইলসের খেলা নিশ্চিত ছিল এ বারের অলিম্পিক্সে। বাকি চার জনের খেলার কথাই ছিল না। অথচ মাত্র ৭২ ঘণ্টায় বদলে যায় গোটা দল। আধুনিক যুগে আমেরিকার বয়স্কতম জিমন্যাস্টিক্স দল নামে খেলতে। সেই দলই বাজিমাত করে। বাইলসের নেতৃত্বে। তিন বছর আগে টোকিয়োয় বাইলস ছেড়ে চলে যাওয়ায় যে স্বপ্ন অধরা থেকে গিয়েছিল, তা পূরণ করেন সুনিসা লি, জর্ডন চিলেস, জেড ক্যারেরা।
দলগত প্রতিযোগিতার ফাইনালে ভল্ট, ব্যালান্স বিম, আনইভেন বার ও ফ্লোর— চারটি রোটেশনেই নামেন বাইলস ও সুনিসা। জর্ডন ভল্ট ছাড়া বাকি তিনটি রোটেশনে নামেন। ক্যারে নামেন শুধু ভল্টে। রিভেরা রিজার্ভেই ছিলেন।
শুধু দলগত প্রতিযোগিতায় নয়, অলরাউন্ড ফাইনালেও সোনা জিতেছেন বাইলস। ভল্ট ও ফ্লোরে সবচেয়ে বেশি স্কোর করেছেন। বাইলসের পাশাপাশি অলরাউন্ড ইভেন্টে নিজের দ্বিতীয় পদক জিতেছেন সুনিসা। টোকিয়োয় সোনার পরে প্যারিসে ব্রোঞ্জ জিতেছেন তিনি। দুই অভিজ্ঞ তারকা দাপট দেখাচ্ছেন প্যারিসে। ভল্টেও সোনা জিতেছেন বাইলস। প্যারিসে এটি তাঁর তিন নম্বর সোনা। ব্যালান্স বিমের ফাইনালে অবশ্য হতাশ করেছেন বাইলস। বিম থেকে পড়ে যান তিনি। ফলে শেষ করেন পঞ্চম স্থানে। ফ্লোর এক্সারসাইজে জোর লড়াই হয় ব্রাজিলের রেবেকা আনদ্রাদের সঙ্গে। শেষ পর্যন্ত ১৪.১৩৩ স্কোর করে রুপো পান বাইলস।
অলিম্পিক্সে সব মিলিয়ে ১১টি পদক জিতলেন বাইলস। রিয়োয় জিতেছিলেন পাঁচটি। টোকিয়োয় দু’টি। এই অলিম্পিক্সে জিতেছেন চারটি পদক। তার মধ্যে তিনটি সোনা। এই বয়সেও দাপট দেখাচ্ছেন আমেরিকার জিমন্যাস্ট।
এ বারের অলিম্পিক্সে বাইলসের বয়স ২৭ বছর। আধুনিক যুগে অলিম্পিক্সে নামা আমেরিকার বয়স্কতম জিমন্যাস্ট। ক্যারের বয়স ২৪ বছর। জর্ডনের ২৩ বছর। সুনিসার ২১ বছর। রিজার্ভে থেকে হেজ়লি রিভেরার বয়স একমাত্র কম, ১৬ বছর। দলের গড় বয়স ২২ বছর ৬ মাস। সেই রিভেরারও খেলার কথা ছিল না এ বারের অলিম্পিক্সে। কিন্তু অলিম্পিক্সের ঠিক আগেই ছবিটা বদলে যায়।
গত বার টোকিয়ো অলিম্পিক্সে মাঝপথে নাম তুলে নিয়েছিলেন বাইলস। মানসিক সমস্যা হচ্ছিল তাঁর। মনে আতঙ্ক বাসা বেঁধেছিল। ঘরবন্দি করে নিয়েছিলেন নিজেকে। বাইলস আবার ফিরবেন কি না তা নিশ্চিত ছিল না। টোকিয়োয় অলরাউন্ড ফাইনালে সোনাজয়ী সুনিসাও কিডনির সমস্যায় ভুগছিলেন। সেই কারণে জিমন্যাস্টদের নতুন প্রজন্ম তৈরি করছিল আমেরিকা। প্যারিসের দৌড়ে এগিয়ে ছিসেন স্কাই ব্লেকলি, শিলেস জোনস, জোসেলিন রবারসন ও লিয়ানে ওং। রিজার্ভে ছিলেন কাইলা ডিসেলো। নতুন প্রজন্ম নজড় কাড়ছিল। বাইলসদের থেকে ব্যাটন নিতে তৈরি ছিলেন তাঁরা।
প্যারিসের আগে ফেরার সিদ্ধান্ত নেন বাইলস। তিনি অনুশীলন শুরু করেন। ধীরে ধীরে ফর্মে ফেরেন। আত্মবিশ্বাস বাড়ে তাঁর। অলিম্পিক্সের আগে বিশ্ব জিমন্যাস্টিক্স প্রতিযোগিতায় সোনা জেতেন বাইলস। ইউএস ক্ল্যাসিকসেও নজর কাড়েন তিনি। তার পরেই আমেরিকার দলে ঢোকেন বাইলস। অলিম্পিক্সের আগে শেষ প্রতিযোগিতায় তাঁর নেতৃত্বেই তরুণী জিমন্যাস্টদের দল খেলতে নামে। তখনও পর্যন্ত ঠিক ছিল, ব্লেকলি, জোনস, রবারসনেরাই প্যারিসে খেলবেন। কিন্তু অলিম্পিক্সের ঠিক আগে অঘটন ঘটে আমেরিকার মহিলাদের জিমন্যাস্টিক্সে।
অনুশীলনের সময় পায়ের পেশি ছিঁড়ে যায় ব্লেকলির। তার ৭২ ঘণ্টার মধ্যে চোট পান আরও তিন জিমন্যাস্ট। ভল্ট দিতে গিয়ে পায়ের পেশি ছিঁড়ে যায় ডিসেলোর। হাঁটুর চোটে নাম তুলে নেন জোনস। চোট লাগে রবারসনেরও। ৭২ ঘণ্টার মধ্যে চার জিমন্যাস্ট চোটে ছিটকে য়াওয়ায় চাপে পড়ে যায় আমেরিকা। তখনই তাদের নজর যায় প্রাক্তনদের দিকে। জিমন্যাস্টিক্সে পিছিয়ে যাওয়া সুনিসা, জর্ডন ও ক্যারে তার আগেই ফর্মে ফিরতে শুরু করেছিলেন। আমেরিকার বেশ কয়েকটি প্রতিযোগিতায় নজর কাড়েন তাঁরা।
ফলে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয় আমেরিকার জিমন্যাস্টিক্স সংস্থাকে। বাইলসের পুরনো সতীর্থ সুনিসা, জর্ডন ও ক্যারেকে ফিরিয়ে আনা হয় দলে। রিজার্ভে নেওয়া হয় সিনিয়র দলের হয়ে একটিও প্রতিযোগিতা না খেলা রিভেরাকে। ফলে দলগত প্রতিযোগিতায় টোকিয়োর দলই নামায় আমেরিকা।
প্যারিসকে টোকিয়োর বদলার মঞ্চ হিসাবে দেখছিলেন বাইলসেরা। দলের সঙ্গে থাকা চেলসি মেমেল সংবাদমাধ্যমে বলেন, “আমার মনে হয় সবকিছু আগে থেকে পরিকল্পনা করা যায় না। কিছু কিছু নিয়তিতে লেখা থাকে। প্যারিসে নামার আগে ওরা বলছিল, এটা বদলার মঞ্চ। ওরা তা করে দেখাল।” তাঁদের যে জবাব দেওয়ার ছিল, তা স্বীকার করে নিয়েছেন বাইলস। দলগত সোনা জিতে তিনি বলেন, “আমার মনে হয় টোকিয়োর পরে সকলেরই জবাব দেওয়ার ছিল। সেটা আমাদের খেলায় দেখা গিয়েছে।”
বাইলসের হাত ধরে হঠাৎ করেই যেন আমেরিকার মহিলাদের জিমন্যাস্টিক্সে বদল এসেছে। কয়েক বছর আগেও যে কর্তারা তারুণ্যকে এগিয়ে রাখছিলেন তাঁরাই এখন অভিজ্ঞতার প্রশংসা করছেন। বাইলসদের হাত ধরে এখন থেকেই চার বছর পরের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন আমেরিকাবাসী। ২০২৮ সালে নিজেদের ঘরে অলিম্পিক্স। সেখানেও হয়তো জিমন্যাস্টিক্সের দলে সুনিসা, জর্ডন, ক্যারেদেরই দেখা যাবে। নেতৃত্ব দেবেন ৩১ বছরের বাইলস। বয়স্ক দলের হাত ধরে আবার হয়তো অলিম্পিক্সে আসবে সোনা।