পদকজয়ের পর সরবজ্যোৎ সিংহ। ছবি: পিটিআই।
প্যারিস থেকে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার দূরে শাতেরু। এ বারের অলিম্পিক্সে সেখানেই হচ্ছে শুটিংয়ের যাবতীয় প্রতিযোগিতা। দু’দিন আগে সেখানেই স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিল সরবজ্যোৎ সিংহের। পুরুষদের ১০ মিটার এয়ার পিস্তলে অল্পের জন্য ফাইনালের যোগ্যতা অর্জন করতে পারেননি। ভেঙে পড়েছিলেন। জানিয়েছিলেন, নিজের সেরাটা দিয়েও শেষরক্ষা হল না। মঙ্গলবার সেই শাতেরুতেই পুনর্জন্ম হল পঞ্জাবের শুটারের। মনু ভাকেরের সঙ্গে জুটি বেঁধে ১০ মিটার এয়ার পিস্তলের মিক্সড ইভেন্টে ব্রোঞ্জ জিতলেন। প্যারিস থেকে একেবারে খালি হাতে ফিরতে হচ্ছে না তাঁকে।
মঙ্গলবার শুরুটা খুবই খারাপ হয়েছিল সরবজ্যোতের কাছে। প্রথম সিরিজ়ে মাত্র ৮.৬ স্কোর করেছিলেন। তাঁর খারাপ শটের কারণে শুরুতেই পিছিয়ে পড়ে ভারত। অনেকেই ভেবেছিলেন, মনুর একার প্রচেষ্টা বোধহয় বৃথা যেতে চলেছে। তার পর থেকে সেই যে সরবজ্যোৎ ঘুরে দাঁড়ালেন, আর থামানো যায়নি তাঁকে। ১৩টি সিরিজ়ে মাত্র পাঁচ বার দশের নীচে স্কোর করেছেন। মনুর সঙ্গে তালে তাল মিলিয়ে ভারতের স্কোর কোরিয়ার ধরাছোঁয়ার বাইরে নিয়ে গিয়েছেন।
ছোটবেলায় শুটার হওয়ার কোনও ভাবনাই ছিল না সরবজ্যোতের। অম্বালার ভগীরথ পাবলিক স্কুলে পড়ার সময় তাঁর ধ্যানজ্ঞান ছিল একটাই— ফুটবল। পেশাদার ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন ছোটবেলা থেকেই দেখতেন তিনি। সেখান থেকে একদিন আচমকাই জীবন পুরোপুরি বদলে গেল। স্কুলের পড়ার সময়ে এক দিন নিচু ক্লাসের কিছু ছেলেকে এয়ারগানে অনুশীলন করতে দেখেন। সেই খেলাই ভাল লেগে গেল। বাবার কাছে আবদার করলেন, ‘শুটার হতে চাই।’
বাবা জিতেন্দ্র সিংহ পেশায় কৃষক। অর্থবল ছিল সীমিত। ফুটবলে তবু খরচাপাতি খুব বেশি ছিল না। কিন্তু শুটিংয়ের অর্থব্যয়ের ব্যাপারে তিনি জানতেন। ছেলেকে বলেছিলেন, শুটিং খুবই দামি খেলা। তবে সরবজ্যোৎ শোনেননি। লাগাতার কয়েক মাস বাবার সামনে ঘ্যানঘ্যান করার পর অবশেষে মন গলে জিতেন্দ্রর। ছেলেকে ভর্তি করে দেন শুটিং স্কুলে। সেই সিদ্ধান্তের জন্য মঙ্গলবারের পর থেকে হয়তো আর কোনও আফসোস থাকবে না তাঁর।
২০১৯ সালে জুনিয়র বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে সোনা জিতে প্রথম বার শিরোনামে আসেন সরবজ্যোৎ। গত বছরের মার্চে প্রথম বার শুটিং বিশ্বকাপে সোনা জেতেন। মে মাসে মিক্সড ইভেন্টে সোনা জেতেন দিব্যা সুব্বারাজুকে নিয়ে। এশিয়ান গেমসে দলগত ইভেন্ট সোনা এবং মিক্সড ইভেন্টে রুপো রয়েছে। একের পর এক সাফল্য পেতে থাকেন সিনিয়র পর্যায়ে। ২০২৩-এর এশীয় চ্যাম্পিয়নশিপে ব্রোঞ্জ জিতে অলিম্পিক্সেরও যোগ্যতা অর্জন করেন বছর খানেক আগে।
সরবজ্যোতের সাফল্যের নেপথ্যে রয়েছে এক বিশেষ ধরনের ধ্যান, যা ভারতীয় যোগদর্শন নির্দেশিত ‘ত্রাটক’। ধ্যানের সময় একটি অন্ধকার ঘরে বসেন সরবজ্যোৎ। চোখের সোজাসুজি উচ্চতায় এক হাত দূরে জ্বালানো থাকে একটি মোমবাতি। সরবজ্যোৎ তিন মিনিট মোমবাতির শিখার দিকে তাকিয়ে থাকেন। এর পর চোখ বন্ধ করে দু’মিনিট সেই মোমবাতির শিখা কল্পনা করেন। একটি সেশনে চার বার এই অনুশীলন করতে হয়। প্যারিসে যাওয়ার আগে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “আমার মনঃসংযোগ এবং দৃষ্টি ঠিক রাখতে এই অনুশীলন প্রচণ্ড সাহায্য করেছে। যোগাসন এবং ধ্যান আমার অন্যতম শক্তি।”
আরও একটি জিনিস সরবজ্যোতের পছন্দের। গাড়ি এবং গতি। জোরে গাড়ি চালাতে ভালবাসেন। তার চরিত্রের সঙ্গে একেবারেই তা বিপরীত বলে খোঁচা দেন ঘনিষ্ঠেরাই। সম্প্রতি পরিবারের জন্য একটি এসইউভি কিনেছেন সরবজ্যোৎ। অলিম্পিক্স থেকে ফেরার পর নিজেকে একটি স্পোর্টস কার উপহার দিতে চান। মাঝেমাঝেই নয়ডার বুদ্ধ আন্তর্জাতিক সার্কিটে গিয়ে গাড়ি চালিয়ে গতির ঝড় তুলতে দেখা যায় তাঁকে। নিয়মিত ফরমুলা ওয়ান রেস দেখেন। নিজেই বলেছেন, “গতি প্রচণ্ড ভালবাসি। ছোটবেলা থেকে রেসিং কার পছন্দ করতাম। শুটিং তো অনেক পরে এসেছে।”
গত বছর ভোপাল বিশ্বকাপের সময় কাঁধে চোট পেয়েছিলেন। সেই নিয়েই কয়েকটি প্রতিযোগিতা খেলেছিলেন। কিন্তু চোট বাড়তে থাকায় একটা সময় থামতে হয়। বিশ্ব ইউনিভার্সিটি গেমসে অংশ নিতে পারেননি। এশিয়ান গেমসেও চিন্তায় ফেলেছিল সেই চোট। সরবজ্যোৎ মানেন, এখনও পর্যন্ত তাঁর কেরিয়ারে ওটাই সবচেয়ে খারাপ সময়। তবে অলিম্পিক্সের প্রস্তুতি তার প্রভাব পড়েনি।