টিমবাসের পথে ধোনি।—ছবি পিটিআই।
২০০২ সাল। আমি তখন বাংলার কোচ। বিজয় হজারে ট্রফিতে ঝাড়খণ্ডের সঙ্গে ম্যাচ ছিল আগরতলা পলিটেকনিক মাঠে।
ঝাড়খণ্ড আগে ব্যাট করেছিল। ওদের যে দুই ওপেনার এল তাদের একজনকে দেখতে নায়কের মতো। সেই ছেলেটাই সকলের নজর কেড়ে নিল। বড় বড় সব শট মারছিল।
সাইটস্ক্রিনের পিছনে গিয়ে বোলার রণদেব বসুকে বললাম, ‘‘ছেলেটার গায়ে প্রবল শক্তি। ওকে আস্তে বল কর। মারার জায়গা দিস না।’’ তার পরেও আমাকে তাজ্জব করে দিয়েছিল ঝাড়খণ্ডের সেই ওপেনার। কম গতির একটি বলে এমন অদ্ভুত ভাবে ব্যাট চালাল যে, বলটা সোজা মিডউইকেটের উপর দিয়ে গিয়ে বাউন্ডারি হল। পরে জেনেছিলাম এটাই ছেলেটার ‘হেলিকপ্টার শট’।
ঝাড়খণ্ডের কোচ কাজল দাস আমাদের সময়ে পূর্বাঞ্চলের হয়ে খেলত। ওর থেকেই জানলাম, ছেলেটার নাম মহেন্দ্র সিংহ ধোনি। সেই আমার প্রথম ধোনি-দর্শন।
উইকেটের সামনে ও পিছনে ধোনির টেকনিকের অনেক সমালোচনা শুনেছি। ধোনি সমালোচনায় পাত্তা না দিয়ে নিজের সহজাত প্রতিভা নিয়ে সাফল্যের সঙ্গে খেলে গিয়েছে। ভারতের হয়ে সীমিত ওভারের ক্রিকেটে এমন সব দর্শনীয় শট মেরে কঠিন পরিস্থিতিতে ম্যাচ জিতিয়েছে যে, বলাই যায়, নতুন সহস্রাব্দে এ দেশের ক্রিকেটে দু’টো অধ্যায়। ধোনির আগের ভারতীয় দল। আর ধোনির সময়ের ভারতীয় দল।
ধোনির সাফল্যের একটা বড় কারণ দুরন্ত অ্যাথলিটদের মতো ফিটনেস। যা ওর রান নেওয়ার সময়ে বোঝা যেত। যদিও মহান অনিশ্চয়তার খেলা ক্রিকেটের স্কোরবোর্ডে লেখা থাকবে, ধোনি তাঁর প্রথম ও শেষ ম্যাচে রান আউট হয়েই প্যাভিলিয়নে ফিরেছিল।
ভারতীয় ক্রিকেট ধোনির মতো ফিনিশার দেখেনি। বল আর রান গুণে খেলত। জানত, কখন খেলাটা শেষ করতে হবে।
ব্যাটিংয়ের মতোই উইকেটকিপিংয়েও নিজস্ব ভঙ্গিতে চলেছে ধোনি। আমাদের ব্যাকরণ বলে, স্টাম্পিংয়ের ক্ষেত্রে বল হাতে আসতে দিতে হবে। কিন্তু ধোনি স্পিনারের বলে কিপিং করার সময়ে বল একটু আগে ধরে সেকেন্ডের ভগ্নাংশে স্টাম্পিং করত। এটা নকল করতে যাওয়া খুব কঠিন কাজ। তাৎক্ষণিক বুদ্ধি, ক্ষিপ্রতা ও ফিটনেস কাজে লাগিয়েই এটা করতে পারত ও। যে কারণে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ওর স্টাম্পিংয়ের সংখ্যা ১২৩। অন্যেরা একশোর ধারেকাছেও পৌঁছতে পারেনি।
উইকেটকিপার ধোনির আর একটা বিশেষত্ব হল, উইকেটের দিকে না তাকিয়ে ‘ব্যাক থ্রো’। সে ক্ষেত্রে সেকেন্ডের ভগ্নাংশে ও ঠিক করে নিতে পারত কোন প্রান্তে বলটা ছুড়বে। এ ছাড়াও মাঠের যে কোনও প্রান্ত থেকে উড়ে আসা বল না ধরে চাটা মেরে উইকেট ভেঙে দিত। যা আমরা ভাবতেও পারতাম না। পেসারদের বলে অফসাইড বা লেগসাইডে বল ওয়াইড হলে ধোনি খুব বেশি ডাইভ দিত না। আসলে ওর ফিটনেস এতটাই ভাল ছিল যে দ্রুত বলের লাইনে যেতে পারত। অধিনায়ক ধোনির সাফল্যের পরিসংখ্যান ওর হয়ে কথা বলবে। আর আমি উল্লেখ করব ওর সাহস, ফিল্ডিং সাজানোর কথা। ২০০৭-এ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ফাইনালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে শেষ ওভারে যোগিন্দর শর্মাকে বল করতে ডাকার সাহসটা ভাবুন কিংবা শ্রীসন্তকে বৃত্তের মধ্যে দাঁড় করানো মিসবাহ-উল-হকের ক্যাচ ধরার জন্য। ২০১১ বিশ্বকাপের ফাইনালে চাপের মুখে ব্যাটিং অর্ডার বদলে যুবরাজের আগে ওর ব্যাট করতে নামার সিদ্ধান্তটাই বা কে ভুলতে পারবে!
মহেন্দ্র সিংহ ধোনি আসলে অন্য রকম। সব দিক দিয়েই!