নায়ক: সতীর্থ গঞ্জালেসের সঙ্গে উৎসব পাপার (বাঁ দিকে)। এআইএফএফ
শনিবার সকাল থেকেই মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েছিল। প্রথমে অশোক চট্টোপাধ্যায়ের প্রয়াণের খবর। তার পরে মোহনবাগান সমর্থক রিঙ্কু দাসের মর্মান্তিক আত্মহত্যার খবর। বিকেলে চার্চিল ব্রাদার্সের বিরুদ্ধে ফ্রান গঞ্জালেসদের দুরন্ত জয় কিছুটা হলেও স্বস্তি দিল।
আই লিগের প্রথম পর্বে চার্চিলের বিরুদ্ধে ঘরের মাঠে ২-৪ হেরেছিল মোহনবাগান। তাই শনিবার গোয়ায় ম্যাচ শুরুর আগে অনেক সবুজ-মেরুন সমর্থকই স্নায়ুচাপে ভুগছিলেন। আমার কিন্তু মোহনবাগানের জয় নিয়ে কোনও সংশয় ছিল না। আমি মনে করি, চার্চিলের বিরুদ্ধে প্রথম পর্বের হারটা ছিল দুর্ঘটনা। মোহনবাগান যে রকম ছন্দে রয়েছে, তাতে চার্চিলের পক্ষে আটকানো সম্ভব নয়।
আই লিগে এই মরসুমে দ্বিতীয় ম্যাচে চার্চিলের মুখোমুখি হয়েছিল মোহনবাগান। শুরুর দিকে সব দলই একটু নড়বড়ে থাকে। ছন্দে ফিরতে সময় লাগে। মোহনবাগানের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ওই ম্যাচে চার্চিলের স্ট্রাইকার উইলিস প্লাজ়াকে আটকানোর বিশেষ কোনও রণনীতি কিবু ভিকুনার ছিল বলে মনে হয়নি। শুধু তাই নয়। চার্চিলকে সে দিন একটু বাড়তি গুরুত্ব দিয়েছিল মোহনবাগান। তা ছাড়া পাপা বাবাকর জিওয়ারার মতো ফুটবলার তখনও যোগ দেয়নি দলে। এ বার আর সেই ভুল করেননি স্পেনীয় কোচ।
শনিবার প্লাজ়া যত বার বল ধরেছে, মোহনবাগানের দুই-তিন জন ঘিরে ধরেছে। এই চক্রব্যূহ ভেঙে আর বেরোতে পারেনি ত্রিনিদাদ ও টোব্যাগো স্ট্রাইকার। চার্চিল প্রচণ্ড গতিতে প্রতি-আক্রমণ নির্ভর ফুটবল খেলে। প্রথম পর্বের ম্যাচে মোহনবাগান কোচও গতিকে অস্ত্র করেছিলেন। শুরু থেকেই মোহনবাগানের ফুটবলারদের লক্ষ্য ছিল, নিজেদের মধ্যে যত বেশি সম্ভব পাস খেলে বিপক্ষের ছন্দ নষ্ট করে দেওয়া। যাতে প্রতি-আক্রমণে উঠতেই না পারে চার্চিলের ফুটবলারেরা। সুস্থ হয়ে ওঠা ড্যানিয়েলকে প্রথম দলে ফেরানোটাও দারুণ সিদ্ধান্ত কিবুর। গঞ্জালেস নিজের জায়গায় ফিরে আসায় শক্তি বাড়ে মোহনবাগান মাঝমাঠের। প্লাজ়াকে আটকানোর বাড়তি দায়িত্ব গঞ্জালেসের উপরেই দিয়েছিলেন সবুজ-মেরুনের কোচ। কিবুর চালেই খেলা থেকে হারিয়ে যায় চার্চিল। সব দায়িত্বই অসাধারণ ভাবে পালন করল ও। এই কারণেই জাতীয় দলের কোচ ইগর স্তিমাচ ম্যাচের সেরা বাছলেন গঞ্জালেসকে।
মোহনবাগানের দুরন্ত সাফল্যের আরও একটা কারণ দলগত সংহতি। দল যখন আক্রমণে উঠছে, ডিফেন্ডারেরাও বিপক্ষের পেনাল্টি বক্সে পৌঁছে যাচ্ছে। আবার চার্চিলের আক্রমণের সময় সকলে নেমে আসছে রক্ষণ শক্তিশালী করতে। ম্যাচের ছ’মিনিটে পাপার গোলটার কথা মনে করুন। বেইতিয়ার ফ্রি-কিক থেকে উড়ে আসা বল গঞ্জালেস হেডে নামিয়ে দেয়। ঠান্ডা মাথায় তা গোলে ঠেলে দেয় পাপা।
৫১ মিনিটে সুহের ভি পি চার্চিলের পেনাল্টি বক্সে ঢুকে সময় নষ্ট না করে ডান পায়ের জোরালো শটে গোল করল। কয়েক মিনিট পরে তৃতীয় গোল কোমরন তুর্সুনভের। বাঁ-প্রান্ত থেকে বল ভাসিয়ে দিয়েছিল নংদোম্বা নওরেম। চার্চিলের ডিফেন্ডারদের মধ্যে থেকে ছিটকে বেরিয়ে এসে অসাধারণ ভলিতে গোল করল তুর্সুনভ। কে বলবে পাপা ও তুর্সুনভ আই লিগের মাঝপথে দলে যোগ দিয়েছে? মনে হবে যেন দীর্ঘ দিন ধরে ওরা সবুজ-মেরুন জার্সি গায়েই খেলছে। তেমনই অসাধারণ খেলছে শেখ সাহিল এবং সুহের।
মোহনবাগানের এই দলটার সব চেয়ে ইতিবাচক দিক হল, ফুটবলারদের বলে দিতে হয় না, কার কী দায়িত্ব। নিজেদের মধ্যে অসাধারণ বোঝাপড়া। ফলে কোচের কাজটা অনেক সহজ হয়ে যায়। কিবু অনেক বেশি বিপক্ষকে নিয়ে ভাবতে পারেন। মনঃসংযোগ করতে পারেন রণনীতি তৈরিতে। ফুটবলারদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য বাড়তি পরিশ্রমও করতে হয় না। এই ম্যাচে রণকৌশল বদলে নেমেছিলেন কিবু। ম্যাচের চরিত্র অনুযায়ী দ্রুত রণকৌশল পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিতেও দক্ষ কিবু।
চার্চিলের বিরুদ্ধে দুরন্ত জয় দেখে আমার ২০০১-০২ মরসুমে জাতীয় লিগে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। আমি তখন মোহনবাগানের কোচ। এই চার্চিলের বিরুদ্ধে ম্যাচ ছিল গোয়াতেই। রুদ্ধশ্বাস ম্যাচে সালিউয়ের গোলে জিতেছিলাম। শেষের কুড়ি মিনিট একটাই লক্ষ্য ছিল, চার্চিলকে কোনও ভাবেই গোল করতে না দেওয়া। শেষ পর্যন্ত আমরা সফল হয়েছিলাম। গঞ্জালেসরা যেন শনিবার আই লিগের শেষ ম্যাচ খেলতেই নেমেছিল। মনে হচ্ছিল যেন এই ম্যাচের উপরেই ওদের আই লিগের ভাগ্য নির্ভর করছে। এই মানসিকতা নিয়ে যে দলের ফুটবলারেরা খেলে, তাদের আটকাবে কে? মোহনবাগানই আই লিগে চ্যাম্পিয়ন হবে।
চার্চিল ব্রাদার্স: শিবাজি পটেল, লালগৌলেন হাংশিং, রাদানফ আবু বকর, পনিফ ভাস, জোভেল মার্টিন্স, ইমানুয়েল পেদ্রো, গ্লেন মার্টিন্স, কুয়ান গোমস (কালিফ আল হাসান), দাওসা সিসে (বিনিল পূজারি), মাপুইয়া (ইজরায়েল গুরুং) ও উইলিস প্লাজ়া।
মোহনবাগান: শঙ্কর রায়, আশুতোষ মেহতা, ফ্রান মোরান্তে, ড্যানিয়েল সাইরাস (কোমরন তুর্সনভ), গুরজিন্দর কুমার, সুহের ভি পি (শুভ ঘোষ), ফ্রান গঞ্জালেস, শেখ সাহিল, নংদম্বা নওরেম (রোমারিয়ো জেসুরাজ), জোসেবা বেইতিয়া ও পাপা বাবাকর জিওয়ারা।