বিষণ্ণ: ২৫ মিটার পিস্তলের ফাইনালে চতুর্থ স্থানেই থামতে হল মনুকে। ছবি: পিটিআই।
মহেন্দ্র সিংহ ধোনির বিশ্বকাপজয়ী দলের সেই মনোবিদ বিশেষজ্ঞকে মনে আছে? প্যাডি আপটন। অলিম্পিক্সেও তাঁর টোটকার দিকে তাকিয়ে থাকবে ভারতীয় দল।
শনিবার একদিকে মনু ভাকেরের পদকের যাত্রা শেষ হল। খুব কাছাকাছি এসেও ২৫ মিটার এয়ার পিস্তলের ইভেন্টে চতুর্থ হলেন মনু। ইনভ্যািলড্সে দীপিকা কুমারী কোয়ার্টার ফাইনালে কোরিয়ার কাছে হারলেন। কিন্তু শনিবারের সে সব ফল নিয়ে মন খারাপ করে বসে থাকার উপায় কোথায় ভারতীয় ক্রীড়াপ্রেমীদের? রবিবারের তিন এসপার-ওসপার দ্বৈরথের জন্য মন শক্ত করে তৈরি হতে হবে যে!
আর তিনটি দ্বৈরথের অন্তত দু’টিতে নেপথ্যে ভূমিকা থাকছে এমন একজনের যিনি অতীতে ক্রিকেট দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। রাহুল দ্রাবিড়ের খুব প্রিয়। দক্ষিণ আফ্রিকার প্যাডি আপটন, যিনি গ্যারি কার্স্টেনের সহকারী হিসেবে কাজ করে গিয়েছেন। ধোনির বিশ্বকাপজয়ী দলের অন্যতম মস্তিষ্ক ছিলেন তিনি। মেন্টাল কন্ডিশনিং কোচ হিসেবে সারা পৃথিবীর নানা দলের সঙ্গে থেকেছেন আপটন। অলিম্পিক্সে ভারতীয় হকি দলের সঙ্গে কাজ করছেন। লক্ষ্য সেনের সঙ্গেও আছেন তিনি। রবিবার লক্ষ্য সেমিফাইনাল খেলতে নামছেন ভিক্টর অ্যাক্সেলসেনের বিরুদ্ধে। ডেনমার্কের তারকা এই মুহূর্তে বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়দের এক জন। গত বারের অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন। ২০২২ টোকিয়োয় বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। লক্ষ্যের বিরুদ্ধে রেকর্ড শুনলে অনেকে আঁতকে উঠতে পারেন, ৭-১! কিন্তু লক্ষ্য নামছেন প্যাডির বিশেষ টোটকা সঙ্গে নিয়ে। আগে থেকে অন্তত তিনি ম্যাচ হেরে বসে থাকবেন না, লিখে ফেলা যায়।
জায়ান্ট কিলার হিসেবে পরিচিত রয়েছে লক্ষ্যর। অতীতে অনেক বড় বড় নামকে ঘায়েল করেছেন। এই অলিম্পিক্সেই অল ইংল্যান্ড ব্যাডমিন্টনে চ্যাম্পিয়ন জোনাথন ক্রিস্টি ও চৌ তিয়েন চেনকে হারিয়েছেন তিনি। দু’জনেই তো র্যাঙ্কিং ও ব্যাডমিন্টন রেকর্ডে তাঁর থেকে এগিয়ে ছিলেন। এ দিন কেউ একটা বলছিলেন, চৌ-কে যাঁরা কোয়ার্টার ফাইনালে হারায়, সে নাকি অলিম্পিক্সে সোনা জেতে। রিয়ো আর টোকিয়ো দু’বারই নাকি সেরকম হয়েছে। পোর্ত দে লা শ্যাপেলের কোর্টে এ সব তুকতাক কাজ করবে কি না, জানা নেই। তবে লক্ষ্য বা তাঁর গুরু প্রকাশ পাড়ুকোন নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন, অ্যাক্সেলসেন এ বছর নিজের সেরা ছন্দে নেই। র্যাঙ্কিংয়ে অনেক পিছিয়ে থাকা খেলোয়াড়দের কাছে হেরেছেন। চোট-আঘাতের সমস্যাতেও ভুগেছেন। লা শ্যাপেল এরিনার দ্রুতগামী কোর্টে লক্ষ্য যদি আগ্রাসী খেলা ধরে রাখতে পারেন, প্যারিস দর্শনে বেরনোর মতো তুড়ি মেরে জিততে পারবেন না অ্যাক্সেলসেন। তাঁর মতো অলরাউন্ড খেলোয়াড় যে কোনও সময় জিততে পারেন। কিন্তু প্যাডি ও পাড়ুকোনের টোটকায় বলিয়ান লক্ষ্যও ছেড়ে কথা বলবেন না।
রবিবার দুপুরেই হকিতে ভারত খেলবে গ্রেট ব্রিটেনের বিরুদ্ধে। হরমনপ্রীত, সৃজেশদের মানসিক ভাবে চাঙ্গা রাখা ব্যক্তিও আপটন। শুরুতে খুব আত্মবিশ্বাসী দেখাচ্ছিল না হকি দলকে। কিন্তু অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে সকলকে চমকে দিয়েছে তারা। হতেই পারে দলকে চাঙ্গা করার নেপথ্যে আপটনের দাওয়াই রয়েছে। এ ছাড়াও বক্সিংয়ে নামছেন লাভলিনা বরগোঁহাই। জিতলে লক্ষ্যের মতো তাঁরও পদক নিশ্চিত।
ভারতীয় ক্রীড়াপ্রেমীরা তাদের এ বারের অলিম্পিক্সের হার্টথ্রব যদিও পেয়ে গিয়েছে। মনু ভাকের। ২৫ মিটার পিস্তলে পদকের কাছাকাছি এসেও অল্পের জন্য লক্ষ্যভ্রষ্ট হলেন হরিয়ানার ২২ বছরের শুটার। চতুর্থ হয়ে শেষ করলেন। কিন্তু তাতে কী, মনু ভাকেরের আসল পদক হচ্ছে, তিনি ভারতের ঘরে-ঘরে শুটিংকে পৌঁছে দিলেন।
স্বাধীন ভারতে প্রথম প্রতিযোগী হিসেবে একই অলিম্পিক্স থেকে দুটি পদক আনার কৃতিত্ব অর্জন করেছেন মনু। অভিনব বিন্দ্রা পর্যন্ত শনিবার টুইটারে লিখেছেন, ‘‘মনু, তুমি গোটা দেশকে গর্বিত করেছ। অসামান্য এই প্রাপ্তিকে উঠে দাঁড়িয়ে কুর্নিশ জানাই। তৃতীয় পদকটিও জিতে নিতে পারলে আরও অসাধারণ এক কীর্তি হতে পারত। কিন্তু যা তুমি করে দেখিয়েছ, সেটা ইতিমধ্যেই ইতিহাস। পরিশ্রম আর দায়বদ্ধতা নিয়ে কেউ লেগে থাকলে কী করতে পারে, তার জলজ্যান্ত উদাহরণ তুমি।’’ ভারতের কিংবদন্তি শুটার শাতোরুতে পড়ে থেকে মনু, সরবজ্যোৎদের সারাক্ষণ উৎসাহ দিয়ে গিয়েছেন। তিনি যে স্বপ্নের যাত্রা শুরু করেছিলেন, তা প্যারিসে গতি পেল দেখে অন্য রকম আনন্দই পাওয়ার কথা।
কয়েকটি গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট না হলেই হয়তো পদক জিতে পারতেন তিনি। এমনকি একটা সময় রুপোর দৌড়েও ছিলেন। মনুকে জিজ্ঞেস করা হয়, তিনি চাপে পড়ে গিয়েছিলেন কি না? জোড়া পদকজয়ী বলে দিলেন, ‘‘আমি তা মনে করি না। আমার কোচ প্রত্যেক ইভেন্ট শেষেই আমাকে মনে করিয়ে দিত, ইতিহাস এখন ইতিহাস। সব ভুলে যাও। সামনের দিকে তাকাও। পরের ইভেন্টে মন দাও। তাই চাপের প্রশ্নই ছিল না।’’
বারবার করে কৃতিত্ব দিলেন যশপাল রানার। কোথাও যেন মনুর কোচও জিতে গেলেন। একটা সময় এই রানার সঙ্গেই ঝামেলা করে সম্পর্ক ত্যাগ করেন মনু। অন্য কোচের অধীনে ট্রেনিং করতেন। যশপালের কাছে ফিরতেই ভাগ্যও ফেরে। টোকিয়োয় পিস্তলে গোলযোগ হয়ে কাঁদতে কাঁদতে বিদায় নেওয়ার পরে প্যারিসে স্বপ্নপূরণ। আজ পদকের দিন নয়, তবু যেন বিজয়ী মনু। বললেন, ‘‘যশপাল স্যর আমাকে বাস্তবের মাটিতে রেখে দেন সব সময়। তৃতীয় পদক জেতার কোনও চাপ ছিল না। শুধু মনোনিবেশ করছিলাম কী ভাবে নিজের সেরাটা দেওয়া যায়।’’
তিনি প্যারিসে এসেছিলেন টোকিয়োর পরাজিত হিসেবে। ফিরছেন প্যারিসের বিজয়িনী হিসেবে। সাফল্য কতটা পাল্টে দিতে পারে একজন ক্রীড়াবিদের মনন, তা টের পাওয়া গেল দ্রুতই। যখন বলে দিলেন, ‘‘চতুর্থ স্থানটা কোনও উচ্ছ্বসিত হওয়ার মতো স্থানই নয়। কিন্তু পরের বার বলেও একটা কথা আছে। আমি আরও ভাল করতে চাই।’’ যোগ করলেন, ‘‘আমার কাছে এখন দুটো মেডেল আছে। সঙ্গে থাকছে অনেক বাড়তি প্রেরণা। পরের বারের জন্য অনেক বেশি তৈরি হয়ে আসতে পারব।’’ মনে হল, ২০২৪ থেকেই তাক করা শুরু করে দিলেন ২০২৮-কে। এবং, তৃতীয় পদক হারানোর দিনেই ময়নাতদন্ত শুরু করে দিয়েছেন, কোথায় ভুল হল। ‘‘ম্যাচটা মিশ্র ধরনের খেললাম। কখনও ভাল, কখনও খারাপ। ধারাবাহিকতা দরকার ছিল,’’ বললেন তিনি। শেষের দিকে কিছুটা কি স্নায়ুর চাপ তৈরি হয়নি? যা চেষ্টা করছিলেন, তা কি হচ্ছিল? এ বার মনু বললেন, ‘‘জানি না শেষে গিয়ে কী হল। তবে এটা ঠিক, যেমন করতে চাইছিলাম, তা হচ্ছিল না।’’ সঙ্গে সঙ্গে মনে করিয়ে দিতে ভুললেন না, ‘‘তবে আমি খুব তাড়াতাড়ি ভুলগুলো সংশোধন করে ফেলতে চাই।’’
প্যারিস তাঁকে অন্য মনু ভাকের করে দেশে ফেরত পাঠাচ্ছে। যিনি টোকিয়োর মতো কাঁদতে আসবেন না। বিজয়ের হাসি হাসতে পিস্তল হাতে নামবেন।