খেলোয়াড়-অধিনায়ক-প্রশাসক। তিন ভূমিকাতেই তাঁকে দেখেছে ক্রিকেট। ব্রিটিশ ভারতের ক্রিকেটে তিনি ছিলেন অন্যতম চর্চিত ও বিতর্কিত নাম। তিনি ভারতীয় ক্রিকেটের আর এক মহারাজ, মহারাজকুমার অব বিজিয়নগরম। বা, বিজয়নগরের মহারাজকুমার।
তাঁর সম্পূর্ণ পরিচয় লেফটেন্যান্ট কর্নেল স্যর বিজয় আনন্দ গজপতি রাজু। জন্ম, ১৯০৫-এর ২৮ ডিসেম্বর। বিজয়নগরের তৎকালীন দেশীয় রাজা পশুপতি বিজয় রাম গজপতি রাজুর মেজো ছেলে ছিলেন বিজয় আনন্দ। সেই সূত্রে ‘মহারাজকুমার’ উপাধি প্রাপ্তি।
১৯২২ সালে প্রয়াত হন পশুপতি বিজয় রাম। তার পরে সিংহাসনে বসেন তাঁর বড় ছেলে। মেজো ছেলে বিজয় আনন্দ বা ভিজ্জি চলে যান বারাণসী, তাঁদের পারিবারিক এস্টেটে। অজমেঢ়ের অভিজাত মেয়ো কলেজের পরে তাঁর উচ্চশিক্ষা ইংল্যান্ডের হেইলবেরি অ্যান্ড ইম্পেরিয়াল সার্ভিস কলেজে। বিয়ে করেছিলেন তৎকালীন কাশীপুর এস্টেটের তত্কালীন অন্যতম মালিকের বড় মেয়েকে।
ক্রিকেট ও টেনিসের পাশাপাশি ভিজ্জির শিকারের নেশাও ছিল। ১৯২৬ সালে তিনি দেশ বিদেশের ক্রিকেটারদের নিয়ে দল তৈরি করেন। সে দলে ছিলেন ব্রিটিশ ক্রিকেটাররাও। ১৯৩০-৩১ সালে এমসিসি ভারতসফর বাতিল করে রাজনৈতিক কারণে। তখন ভিজ্জি তাঁর দল নিয়ে ভারতের বিভিন্ন অংশে ও সাবেক সিংহলে ক্রিকেট সফরে যান।
ক্রিকেটমহলে প্রতিপত্তি কায়েম করার দৌড়ে ভিজির প্রতিপক্ষ ছিলেন পাতিয়ালার রাজপরিবার। তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড উইলিংডনের সঙ্গে সখ্যতা বাড়ান ভিজ্জি। সদ্য নির্মিত ফিরোজ শাহ কোটলায় একটি প্যাভিলিয়ন বানিয়ে নামকরণ করেন উইলিংডনের নামে। চেয়েছিলেন তাঁর নামে ঘরোয়া ক্রিকেটে একটি ট্রফি চালু করতে। কিন্তু সেখানে ‘রনজি ট্রফি’ চালু করে তাঁকে টেক্কা দেন পাতিয়ালার তৎকালীন মহারাজা।
১৯৩৬ সালে ইংল্যান্ড সফরে ভিজ্জি ভারতীয় দলের অধিনায়ক নির্বাচিত হন। কিন্তু এই নির্বাচন ঘিরে বিতর্ক ও প্রশ্ন ছিল। অভিযোগ, তিনি প্রতিপত্তি খাটিয়ে এই দায়িত্ব পান। ব্রিটেনের মাটিতে দলের বিপর্যয়ের পরে তাঁর যোগ্যতা নিয়ে আরও প্রশ্ন উঠে যায়। লালা অমরনাথ, বিজয় মার্চেন্ট, সি কে নায়ডুর মতো প্রথম সারির ক্রিকেটাররা তাঁর বিরুদ্ধে সরব হন।
অভিযোগ, ভিজ্জির ‘ষড়যন্ত্রে’ ইংল্যান্ডের মাটিতে সফরের প্রথম টেস্ট না খেলেই ফিরে আসেন লালা অমরনাথ। এই সিরিজে ভারতীয় দলের শোচনীয় পরাজয়ের পরে তৎকালীন ব্রিটিশ সম্রাট সপ্তম এডওয়ার্ডের কাছে নাইটহুডে সম্মানিত হন ভিজি। যদিও পরে ১৯৪৭ সালের জুলাইয়ে তিনি লর্ড মাউন্টব্যাটেনের কাছে চিঠিতে নাইটহুড অস্বীকার করেন। তিনিই একমাত্র ক্রিকেটার যাঁকে অবসরের আগেই নাইটহুডে সম্মানিত করা হয়।
মাত্র তিনটি টেস্ট খেলেছেন ভিজি। সংগ্রহ মোট ৩৩ রান। সর্বোচ্চ স্কোর অপরাজিত ১৯। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ৪৭ ম্যাচে তাঁর সংগ্রহ ছিল ১২২৮। উইকেট একটি। এর বাইরে আর ক্রিকেট খেলেননি তিনি। অবসরের পরে প্রায় কুড়ি বছর প্রায় খবরের আড়ালে ছিলেন ভিজ্জি। নতুন ভূমিকায় ফিরে আসেন পাঁচের দশকে।
১৯৫২ সালে তিনি বিসিসিআই-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। সে বছর লালা অমরনাথকে অধিনায়ক পদে ফিরিয়ে আনার পিছনে তাঁর ভূমিকা ছিল অগ্রণী। ১৯৫৪-১৯৫৭ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন বিসিসিআই-এর প্রেসিডেন্ট। প্রশাসক হিসেবে তিনি সার্বিক ভাবে কাজ করেছিলেন ক্রিকেটের স্বার্থে। খেলোয়াড়ের তুলনায় প্রশাসক হিসেবে ক্রিকেটে তাঁর ভূমিকা উজ্জ্বল। ১৯৫৮ সালে তিনি সম্মানিত হন পদ্মভূষণে।
মাঠের বাইরে রাজনীতিক এবং ক্রিকেট ধারাভাষ্যকার হিসেবেও তাঁকে দেখা গিয়েছে। কিন্তু এই দুই ভূমিকায় সফল হতে পারেননি বিজয়নগরের মহারাজকুমার। তাঁর সম্বন্ধে বলা হয়, শুধু ক্রিকেট সংগঠক হিসেবে কাজ করলেই অনেক বেশি উন্নতি করতেন। সফল ক্রিকেটার হওয়ার প্রতিভা তাঁর ছিল না, মত বিশেষজ্ঞদের। ১৯৬৫ সালের ২ ডিসেম্বর তিনি প্রয়াত হন।
ভিজ্জির ছেলে এ ভি বেঙ্কটেশ সিংহও ছয়ের দশকে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলেছেন। তবে বাইশ গজে তাঁরও সঙ্গী ছিল ব্যর্থতা। অন্ধ্র ও উত্তরপ্রদেশের হয়ে ৬ ইনিংসে তাঁর মোট সংগ্রহ ছিল মাত্র ১৮ রান। (ছবি: সোশ্যাল মিডিয়া)