(বাঁদিকে) বিজয় অমৃতরাজ এবং লিয়েন্ডার পেজ। —ফাইল চিত্র।
সম্মানিত হলেন বিজয় অমৃতরাজ। সম্মানিত হলেন লিয়েন্ডার পেজ। সম্মানিত হল ভারতীয় টেনিস। সম্মানিত করল ইন্টারন্যাশনাল টেনিস ফেডারেশন (আইটিএফ)। ভারতীয় টেনিসের দুই উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব জায়গা পেলেন ইন্টারন্যাশনাল টেনিস ‘হল অফ ফেম’-এ।
আইটিএফের সর্বোচ্চ সম্মান ‘হল অফ ফেম’। ২০২৪ সালে এই সম্মানের জন্য নির্বাচিত হয়েছেন মোট তিন জন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন অমৃতরাজ এবং লিয়েন্ডার। তৃতীয় জন ব্রিটিশ টেনিস সাংবাদিক এবং লেখক রিচার্ড ইভান্স।
এর আগে ভারতের কোনও টেনিস ব্যক্তিত্ব আইটিএফের এই সম্মান পাননি। প্রথম বারেই এক সঙ্গে দু’জন পাচ্ছেন। ভারতীয় টেনিসের দুই প্রজন্ম এক সঙ্গে গর্বিত করছেন দেশকে। এর আগে এশিয়ার কোনও পুরুষ টেনিস ব্যক্তিত্ব এই সম্মান পাননি। শুধু ২০১৯ সালে পেয়েছেন চিনের মহিলা খেলোয়াড় না লি।
বিশ্বের ২৮তম দেশ হিসাবে আইটিএফের ‘হল অফ ফেম’-এ জায়গা করে নিল ভারত। ২০২৪ সালের ২০ জুলাই আনুষ্ঠানিক ভাবে তাঁদের হাতে তুলে দেওয়া হবে এই সম্মান। উল্লেখ্য, ১৯৫৫ সাল থেকে দেওয়া হচ্ছে এই সম্মান। প্রতি বছর রোড আইল্যান্ডের নিউপোর্টের নির্দিষ্ট একটি হলে সম্মানিত করা হয় নির্বাচিত টেনিস ব্যক্তিত্বদের।
ভারতের পেশাদার টেনিসকে বিশ্বের কাছে পরিচিত করেছিলেন অমৃতরাজ। আর দেশের আধুনিক টেনিসকে বিশ্বের সামনে পেশ করেছেন লিয়েন্ডার। পেশাদার টেনিসে বড় সাফল্য বলতে সাধারণ ক্রীড়াপ্রেমীরা যা বোঝেন সেই গ্র্যান্ড স্ল্যাম সিঙ্গলস বা ট্যুর ফাইনাল খেতাব নেই অমৃতরাজ বা লিয়েন্ডারের। নেই অলিম্পিক্স সোনাও। তবু বিশ্ব টেনিসে নিজেদের একটা আলাদা জায়গা তৈরি করে নিয়েছেন তাঁরা। বিশ্বের তাবড় টেনিস ব্যক্তিত্বেরা শ্রদ্ধা, সম্ভ্রমের চোখেই দেখেন অমৃতরাজ এবং লিয়েন্ডারকে। তবু টেনিস বিশ্ব এক নামে চেনে তাঁদের। ভারত তথা এশিয়ার টেনিস বলতে বিশ্ব তাঁদের কথাই বোঝে।
টেনিস দুনিয়ায় ভারত বড় নাম নয়। প্রথম সারির দেশগুলোর মধ্যেও পড়ে না। তবু অমৃতরাজ এবং লিয়েন্ডার নিজেদের ব্যক্তিগত দক্ষতা, নৈপুণ্যে আলাদা পরিচিতি তৈরি করতে পেরেছিলেন। সমসাময়িক প্রতিপক্ষদের ভাবিয়ে তুলেছেন কোর্টের লড়াইয়ে। তাঁদের হার না মানা টেনিসের সামনে বার বার হার মেনেছে ক্রমতালিকার আত্মবিশ্বাস।
২৩ বছরের টেনিসজীবনের পরও অমৃতরাজ নিজেকে টেনিসের সঙ্গেই যুক্ত রেখেছিলেন। অ্যাকাডেমি তৈরি করে ভারতের টেনিসকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছেন। যে অ্যাকাডেমির ফসল লিয়েন্ডার। সেই অর্থে গুরু-শিষ্যকে এক সঙ্গে সম্মানিত করছে আইটিএফ।
আন্তর্জাতিক টেনিসে অমৃতরাজকে সাফল্য বা পরিসংখ্যানের নিরিখে মাপতে গেলে ভুল হবে। প্রতিভা এবং দক্ষতার বিচারে অনেক বেশি ঝকঝকে হওয়া উচিত ছিল তাঁর টেনিসজীবন। ১৫টি খেতাব জিতেছিলেন অমৃতরাজ। প্রথম ভারতীয় হিসাবে টেনিসকে পেশা হিসাবে নিয়েছিলেন। সে সময় যা ছিল এক সাহসী সিদ্ধান্ত। ১৯৮০ সালে তিনি ছিলেন বিশ্বের ১৮ নম্বর সিঙ্গলস খেলোয়াড়। এখনও পর্যন্ত ভারতীয় খেলোয়াড়দের মধ্যে সেটাই সিঙ্গলসের সেরা র্যাঙ্কিং।
ভারতকে দু’বার ডেভিস কাপ ফাইনালেও তুলেছিলেন তিনি। নিজের সেরা সময় অমৃতরাজ শুধু ভারতের নয়, বিশ্বমঞ্চে এশীয় টেনিসের প্রতিনিধি ছিলেন। অমৃতরাজ কখনও গ্র্যান্ড স্ল্যাম সিঙ্গলসের সেমিফাইনাল খেলেননি। তবে দু’বার করে উইম্বলডন এবং ইউএস ওপেনের কোয়ার্টার ফাইনাল খেলেছেন। ডাবলসে উইম্বলডন সেমিফাইনাল খেলার অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁর। গ্র্যান্ড স্লামে সাফল্য না থাকলেও নিজের সময় টেনিস বিশ্বে অমৃতরাজ ছিলেন সমীহ জাগানো নাম।
অবসরজীবনে অ্যাকাডেমি পরিচালনার পাশাপাশি বিশ্ব টেনিসের উন্নতির জন্যও একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন অমৃতরাজ। ১৯৮৯ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত ছিলেন এটিপি (পেশাদার পুরুষ টেনিস খেলোয়াড়দের সংগঠন) সভাপতি। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত ছিলেন এটিপি-র বোর্ড সদস্য।
অমৃতরাজের দেখানো পথ ধরেই উত্থান লিয়েন্ডারের। আন্তর্জাতিক টেনিসে সফলতম ভারতীয়। তাঁর সাফল্যের কাছাকাছি আর কোনও নাম নেই। সিঙ্গলসে তাঁর সেরা সাফল্য ১৯৯৬ সালের আটলান্টা অলিম্পিক্সে ব্রোঞ্জ পদক জয়। ডাবলসে এক সময় বিশ্বকে শাসন করেছে তাঁর র্যাকেট। এটিপি ক্রমতালিকায় এক নম্বরও হয়েছেন।
তিন দশক পেশাদার টেনিস খেলেছেন লিয়েন্ডার। ১৮ বছরে শুরু করেছিলেন। অবসর নিয়েছেন ৪৮ বছর বয়সে। ৩০ বছরের টেনিসজীবনে অলিম্পিক্স পদক ছাড়া কী দিয়েছেন লিয়েন্ডার? আটটি গ্র্যান্ড স্ল্যাম ডাবলস খেতাব। ১০টি গ্র্যান্ড স্ল্যাম মিক্সড ডাবলস খেতাব। অর্থাৎ, কলকাতার বেকবাগান রো-এ বেড়ে ওঠা লিয়েন্ডারের ঝুলিতে রয়েছে ১৮টি গ্র্যান্ড স্ল্যাম। ভারতের কোনও টেনিস খেলোয়াড় ১৮টি গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিতেছেন, বিশ্বাস করা হয়তো কঠিন সাধারণ ক্রীড়াপ্রেমীদের কাছে। কারণ এত সংখ্যক গ্র্যান্ড স্ল্যামের কথা বললে যে নামগুলি ভেসে ওঠে, তাঁরা কেউ ভারতের নন। কিন্তু লিয়েন্ডার সেটাই সম্ভব করেছেন। এ ছাড়াও লিয়েন্ডার অলিম্পিক্স ডাবলসের সেমিফাইনাল খেলেছেন। চার বার ট্যুর ফাইনাল খেলেছেন।
ডেভিস কাপ মানেই অন্য লিয়েন্ডার। সেখানে বিশ্বক্রমতালিকা শুকনো পরিসংখ্যান ছাড়া কিছুই নয়। ডাবলস তো বটেই সিঙ্গলসেও দেশের জন্য অপ্রতিরোধ্য ছিলেন লিয়েন্ডার। যে গোরান ইভানোভিচের হাতে পড়ে নোভাক জোকোভিচ ২৪টি গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিতেছেন, সেই ইভানোভিচকেও হার মানতে হয়েছিল লিয়েন্ডারের কাছে। ইভানোভিচ লিয়েন্ডারের সিঙ্গলস টেনিসজীবনের উজ্জ্বলতম প্রতিপক্ষদের এক জন। অলিম্পিক্সে লিয়েন্ডারকে হারাতে বেগ পেতে হয়েছিল আন্দ্রে আগাসির মতো খেলোয়াড়কেও। জীবনে মাত্র একটি খেতাব জিতলেও পেশাদার সিঙ্গলসে বার বার চমক দেখিয়েছেন লিয়েন্ডার। রজার ফেডেরারকে তাঁর বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছিল পাঁচ সেট। লিয়েন্ডারের কাছে হারতে হয়েছিল পিট সাম্প্রাসকে।
পুরুষদের ডাবলসে বিশ্বের সর্বকালের অন্যতম সেরা লিয়েন্ডারকে এমনি এমনি বলেন না টেনিস বিশেষজ্ঞেরা। লিয়েন্ডার অর্জন করেছেন এই সম্মান। নিজের দক্ষতায়, যোগ্যতায়। আধুনিক পাওয়ার টেনিসের সঙ্গে সমানে সমানে পাল্লা দিয়েছে লিয়েন্ডারের স্কিল। ভারতীয় টেনিসকে লিয়েন্ডার নিয়ে গিয়েছেন নতুন উচ্চতায়। যে উচ্চতায় পৌঁছলে গ্র্যান্ড স্লামের স্বাদ পাওয়া যায়। হোক না ডাবলস বা মিক্সড ডাবলস, গ্র্যান্ড স্ল্যাম তো গ্র্যান্ড স্ল্যামই।
টেনিস কোর্টে কখনও জুটি বেধে লড়াই করেননি অমৃতরাজ এবং লিয়েন্ডার। তাঁরা ভারতীয় টেনিসের ভিন্ন প্রজন্মের প্রতিনিধি। তাঁরা জুটি বাধলেন কোর্টের বাইরে। টেনিস দুনিয়ার সব থেকে মূল্যবান সম্মান জিতে নিলেন এক সঙ্গে। জুটি বাধলেও আসলে জুটি নয়! অমৃতরাজ এবং লিয়েন্ডার ‘হল অফ ফেম’-এ জায়গা পাচ্ছেন ভিন্ন বিভাগে। ব্যক্তিগত ভাবে। অমৃতরাজ সম্মানিত হচ্ছেন টেনিসে সার্বিক অবদানের জন্য। আর লিয়েন্ডার নির্বাচিত হয়েছেন খেলোয়াড় বিভাগে।