স্টিভ স্মিথকে নিয়ে এত দিনে অনেক কথাই বলা হয়েছে। বিশ্বের সেরা ব্যাটসম্যান। ডন ব্র্যাডম্যানের পরে সবার সেরা। এজবাস্টনে জোড়া সেঞ্চুরি দেখার পরে তাঁর দলের কোচ জাস্টিন ল্যাঙ্গারের চোখে অন্য কিছু ধরা পড়েছে। অ্যাশেজে নাটকীয় ভাবে ১-০ এগিয়ে যাওয়ার পরে স্মিথকে নিয়ে ল্যাঙ্গার বলছেন, ‘‘নেটে ওর দিকে বল ছুড়তে ছুড়তে কখনও মনেই হবে না যে, স্মিথকে আউট করা সম্ভব। আমার মনে হয় না এ রকম কোনও ব্যাটসম্যান বিশ্বে আর কেউ আছে!’’
প্রথম টেস্টে ইংল্যান্ডকে ২৫১ রানে চূর্ণ করে সকলকে চমকে দিয়েছে অস্ট্রেলিয়া। আর সেই জয়ের নায়ক স্মিথের যেন পুনর্জন্ম হয়েছে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে। বল-বিকৃতির অভিশপ্ত অধ্যায়কে পিছনে ফেলে বিশ্বের প্রথম দুই সেরা ব্যাটসম্যানের লড়াইয়ে প্রত্যাবর্তন ঘটেছে তাঁর। তিনি না বিরাট কোহালি? কে এক নম্বর? এই প্রশ্ন নিয়ে উত্তাল হয়েছে ক্রিকেট। ওয়ান ডে-তে অবিশ্বাস্য ৬০-এর কাছাকাছি গড় কোহালির। আবার স্মিথের টেস্ট গড় ৬০-এর উপরে। তর্ককে উস্কে দিয়ে জোড়া সেঞ্চুরি করে স্মিথ প্রমাণ করে দিয়েছেন, রজার ফেডেরার বনাম রাফায়েল নাদালের মতোই তাঁর সঙ্গে বিরাটের দ্বৈরথও চলবে। ল্যাঙ্গারকেও বিভ্রান্ত দেখাচ্ছে। এজবাস্টনে জিতে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে এক বার বললেন, ‘‘শেষ গ্রীষ্মে আমি বলেছিলাম, আমার দেখা সর্বকালের সেরা খেলোয়াড় বিরাট কোহালি। কিন্তু এখানে স্মিথ যে রকম ব্যাটিং করল, তা অন্য জাতের।’’ এর পর শুরুর দিকে স্মিথকে দেখার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে আবার অস্ট্রেলীয় কোচ বর্তনাম ক্রিকেটের দুই মহাতারকাকে একই আসনে বসালেন। ল্যাঙ্গারের কথায়, ‘‘স্মিথের শুরুর দিকের খুব আকর্ষণীয় একটা কাহিনি আমার কাছে রয়েছে। কিন্তু সেটা আমার বইয়ের জন্য বাঁচিয়ে রাখছি। কিন্তু এটা তো সকলেরই জানা যে, প্রথমে লেগস্পিনার হিসেবে ওর আত্মপ্রকাশ। সকলে তখন ওকে দেখে ভেবেছিল, এ আর কত দূরই বা যাবে?’’ যোগ করছেন, ‘‘স্মিথ এর পর ফিরে গিয়ে নিজেকে ঘষামাজা করল। প্রতিজ্ঞা নিল, ও বিশ্বের সেরা ব্যাটসম্যান হবে। এখন ও সত্যিই বিরাটের সঙ্গে বিশ্বের সেরা ব্যাটসম্যান। এর পুরো কৃতিত্ব ওর।’’
বছর খানেক আগে কেউ ভাবতে পারেনি, স্টিভ স্মিথ ফের এতটা বন্দিত হতে পারেন। তখন দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে টেস্ট সিরিজে বল-বিকৃতি কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে ক্রিকেটই স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল তাঁর। নিজের দেশের ক্রিকেট জনতার কাছে খলনায়ক হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট বোর্ড এক বছরের জন্য নির্বাসিত করে তাঁকে এবং ডেভিড ওয়ার্নারকে। এর পর দ্বিগুণ প্রতিজ্ঞা নিয়ে ফিরে এসে এক নম্বর ব্যাটসম্যানের মসনদের জন্য ধাওয়া করা ক্রিকেটের ইতিহাসে সেরা প্রত্যাবর্তনগুলোর একটা হয়ে থাকবে।
অস্ট্রেলিয়ার প্রাক্তন ওপেনার এবং এখনকার কোচ ল্যাঙ্গার যেমন বলে ফেলছেন, ‘‘আমার মনে আছে অতিরিক্ত ক্রিকেটার হিসেবে স্টিভ ওয়কে আমি দু’চোখ ভরে দেখতাম। তখন খুব চাইতাম, আমি স্টিভ ওয়ের মতো হব। ও ছিল রানমেশিন। তার পর আমি পান্টারের (রিকি পন্টিং) সঙ্গে খেললাম। তখন আমি চাইতাম পন্টিংয়ের মতো হতে। আমি এক সময় অ্যালান বর্ডারের সঙ্গে খেলেছি। আমার জীবনের তৃতীয় টেস্টে বর্ডার দশ হাজার রান পূর্ণ করে। তখন আমার মনে হয়েছিল, অ্যালান বর্ডার হব।’’ ল্যাঙ্গারের ব্যাখ্যা, ‘‘বিভিন্ন যুগে এ রকম এক জন ক্রিকেটার আসে। কিন্তু স্মিথ যে রকম চাপ নিয়ে এখানে দুই ইনিংসেই অকল্পনীয় দু’টো সেঞ্চুরি করেছে, তার তুলনা পাওয়া কঠিন। শুধু দুর্ধর্ষ স্কিলই নয়, চরিত্রের দিক থেকেও এই দু’টো ইনিংস খুব উঁচুতে স্থান করে নেবে। দুরন্ত সাহস, অভাবনীয় মনঃসংযোগ, চূড়ান্ত শারীরিক সক্ষমতা, অসম্ভব মানসিক দৃঢ়তা— সেরা ক্রীড়াবিদের যা যা গুণ, সব আমরা দেখতে পেয়েছি।’’
কিন্তু অস্ট্রেলীয় কোচ সব চেয়ে বিস্মিত স্মিথের অক্লান্ত ব্যাটিং প্র্যাক্টিসের নমুনা দেখে। বলছেন, ‘‘নেটে লক্ষ লক্ষ বল ছুড়েও ওকে নড়ানো সম্ভব নয়। যেন ধাঁধার সমাধান করার জন্য কোনও উত্তরই নেই কারও কাছে। ইংল্যান্ড অভিনব সব রণনীতি নিয়েছিল। শর্ট পয়েন্ট রেখে ওকে আক্রমণ করেছিল। আমি কখনও যা দেখিনি। ট্রেভর বেলিস ছোটবেলা থেকে স্মিথকে দেখছেন। নিশ্চয়ই ওদের মাথায় কোনও কৌশল ছিল। কিন্তু স্মিথ সব চেয়ে ভাল পারে সমস্যার সমাধান করতে।’’
শোনা যায়, ইংল্যান্ডের মার্ক রামপ্রকাশ নেটে সব চেয়ে বেশি বল খেলতেন। ল্যাঙ্গার সেই রামপ্রকাশকেও বলেছেন, তোমার চেয়ে দ্বিগুণ বল খেলে স্মিথ। পরের টেস্টের জন্য স্মিথের প্রস্তুতি কী রকম হতে যাচ্ছে? ল্যাঙ্গার জানালেন, তিন দিনের প্রস্তুতি ম্যাচ থেকে তাঁকে ছুটি দেওয়া হচ্ছে। তার পরেই হয়তো মনে পড়ে গেল, নেটে ব্যাট হাতে সেই অক্লান্ত যোদ্ধার কথা। তাই সাংবাদিকদের দিকে তাকিয়ে বলে ফেললেন, ‘‘তবে ও নিশ্চয়ই নেটে বল পেটানোর জন্য ঘুরঘুর করবে। একটাই কথা, আমাদের মধ্যে থেকে কাউকে অত বল ছোড়ার জন্য পাওয়া যাবে না এখনই। সে রকম হলে ওর স্ত্রী ড্যানি বোলিং মেশিনে বল বসিয়ে দিতে পারে। আপনারা অবাক হবেন না, আগেও স্ত্রীকে দিয়ে অনেক বার এই কাজ করিয়েছে স্মিথ।’’
বলে না, প্রস্তুতিই একটা মানুষকে নিখুঁত করে তোলে!