এক কামরার ঘরে সপরিবার গোলাম। ছবি: সব্যসাচী ইসলাম
তখনও দল বিপক্ষ দলের থেকে ৫০ রানে পিছিয়ে। তৃতীয় দিনের খেলা শেষে হোটেলের রুমে থাকাকালীন কোচ প্রণব নন্দী সেই অভাবনীয় খবরটা দিলেন। বাংলা সিনিয়র দলে পেস বোলার হিসাবে রঞ্জি ট্রফিতে খেলার সুযোগ পেয়েছে সে।
দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পূরণ হল বীরভূমের রামপুরহাটের ১৭ বছরের কিশোর গোলাম মুস্তাফার। ঘরের ছেলের এমন সাফল্যে খুশির হাওয়া রামপুরহাট জুড়েই।
১১ জানুয়ারি থেকে নাগপুরে বাংলা দলের সঙ্গে বিদর্ভ দলের খেলা হবে। সেই খেলায় বাংলা দলের হয়ে খেলার সুযোগ পেয়েছে অনুর্ধ্ব ১৯ বাংলা দলের পেসার গোলাম মুস্তাফা। সুযোগটা এসেছে তার এ বছরের কোচবিহার ট্রফিতে দারুণ পারফরম্যান্সের এর ভিত্তিতেই। গোলাম এই মুহূর্তে রাজস্থানে কোচবিহার ট্রফিতে খেলতে ব্যস্ত। সেখানে রাজস্থানের বিরুদ্ধে খেলার চতুর্থ দিনের খেলা চলাকালীন রাজস্থানের দ্বিতীয় ইনিংসে দু’টি উইকেট পেয়েছে গোলাম। প্রথম ইনিংসে অবশ্য ২৪ ওভার বল করে ৭টি মেডেন সহ ৬৬ রানে ৩ উইকেট পেয়েছিল। এ বছরই প্রথম বাংলা অনূর্ধ্ব ১৯ দলে খেলার সুযোগ পেয়েছে সে। সুযোগ পেয়েই ৫ ম্যাচে ৩২টি উইকেট পেয়ে রঞ্জি ট্রফিতে বাংলা দলের হয়ে খেলার সুযোগ অর্জন করল গোলাম।
রাজস্থানের বিরুদ্ধে ড্র করার পরে দল ১ পয়েন্ট পেলেও নিজের পারফরম্যান্সে খুশি গোলাম। খেলা শেষে রঞ্জি ট্রফিতে বাংলা দলে খেলার সুযোগ পাওয়ার বিষয়ে জানাল, ‘‘এই সুযোগটার অপেক্ষায় ছিলাম। এ বারে আমাকে আরও ভাল খেলতে হবে। আমার লক্ষ্য ভারতীয় দলে খেলা। সেই লক্ষ্যে পৌঁছতে আমাকে আরও ভাল খেলতে হবে।’’ বাংলা দলে রঞ্জি ট্রফিতে খেলার সুযোগকে বাবা মা-সহ বীরভূম জেলা ক্রীড়া সংস্থার সহ সভাপতি সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়, অনুর্ধ্ব ১৯ বাংলা দলের কোচ প্রণব নন্দী, সিএবি র কোচ সব্যসাচী শীল, রামপুরহাটের খেলার মাঠের কোচ সুভাষ দেবাংশী, বরুণ মণ্ডলকে উৎসর্গ করতে চায় সে। সেই সঙ্গে পাড়ার দাদা রাজু, হাসান-সহ রামপুরহাটে খেলার মাঠের সঙ্গে যুক্ত সকলের অবদান মনে রেখেছে গোলাম।
গোলামের এই উত্তরণের পথটা অবশ্য সহজ ছিল না। রামপুরহাট পুরসভার ১০ নম্বর ওয়ার্ডের বাজার পাড়ায় গোলামের বাড়ি। সরু গলি পেরিয়ে গোলামের পুরাতন আমলের ইট-চুন সুরকির গাঁথনির টিনের ছাউনি বাড়ি। সেই বাড়ির ভিতরে একটা মাত্র ঘরে গোলাম বাবা, মা ও তার দুই ভাই বোন এক সঙ্গে থাকেন। বাড়িতে এক চিলতে বারান্দা পেরিয়ে আলাদা করে ছোট্ট রান্না ঘর। গোলামের বাবা ফিরোজ আলম ফুটবল খেললেও ক্রিকেট খেলার সঙ্গে তেমন সম্পর্ক ছিল না। সংসার চালাতে পাড়ার মোড়ে কখনও চায়ের দোকান করেছেন, কখনও শহরের পাঁচ মাথা মোড়ের ফুটপাতে জুতোও বিক্রি করেছেন। কখনও ফুটপাতে কাপড়ও বিক্রি করেছেন। বর্তমানে পাড়ায় একজন শিশু-চিকিৎসকের চেম্বারে কাজ করে সংসার চালান। কোনও দিনই ছেলের খেলার দামি জুতো কিনে দিতে পারেননি তিনি। কখনও ওয়ার্ডের কাউন্সিলর, কখনও পুরপ্রধান, কখনও মহকুমাশাসকের সহযোগিতায় ছেলের খেলার জুতো জোগাড় হয়েছে। এমন ঘর থেকে উঠে আসা ছেলে বাংলা দলে রঞ্জি ট্রফিতে খেলার সুযোগ পেয়েছে বলে খুশি বাবা ফিরোজ আলম। গোলামের মা মোসারাত বানু জানালেন, ‘‘ছেলের ছোট থেকে ক্রিকেট খেলার নেশা দেখে খুব বকতাম। আজ একটা জায়গায় পৌঁছেছে। এখন আরও উন্নতি করুক এটাই চাইছি।’’ বাংলা দলে দাদার খেলার খবর পেয়ে খুশি ভাই হাসনাইন ও বোন ইশা পারভিন।
গোলামের সাফল্যে খুশি রামপুরহাটের ক্রীড়ামহলেও। স্থানীয় ক্রীড়াপ্রেমীরা জানাচ্ছেন, আশির দশকে সিউড়ির প্রবাল ঘোষের পরে রামপুরহাটের গোলাম মুস্তাফা বাংলা দলের হয়ে রঞ্জি ট্রফিতে খেলার সুযোগ পেল। রামপুরহাট মহকুমা ক্রীড়া সংস্থার খেলার মাঠে সেই আট ন’বছর থেকে গোলামকে দেখে আসছেন বীরভূম জেলা ক্রীড়া সংস্থার সহ সভাপতি তথা রামপুরহাট মহকুমা ক্রীড়া সংস্থার সম্পাদক সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়। সুশান্ত বললেন, ‘‘বর্তমানে ইস্টবেঙ্গল দলের কোচ সব্যসাচী শীল-সহ রামপুরহাটের কোচিং ক্যাম্পের কোচ সুভাষ দেবাংশী, বরুণ মণ্ডলের হাত ধরে গোলাম ক্রিকেট মাঠে ডান হাতে পেস বোলার হিসাবে উঠে এসেছে।’’
জেলার হয়ে অনূর্ধ্ব ১৪, ১৬, ১৯ এবং সিনিয়র দলের হয়ে খেলার সুবাদে ডানহাতি পেস বোলার গোলাম এ বছরে অনূর্ধ্ব ১৯ বাংলা দলে কোচবিহার ট্রফিতে খেলার সুযোগ পেয়েছে। গোলামের রামপুরহাটে খেলার মাঠের কোচ সুভাষ দেবাংশী জানাচ্ছেন, ‘‘আগে থেকেই আউটসুইঙ্গার, ভালো বাউন্সার বল করতে পারত গোলাম। অনূর্ধ্ব ১৯ বাংলা দলে সুযোগ পাওয়ার পরে ইনসুইঙ্গার টা ভালো শিখেছে।’’ সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে সুভাষ দেবাংশী, পার্থসারথী মুখোপাধ্যায়-সহ জেলা ক্রীড়া সংস্থার সঙ্গে যুক্ত সকলেই খুব খুশি তাঁদের প্রিয় খেলোয়াড় গোলাম বাংলা রঞ্জি দলে সুযোগ পাওয়া। সকলের ইচ্ছে, আরও ভাল খেলে ভারতীয় দলে জায়গা করে নিক তাঁদের আদরের গোলাম।