East Bengal Cenetenary

রোভার্স কাপে মজিদকে জড়িয়ে ধরে দিলীপ কুমার বললেন, তুমিই সেরা

কোথায় এগিয়ে ছিলেন মজিদ? অবসরে তাঁরা কী করতেন? কোন ফিল্ম দেখতে ভালবাসতেন তাঁর পার্টনার? সব কাহিনি উজাড় করলেন জামশিদ নাসিরি...

Advertisement

জামশিদ নাসিরি

কলকাতা শেষ আপডেট: ৩০ জুলাই ২০১৯ ২০:১২
Share:

লাল-হলুদ জার্সিতে ফুল ফুটিয়েছিলেন মজিদ।ফাইল চিত্র।

কলকাতা শহরে প্রায় চার দশক রয়ে গিয়েছি। এই শহরে আমি এখন অনেকের কাছেই আর সেই ইরান থেকে আসা ফুটবলার জামশিদ নাসিরি নই। একজন ভারতীয়ই হয়ে গিয়েছি।

Advertisement

কলকাতায় এই ৩৯ বছরে আমি অনেক বিদেশি ফুটবলারকেই খেলতে দেখেছি। যার মধ্যে চিমা, এমেকা, ক্রিস্টোফার, আমার দেশের খাবাজি, ব্যারেটো, মাইক ওকোরো থেকে জনি আকোস্তা, খাইমে সান্তোস কোলাদো—অনেককেই দেখলাম। কিন্তু আমাকে যদি জিজ্ঞাসা করেন, আমার চোখে দেখা কলকাতার ফুটবলের সেরা বিদেশি কে? তা হলে উত্তর পাবেন একটাই। সে হল আমার জন্মভূমি ইরানের ফুটবলার মজিদ বাসকার। ফুটবলের বাদশা মজিদই।

এ রকম ঠান্ডা মাথার বিদেশি ফুটবলার ভারতে আমি খুব কমই দেখেছি। যে একাধারে স্কিমার ও স্কোরার দুই ভূমিকাই পালন করতে পারত। ইরানের বিশ্বকাপ দলে ছিল মজিদ। আমার বন্ধুর শুধু একটাই দুর্বলতা ছিল। তা হল ও নিজেই জানত না যে, কত বড় ফুটবলার। তাই অনিয়ন্ত্রিত আবেগকে সঙ্গী করেই ফুটবল মাঠে সাফল্যের ফুল ফুটিয়েছে শিল্পী মজিদ। আশি সালে ইস্টবেঙ্গলে এসে যে দুরন্ত ফুটবলটা মজিদ খেলেছিল, তা আজও লোকের মুখে মুখে ফেরে।

Advertisement

মজিদের সঙ্গে আমার পরিচয় আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে। আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়ে আমরা গিয়েছিলাম রোভার্স কাপে খেলতে। সেই দলে ছিলেন স্টপার আলি খোদাই। সে এক দুরন্ত স্টপার ছিল। সেখানে আমি আর মজিদও দুর্দান্ত খেলেছিলাম। মুম্বইয়ে আমাদের সঙ্গে প্রথম ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের প্রথম যোগাযোগ হয়। মজার ব্যাপার, আমি যে কলকাতার ক্লাবে খেলার প্রস্তাব পেতে পারি, তা প্রথমে বিশ্বাস করতে পারিনি। কারণ, আমার তখন বিশ্বাস ছিল মজিদ আর আলি—এই দু’জনই আমার চেয়ে ভাল ফুটবলার। এই দু’জনকেই শেষ পর্যন্ত পছন্দ করবে ইস্টবেঙ্গল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কলকাতায় চলে এলাম আমি আর মজিদই।

শুধু ভাল ফুটবলারই নয়, মজিদ ছিল একজন নরম মনের মিষ্টি মানুষ। লাল-হলুদ জার্সি গায়ে কলকাতায় খেলতে আসার পরে আমাদের প্রথম দিকের বড় ম্যাচ ছিল ১৯৮০ সালের ১৬ অগস্ট। ভারতীয় ফুটবলের ইতিহাসে যা একটা মর্মান্তিক ঘটনা। পরের দিন কাগজে যে ঘটনার বিবরণ পড়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে মজিদ কেঁদে ফেলেছিল।

ইস্টবেঙ্গলে ১২ নম্বর জার্সি গায়ে খেলা মজিদের ম্যাজিক আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি। আর গ্যালারিতে বসে দেখেছেন দর্শকেরা। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে যাচ্ছে একটা বড় ম্যাচের কথা। সেই ম্যাচে মোহনবাগানের এক মিডফিল্ডার মজিদকে লক্ষ্য করে খুব বাজে ভাবে পা চালাচ্ছিল। ম্যাচে আমি একটা থ্রু বাড়িয়েছিলাম মজিদকে। বল মজিদের পায়ে যাচ্ছে বুঝতে পেরে ওই মিডফিল্ডার দ্রুত ফাইনাল ট্যাকলে চলে গিয়েছিল। মজিদ ওকে দেখতে পায়নি। কিন্তু ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় এতটাই শক্তিশালী ছিল যে, বলটা ছোট্ট একটা টোকায় শূন্যে ভাসিয়ে দিয়ে নিজে সরে গেল। আর সেই মিডফিল্ডার মজিদকে মারতে গিয়ে নিজেই বাইরে চলে গেল চোট পেয়ে।

ইস্টবেঙ্গলে খেলার সময়ে রোভার্স কাপের কথা মনে পড়ছে। সেই প্রতিযোগিতার ফাইনালে খেলা দেখতে এসেছিলেন বলিউডের অন্যতম সেরা অভিনেতা দিলীপ কুমার। তিনি মজিদের খেলা দেখে এতটাই মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন যে, বাড়ি ফেরার আগে সোজা চলে এসেছিলেন ইস্টবেঙ্গল ড্রেসিংরুমের সামনে। আমার সামনেই মজিদকে জড়িয়ে ধরে বলে গিয়েছিলেন, ‘‘তুমিই এই মুহূর্তে ভারতের সেরা ফুটবলার।’’ ভারতে এসে মজিদের অন্যতম এক সেরা বিনোদন ছিল সিনেমা দেখা। এখনকার মতো তখন তো আর কম্পিউটার, স্মার্ট ফোন, ইউটিউব ছিল না যে, সেখানেই সিনেমা দেখে নিতে পারবে। তাই আমাকে নিয়ে প্রায়ই কলকাতার অনেক সিনেমা হলে যেত। ওর অন্যতম একটা প্রিয় সিনেমা ছিল, ‘শোলে’। এই সিনেমাটা আমি মজিদের কল্যাণেই বার তিনেক দেখেছি আশির দশকে। তাই দিলীপ কুমারের অভিনন্দন পেয়ে ওকে খুব খুশি দেখিয়েছিল সে দিন।

মজিদের সম্পদ ছিল গতি, সঙ্গে পায়ে গোলার মতো শট। আর ছিল একটা চোরা গতি। কখন যে গতি বাড়িয়ে ও বলের কাছে পৌঁছে যাবে, তা ডিফেন্ডারেরা আগাম অনুমান করতে পারত না। বলের দখল যে রকম ছিল, ঠিক সে রকমই বল ডিফেন্ডারের নাগালের বাইরে রাখতে পারত। দার্জিলিং গোল্ড কাপের একটা ম্যাচে আমরা মোহনবাগানের কাছে হারছিলাম। বিরতির পরে মজিদ আমাকে দিয়ে একটা গোল করাল। আর নিজে একটা গোল করে হার বাঁচিয়েছিল ইস্টবেঙ্গলের।

সেই মজিদ এখন থাকে ইরানের রাজধানী তেহরানের দক্ষিণে খোররমশাহরে। যা ইরাক সীমান্তের খুব কাছে। তেহরান থেকে সড়ক পথে যেতে লাগে প্রায় ১০-১১ ঘণ্টা। দাদার বাড়িতে থাকে। ইস্টবেঙ্গল শতবর্ষে আসতে পারে বলে শুনছি। যদি আসে, তা হলে ইস্টবেঙ্গল শতবর্ষে একটা বড় উপহার পাব। সেই উপহারটার নাম বাদশা মজিদ। যে আমার চোখে ভারতে খেলা সেরা বিদেশি ফুটবলার।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement