বাড়িতে নেই আর্থিক সঙ্গতি। কিন্তু ছেলের ক্রিকেট খেলার ইচ্ছে অদম্য। মহারাষ্ট্রের কোঙ্কন প্রদেশের পালঘর থেকে রোজ ৯০ কিমি পাড়ি দিয়ে মুম্বই আসতেও পিছপা হন না। কেরিয়ার শুরু করেও বারবার এসেছে ব্যর্থতার স্বাদ। সেখান থেকেই ঘুরে দাঁড়িয়ে শার্দূল ঠাকুর এখন হয়ে উঠছেন ভারতের নির্ভরয়োগ্য ফাস্ট বোলার।
শার্দূলের জন্ম ১৯৯১ সালের ১৬ অক্টোবর। লোকাল ট্রেনে করে তিনি রোজ পালঘর থেকে মুম্বই পৌঁছতেন ক্রিকেট অনুশীলনের জন্য। তাঁর স্বপ্নপূরণের হাল ধরেছিলেন প্রশিক্ষক দীনেশ লাড। তিনি ছিলেন বরিভেলির স্বামী বিবেকানন্দ আন্তর্জাতিক স্কুলের ক্রিকেট প্রশিক্ষক। তিনি শার্দূলকে নিজের বাড়িতে রেখে দেন। ভর্তি করে দেন স্বামী বিবেকানন্দ আন্তর্জাতিক স্কুলে। যাতে ক্রিকেট আর লেখাপড়া একসঙ্গেই চলতে পারে। দশম শ্রেণি পর্যন্ত দীনেশের বাড়িতেই থাকতেন শার্দূল।
স্কুল ক্রিকেটেই নজর কেড়েছিলেন প্রতিভাবান শার্দূল। হ্যারিস শিল্ডের ম্যাচে স্কুলের হয়ে তাঁর এক ওভারে ৬ বলে ৬ টা ওভার বাউন্ডারি এখনও উঠে আসে ক্রিকেট-আড্ডায়। পাশাপাশি, গতির জন্য তাঁকে মুম্বইয়ের ক্রিকেটমহলে ডাকা হয় ‘পালঘর এক্সপ্রেস’ বলে। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে আত্মপ্রকাশ ২০১২ সালে। প্রথম ম্যাচ ছিল জয়পুরে, রাজস্থানের বিরুদ্ধে। তবে কেরিয়ারের শুরুটা আকর্ষণীয় ছিল না। রঞ্জিতে প্রথম চার ম্যাচে উইকেট ছিল ৪টি।
২০১৩-১৪ রঞ্জি মরসুমে ৬টি ম্যাচে পান ২৭ উইকেট । পরের মরসুমে ১০ ম্যাচে তাঁর শিকার ৪৮ উইকেট। ২০১৫-১৬ মরসুমে রঞ্জি ফাইনালে সৌরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তাঁর ৮ উইকেট মুম্বইকে ৪১তম রঞ্জি ট্রফি এনে দেয়। ধারাবাহিক ভাবে ভাল পারফরম্যান্সের দৌলতে তাঁর সামনে জাতীয় দলের দরজা খুলে যায়।
২০১৭ সালের ৩১ অগস্ট শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে প্রথম ওয়ানডে ম্যাচ খেলেন শার্দূল। পরে বছরই টি-২০ এবং টেস্টে অভিষেক। এখনও অবধি আটটা একদিনের ম্যাচে তাঁর শিকার ৮ উইকেট। সেরা পারফরম্যান্স ৫২ রানে ৪ উইকেট। রান করেছেন ৫২। ১৪ টি-টোয়েন্টি ম্যাচে উইকেট ১৯টি। সেরা বোলিং ২৭ রানে ৪ উইকেট। রান ৪২। একটি মাত্র টেস্টে উইকেট পাননি। রান করেছিলেন ৪। সেই টেস্টে আঘাতের জন্য মাত্র ১০টি বল তিনি করতে পেরেছিলেন। তবে তার আগে, ২০১৬ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরেও ১৬ জনের টেস্ট দলে ছিলেন শার্দূল। তবে তাঁকে কোনও ম্যাচে খেলানো হয়নি।
শার্দূলের কেরিয়ারের শুরুটা একেবারেই মসৃণ ছিল না। প্রধান সমস্যা ছিল বাড়তি ওজন। বোলিংয়ের তুলনায় অতিরিক্ত ওজনের জন্যই শিরোনামে বেশি আসতেন তিনি। কঠোর পরিশ্রমে ও ফিটনেসে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে নিজেকে শুধরে নেন তিনি। ৮৩ কেজি ওজন থেকে কয়েক মাসে কমিয়ে ফেলেন ১৩ কেজি। মুম্বইয়ের বোলিং আক্রমণের প্রধান অস্ত্র হয়ে ওঠেন দ্রুত।
আন্তর্জাতিক কেরিয়ারের শুরুতে শার্দূল জার্সি-বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। তাঁর জার্সির নম্বর ছিল ১০ নম্বর। যা মেনে নিতে পারেননি সচিন তেন্ডুলকরের ভক্তরা। আসলে, বছরের দশম মাস অক্টোবরে জন্ম বলে তিনি ‘১০’ সংখ্যা পছন্দ করেছিলেন। বিতর্কের জেরে পরে তিনি পাল্টান জার্সি নম্বর। বেছে নেন ৫৪ নম্বর জার্সি।
ঘরোয়া ক্রিকেটের পাশাপাশি শার্দূলের কেরিয়ারে আইপিএল-ও গুরুত্বপূর্ণ। ২০১৫ সালে তিনি আইপিএলে প্রথম ম্যাচ খেলেন। তখন খেলতেন দিল্লি ডেয়ারডেভিলসের হয়ে। পরে তিনি খেলেছেন পুণে এবং চেন্নাইয়ের হয়েও। আইপিএলে ভাল পারফরম্যান্স তাঁকে জাতীয় দলে সুযোগ পেতে সাহায্য করেছে।
আইপিএলে যন্ত্রণার স্মৃতিও রয়েছে। গত আইপিএলের ফাইনালে লাসিথ মালিঙ্গার শেষ বলে তিনি দু’রান নিতে না পারায় চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি চেন্নাই সুপার কিংস। টেস্ট কেরিয়ারেও রয়েছে যন্ত্রণা। ২০১৮ সালের অক্টোবরে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে হায়দরাবাদে টেস্ট অভিষেকে মাত্র ১০ বল করেই কুঁচকির চোটে মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে যেতে হয়েছিল তাঁকে।
বার বারই মনে হয়েছে শার্দূল বোধহয় এ বার বেরিয়েই গেলেন লড়াইয়ের ময়দান ছেড়ে। কিন্তু প্রতিবারই সমালোচকদের ভুল প্রমাণ করে ফিরে এসেছেন তিনি। জীবনে কঠিন সময়ে পাশে পেয়েছেন প্রশিক্ষককে। কখনও হাতে ধরে, কখনও টিপস দিয়ে যিনি শুধরে দিয়েছেন শিষ্যের ভুল। হতাশা ভুলে আত্মবিশ্বাস ফেরাতে তিনি পরামর্শ দিয়েছিলেন সফল ক্রিকেটারদের আত্মজীবনী পড়তে। তাঁর সেই পরামর্শও যে কাজে দিয়েছে, তা স্বীকারও করেছেন শার্দূল।
বোলিংয়ের পাশাপাশি শার্দূলের অস্ত্র তাঁর ঝোড়ো ব্যাটিং। আগামী টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে অলরাউন্ডার হিসেবে জায়গা পাকা করাকেই আপাতত পাখির চোখ করেছেন তিনি। ক্রিকেটের বাইশ গজে শার্দূল থাকতে চান বাঘের মতো বীরবিক্রমেই।
স্বপ্নের চোখ আকাশে থাকলেও শার্দূল পা দুটো রাখতে চান জমিতেই। লোকাল ট্রেনে রোজ সাত ঘণ্টা যাতায়াতের অতীত তিনি ভুলে যেতে চান না। দু’ বছর আগে দক্ষিণ আফ্রিকা সফর থেকে ফিরে বিমানবন্দর থেকে শার্দূল এসেছিলেন অন্ধেরি স্টেশন। তারপর সেখান থেকে লোকাল ট্রেনে করেই পালঘরে নিজের বাড়িতে ফিরেছিলেন জাতীয় দলের এই ক্রিকেটার। (ছবি: আর্কাইভ এবং ফেসবুক)