লর্ডস টেস্ট জয়ের পর বিরাট কোহলীর ভারত। ছবি - টুইটার
ক্রিকেট ঘোর অনিশ্চয়তার খেলা সবাই জানে। কিন্তু এই লর্ডস টেস্টের শেষ দিন এত রোমাঞ্চ, পরতে পরতে এত উত্তেজনা জমে থাকবে সেটা কে জানত! শেষ দিনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বাইশ গজের যুদ্ধে যা যা ঘটে গেল সেটা রহস্যে ঠাসা হলিউডের সিনেমাকেও হার মানাবে। মহম্মদ শামি-যশপ্রীত বুমরার ব্যাটিং শৌর্যে ইংরেজদের আত্মবিশ্বাসে আগেই ধাক্কা লেগেছিল, সেই সুযোগ নিয়ে শুরু থেকেই সাহেবদের ল্যাজেগোবরে করে ব্যাটিংকে ভাঙার কাজে নেমে পড়েছিলেন এই দুই জোরে বোলার। বাকি কাজটা সারলেন ইশান্ত শর্মা ও মহম্মদ সিরাজ। ফলে ইংল্যান্ডকে ১২০ রানে অল আউট করে, ১৫১ রানে জিতে সিরিজে ১-০ ব্যবধানে এগিয়ে গেল ভারত।
একই সঙ্গে লর্ডসে দ্বিতীয় টেস্ট জিতে কপিল দেব ও মহেন্দ্র সিংহ ধোনিকে ছুঁয়ে ফেললেন বিরাট কোহলী। ১৯৮৬ সালে কপিলের অধিনায়কত্বে এই মাঠে ৫ উইকেটে জিতেছিল ভারত। এর ২৮ বছর পর ধোনির নেতৃত্বে ৯৫ রানে জিতেছিল টিম ইন্ডিয়া। আর এ বার স্বাধীনতা দিবসের পরের দিন কোহলীর বীরদের বিক্রমে ‘অপারেশন লর্ডস’-এর সাক্ষী থাকল ভারতীয় ক্রিকেট।
মহম্মদ শামি ও যশপ্রীত বুমরার এই জুটির জন্য ম্যাচ থেকে হারিয়ে যায় ইংল্যান্ড। ছবি - টুইটার
ক্রিকেট মক্কায় সাহেবদের ব্যাটিংয়ে ধাক্কা দেওয়ার কাজটা সেই বুমরা (৩/৩৩), শামি (১/১৩) শুরু করলেন। সঙ্গ দিলেন সিনিয়র ইশান্ত (২/১৩) ও প্রথম ইনিংসে আগুনে বোলিং করা সিরাজ (৪/৩২)। চোখের নিমেশে সাহেবদের যাওয়া আসার পালা শুরু হয়ে গেল। দেখতে দেখতে চা পানের বিরতির আগে চার উইকেট হারিয়ে ফেললো ইংল্যান্ড। বিপক্ষকে চাপে রাখলেও জয়ের ব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছিল না। কারণ চলতি সিরিজে দুটো শতরান ও একটি অর্ধ শতরান করা জো রুট যে তখনও একটা দিক আগলে রেখে লড়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু তিনিও এ বার পারলেন না।
অফ স্টাম্পের বাইরের বলকে ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপারে তাঁর সুনাম রয়েছে। কিন্তু চাপের মুখে তিনিও ভুল করে বসলেন। চা পানের বিরতির পর ২২.৩ ওভারে এল সেই কাঙ্খিত মুহূর্ত। বুমরার বাইরে যাওয়া বলকে খোঁচা দিয়ে বসলেন রুট। প্রথম স্লিপে থাকা কোহলী দক্ষতার সঙ্গে সেই ক্যাচ লুফে নেওয়ার সঙ্গে দিলেন সজোরে হুঙ্কার। কারণ চলতি সিরিজে ব্যাটে তাঁকে রুট হারালেও অধিনায়কত্বের দিক থেকে রুটকে ১০ গোল দিলেন ‘কিং কোহলী’। ৬৭ রানে ৫ উইকেট চলে যেতেই বোঝা গিয়েছিল, ইংল্যান্ড দল ভেন্টিলেশনে চলে গিয়েছে। ডেথ সার্টিফিকেট লেখা স্রেফ সময়ের অপেক্ষা। আর তাই হল। দ্বিতীয় ইনিংসে মাত্র ৫১.৫ ওভার টিকতে পারল ইংরেজরা।
জো রুটকে উপড়ে দেওয়ার পর বুমরার হুঙ্কার। ছবি - টুইটার
ব্যাটিংয়ের মতো বোলিং ও অধিনায়কত্বে একাধিক ভুল করলেন রুট। ফুটবলের মতো এখানেও ঋষভ পন্থকে ‘ম্যান মার্কিং’ করেছিলেন রুট ও তাঁর জোরে বোলাররা। আর এরই খেসারত দিল ইংল্যান্ড। পন্থ ও ইশান্ত শর্মা বিদায়ের পর যখন ভেবে নেওয়া গিয়েছিল যে সাহেবদের ব্যাট করতে নামা স্রেফ সময়ের অপেক্ষা, ঠিক তখনই খেলা ঘুরিয়ে দিলেন শামি ও বুমরা। শুধু ইংল্যান্ড নয় বিদেশের মাটিতে নবম উইকেটে এটি ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ রানের জুটি। আর সেখান থেকেই লর্ডস টেস্টে পিছিয়ে যেতে শুরু করেছিল রুটের দল।
২০৯ রানে ৮ উইকেট থেকে আর কোনও উইকেট না হারিয়ে ২৯৮ রান। লড়াকু মেজাজে এমন প্রত্যাবর্তন বেনজির। অবিশ্বাস্য। বুকের চওড়া খাঁচা লাগে। কোহলী, রোহিতদের ব্যর্থতার মঞ্চেই দ্বিতীয় অর্ধ শতরান করে ফুল ফোটালেন শামি। সঙ্গ দিলেন বুমরা। ভারতীয় ইনিংস দ্রুত শেষ হয়ে যাবে, এমনটাই ভেবে সবাই নড়েচড়ে বসেছিলেন। রুট তখন সিরিজে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে দিয়েছেন। জেমস অ্যান্ডারসন পুরো ফিট না হলেও চেষ্টা করছেন। মার্ক উড ও অলি রবিনসন বেশ কয়েকবার বুমরার হেলমেটে মারলেন। বুমরার কাছে জস বাটলার স্লেজিং করে গেলেন। কিন্তু কোনও টোটকা কাজে এল না।
প্রথম ইনিংসের পর এ বারও জ্বলে উঠলেন মহম্মদ সিরাজ। ছবি - টুইটার
ভারতের দ্বিতীয় ইনিংসের ৯১তম ওভারের ঘটনা। ওভার শেষ হওয়ার পরই বুমরার উদ্দেশে উড ও বাটলারকে কিছু বলতে দেখা যায়। তার আগে অ্যান্ডারসন ও বুমরার মধ্যেও বাগযুদ্ধ বেঁধেছিল। এরপর বুমরাও থেমে যাওয়ার পাত্র নন। পাল্টা জবাব দিতে শুরু করেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে আম্পায়ারকে আসরে নামতে হয়েছিল। পুরো ঘটনা ব্যালকনি থেকে দেখে উত্তেজিত হয়ে পড়েন কোহলী। এই ঘটনাই হয়তো ভারতীয় দলকে আরও চাগিয়ে তুলেছিল।
যার প্রতিফলন ঘটল ম্যাচের বাকিটা সময়। ঐতিহ্যের লর্ডসে তৃতীয় টেস্ট জেতার পাশাপাশি চলতি সিরিজেও এগিয়ে গেল কোহলীর ভারত। এখন শুধু অধিনায়কের ব্যাট থেকে বড় রান প্রয়োজন।
অন্যদিকে চলতি সিরিজে এখনও পর্যন্ত সর্বোচ্চ ৩৮৬ রান করা রুটের অবস্থা অনেকটা টাইটানিকের সেই ‘কাপ্তান’-এর মতো। যার চোখের সামনে তাঁর সাধের জাহাজ ডুবে গিয়েছিল। নির্লিপ্ত থাকা ছাড়া আর কিছুই করতে পারেননি। শেষ হয়ে যাওয়ার আগে শুধু চোখ বন্ধ করে নিয়েছিলেন।