গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।
শুরুটা হয়েছিল কুস্তির বিতর্ক দিয়ে। শেষটা হল আভা খাটুয়ার জায়গা না পাওয়া নিয়ে। প্যারিস অলিম্পিক্সে ভারতের হয়ে অংশ নিচ্ছেন ১১৭ জন ক্রীড়াবিদ। কিন্তু এই অলিম্পিক্সের পথ মোটেও সহজ ছিল না। তিনটি বিতর্ক হয়েছে ভারতের খেলাধুলো নিয়ে। সেই তিনটি বিতর্ক ভারতের পদকজয়ের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
প্রাক্তন কুস্তিকর্তা ব্রিজভূষণের সঙ্গে কুস্তিগিরদের বিরোধ—
গত দু’বছরে ভারতের খেলাধুলো সবচেয়ে বেশি আলোড়িত হয়েছে কুস্তি নিয়ে। শুরুটা হয়েছিল বিনেশ ফোগটের একটি অভিযোগ ঘিরে। তিনি অভিযোগ করেছিলেন, তৎকালীন কুস্তিকর্তা ব্রিজভূষণ শরণ সিংহ নাবালিকা কুস্তিগিরদের নিগ্রহ করেছেন। বিনেশের পাশে দাঁড়ান সাক্ষী মালিক ও বজরং পুনিয়া। আন্দোলন শুরু করেন তাঁরা। কুস্তিগিরদের দাবি ছিল, ব্রিজভূষণকে গ্রেফতার করতে হবে। কুস্তি সংস্থার মাথায় যাতে বিজেপি সাংসদ ব্রিজভূষণের পরিবারের কেউ বা ঘনিষ্ঠ কেউ থাকতে না পারেন সেই আবেদনও কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে আবেদন করেন বজরঙেরা। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার তাঁদের দাবি মানেনি। ফলে দিল্লির যন্তর মন্তরে শুরু হয় ধর্না। লাগাতার সেই ধর্নায় জড়িয়ে যায় রাজনীতি। সাক্ষী, বিনেশরা আন্দোলন করে নতুন সংসদ ভবনের দিকে যাওয়ার সময় পুলিশ তাঁদের আটকায়। কুস্তিগিরেরা অভিযোগ করেন, মহিলাদের হেনস্থা করেছে পুরুষ পুলিশ।
পরিস্থিতি প্রতি দিন আরও খারাপ হতে থাকে। কুস্তিগিরদের সমর্থন করেন পঞ্জাব, হরিয়ানার কৃষক নেতারা। কেন্দ্রীয় সরকার কুস্তিগিরদের দাবি না মানায় দেশের হয়ে জেতা সমস্ত পদক হরিদ্বারের গঙ্গায় ভাসিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন কুস্তিগিরেরা। কৃষক নেতাদের কথায় শেষ পর্যন্ত মন বদলালেও সরকারকে সময়সীমা বেঁধে দেন তাঁরা। ব্রিজভূষণ শুরু থেকে তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ অস্বীকার করছিলেন। পাল্টা কুস্তিগিরদের কাঠগড়ায় তুলছিলেন তিনি। তবে লাগাতার বিক্ষোভের পরে দিল্লি পুলিশ ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করে। মামলা শুরু হয়। চাপে পড়ে ইস্তফা দেন ব্রিজভূষণ। দোষী সাব্যস্তও হন তিনি।
দীর্ঘ দিন ভারতীয় কুস্তি সংস্থায় নির্বাচন না হওয়ায় পদক্ষেপ করে বিশ্ব কুস্তি সংস্থা। ভারতীয় কুস্তি সংস্থাকে নিলম্বিত করে তারা। ডামাডোলের মধ্যে অবশেষে নির্বাচন হয়। ব্রিজভূষণ বা তাঁর পরিবারের কেউ নির্বাচনে না দাঁড়ালেও তাঁর ঘনিষ্ঠ সঞ্জয় সিংহ নির্বাচনে দাঁড়ান। তিনিই জেতেন। সঞ্জয় নতুন কুস্তিকর্তা হওয়ার পরেও বিক্ষোভ চালিয়ে যেতে থাকেন কুস্তিগিরেরা। বাধ্য হয়ে তৎকালীন কেন্দ্রীয় ক্রীড়ামন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর দেখা করেন প্রতিবাদী কুস্তিগিরদের সঙ্গে। তিনি আশ্বাস দেন, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা হয়নি।
সঞ্জয় কুস্তি সংস্থার মাথায় বসার পরে নিজের পদ্মশ্রী ফিরিয়ে দেন বজরং। অলিম্পিক্স পদকজয়ী বজরং চোখের জলে বলেন, “আমরা আর কুস্তি লড়তে পারব কি না জানি না। রাজনীতি কী ভাবে কাজ করে জানি না।” রিও অলিম্পিক্সে ব্রোঞ্জ জিতেছিলেন সাক্ষী। তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলেন, “আমাকে আর কেউ কখনও কুস্তি লড়তে দেখবে না।” অথচ এই বজরং, সাক্ষী ও বিনেশ ভারতের সেরা তিন কুস্তিগির। প্যারিসেও তাঁদের উপরই ভরসা ছিল। কিন্তু কুস্তির এই বিতর্কের পরে বজরং ও সাক্ষী আর খেলতে চাননি। বিনেশ দলে রয়েছেন। কিন্তু অলিম্পিক্সে পদক জেতার মতো জায়গায় তিনি রয়েছেন কি না বলা যাচ্ছে না। অলিম্পিক্সে পদকজয়ের জন্য যে খেলার দিকে ভারত তাকাত, সেই খেলা বিতর্কে পিছিয়ে পড়েছে।
বিশ্বসেরাকে হারিয়েও অলিম্পিক্সের দলে জায়গা পাননি বাঙালি টেবল টেনিস তারকা ঐহিকা—
এশিয়ান গেমসে ব্রোঞ্জ ও বিশ্বসেরা তারকাকে হারানোর পরেও ভারতের টেবল টেনিসের মহিলাদের দলে জায়গা পাননি ঐহিকা মুখোপাধ্যায়। মহিলাদের দলে রয়েছেন— মণিকা বাত্রা, শ্রীজা আকুলা ও অর্চনা কামথ। ঐহিকাকে রাখা হয়েছে পরিবর্ত হিসাবে। অর্থাৎ, যদি এই তিন খেলোয়াড়ের কেউ চোট পান বা অন্য কোনও কারণে খেলতে না পারেন তা হলে ঐহিকা খেলবেন। মহিলাদের দল ঘোষণা নিয়ে ফেডারেশনের বক্তব্যে উঠেছে প্রশ্ন। ফেডারেশন একটি বিবৃতিতে জানিয়েছে, মহিলাদের দলের তৃতীয় খেলোয়াড় নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অর্চনাকেই সুযোগ দেওয়া হয়েছে। কারণ, বিশ্ব টেবল টেনিস চ্যাম্পিয়নশিপে অর্চনা ভাল খেলেছে। এ ছাড়া ওর বিশ্ব র্যাঙ্কিংও ঐহিকার থেকে ভাল।
ফেডারেশন ব্যাখ্যা দিলেও টেবল টেনিসে সাম্প্রতিক সময়ে ঐহিকা যা পারফর্ম করেছেন তেমনটা করতে পারেননি অর্চনা। এশিয়ান গেমসে সুতীর্থা মুখোপাধ্যায়কে সঙ্গী করে ব্রোঞ্জ জিতেছিলেন ঐহিকা। প্রথম ভারতীয় মহিলা জুটি হিসাবে এই কীর্তি করেছেন তাঁরা। তার পরে তিনি হারিয়েছেন বিশ্বসেরাকে। টেবল টেনিসে তাঁর পারফরম্যান্সের জন্য এই বছর অর্জুন পুরস্কারও পেয়েছেন ঐহিকা। তার পরেও র্যাঙ্কিংয়ের ভিত্তিতে বাদ দেওয়া হয়েছে ঐহিকাকে। বিশ্ব স্তরে ঐহিকার (১৩৬) থেকে ৩৩ ধাপ এগিয়ে অর্চনা (১০৩)। জাতীয় স্তরে সিঙ্গলসে ২০২৩ সালের শেষে ঐহিকা ছিলেন দু’নম্বরে। অর্চনা তিন নম্বরে। কিন্তু তার পরে কয়েকটি প্রতিযোগিতায় নামেননি ঐহিকা। ক্রমতালিকায় এগিয়ে যাওয়ার জন্য প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে হয়। সেখানে ঐহিকা পিছিয়ে গিয়েছেন। কয়েকটি প্রতিযোগিতায় নামার আগে ভিসা সমস্যায় পড়েছেন তিনি। তাই যাওয়া হয়নি। আবার চোটের কারণেও কয়েকটি প্রতিযোগিতা থেকে নাম তুলে নিয়েছেন। সেই সব জায়গায় খেলে নিজের র্যাঙ্কিং বাড়িয়ে নিয়েছেন অর্চনা। ফেডারেশন সেটাই দেখেছে। কিন্তু সিঙ্গলসে পদক জয়ের জন্য অর্চনার থেকে ঐহিকা বেশি নির্ভরযোগ্য ছিলেন। সেটা দেখা হয়নি।
শেষ মুহূর্তে অলিম্পিক্সের দল থেকে বাদ বাঙালি আভা—
ভারতের ৩০ জনের অ্যাথলেটিক্স দলে ছিলেন বাঙালি আভা খাটুয়া। শটপাটে নাম ছিল তাঁর। কিন্তু শেষ মুহূর্তে যে তালিকা প্রকাশ করা হয়, সেখানে রয়েছেন ২৯ জন অ্যাথলিট। আভার নাম বাদ। কেন তিনি বাদ দিয়েছেন তার ব্যাখ্যা বিশ্ব অলিম্পিক্স সংস্থা বা ভারতীয় অলিম্পক্স সংস্থা জানায়নি। পোল্যান্ডে অলিম্পিক্সের প্রস্তুতিও শুরু করেছিলেন আভা। তাঁকে দেশে ফিরতে বলা হয়েছে। ভারতীয় অলিম্পিক্স সংস্থা জানিয়েছে, তারা ৩০ জনেরই নাম পাঠিয়েছিলেন। সেখান থেকে আভার নাম বাদ দিয়েছে বিশ্ব সংস্থা। আভা প্রথমে অলিম্পিক্সের যোগ্যতা পাননি। জানা গিয়েছে, বিশ্ব অ্যাথলেটিক্স সংস্থার ডিএসডি (ডিফারেন্স অফ সেক্স ডেভেলপমেন্ট) নিয়ম হয়তো পূরণ করতে পারেননি আভা। অর্থাৎ, আভার শরীরের হরমোনে পুরুষালি ভাব রয়েছে। একটি সূত্র জানিয়েছে, ডোপ পরীক্ষায় ব্যর্থ হওয়ার ঘটনা যে হয়নি তা প্রায় পরিষ্কার। আভার নাম বাদ পড়ার সবচেয়ে বড় যে কারণ মনে হচ্ছে, তা হল তাঁর ডিএসডি নিয়ম পূরণ করতে না পারা। প্রথমে ভারতের অলিম্পিক্সের দলে আভা ছিলেন না। এপ্রিল মাসে ভুবনেশ্বরে ১৮.৪১ মিটার ছুড়ে শটপাটে সোনা জেতেন আভা। জাতীয় রেকর্ড গড়েন মেদিনীপুরের মেয়ে। পরে জাতীয় আন্তঃরাজ্য প্রতিযোগিতায় ১৭.৫৩ মিটার ছুড়ে সোনা জেতেন তিনি। তার জেরেই ক্রমতালিকার ভিত্তিতে ভারতীয় দলে ঢোকেন তিনি। কিন্তু তার পরেও আভা বাদ পড়লেন। অলিম্পিক্স শুরুর কয়েক দিন আগেও তাঁর বাদ পড়ার কারণ জানা যাচ্ছে না। ধোঁয়াশা থেকেই গিয়েছে।
সমালোচনার মুখে ভারতীয় অলিম্পিক্স সংস্থার প্রধান পিটি ঊষা—
ভারতের অলিম্পিক্স দলে রয়েছেন ১১৭ জন ক্রীড়াবিদ ও ১৪০ জন সাপোর্ট স্টাফ। ক্রীড়াবিদদের থেকে বেশি সাপোর্ট স্টাফ রেখেও সমালোচনার মুখে ভারতীয় অলিম্পিক্স সংস্থা। সেটাই মানতে পারছেন না ঊষা। একটি বিবৃতিতে ঊষা বলেন, “ভারতীয় অলিম্পিক্স সংস্থা ক্রীড়াবিদদের কথা মাথায় রেখে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যাতে অলিম্পিক্সে ভারত ভাল ফল করে তার জন্য কোনও ফাঁক রাখা হয়নি। আগে ক্রীড়াবিদ ও সাপোর্ট স্টাফের অনুপাত থাকত ৩:১। আমরা সেটা বদলে দিয়েছি। ক্রীড়াবিদের থেকে বেশি সাপোর্ট স্টাফ যাচ্ছে।” ঊষা জানিয়েছেন, ক্রীড়াবিদদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, সাপোর্ট স্টাফ হিসাবে কাদের কাদের তাঁদের দরকার। ক্রীড়াবিদদের প্রয়োজন অনুযায়ী সাপোর্ট স্টাফ দেওয়া হয়েছে। ১৪০ জনের মধ্যে ৬৮ জন কোচ। মনোবিদ থেকে শুরু করে স্পোর্টস সায়েন্স দলও পাঠানো হচ্ছে। তার পরেও কেন সমালোচনা হচ্ছে বুঝতে পারছেন না ঊষা। ভারতীয় অলিম্পিক্স সংস্থার প্রধান বলেন, “ক্রীড়া মন্ত্রক, জাতীয় ক্রীড়া সংস্থা, ভারতীয় অলিম্পিক্স সংস্থা ও কিছু বাণিজ্যিক সংস্থা মিলে এই অভূতপূর্ব কাজ করা হয়েছে। তার পরেও অনেকে অন্ধ হয়ে থাকছে। অলিম্পিক্স সংস্থার সমালোচনা করছে। এটা মেনে নেওয়া যায় না।”