হতাশ মোহনবাগানের খেলোয়াড় দিমিত্রি পেত্রাতোস। ছবি: এক্স।
মোহনবাগান ২ (কামিংস-পেনাল্টি, সাহাল)
নর্থইস্ট ইউনাইটেড ২ (আজারাই, গিলেরমো)
(টাইব্রেকারে ৪-৩ গোলে জয়ী নর্থইস্ট)
দ্বিতীয়ার্ধে আগাগোড়া ছন্নছাড়া ফুটবল। শেষমেশ হার টাইব্রেকারে। মোহনবাগানকে টানা তিন বার জেতাতে পারল না বিশাল-হাত। নর্থইস্ট ইউনাইটেডের কাছে টাইব্রেকারে হেরে ডুরান্ড কাপ হাতছাড়া হল মোহনবাগানের। প্রথম বারের মতো ডুরান্ড জিতল নর্থইস্ট ইউনাইটেড। নির্ধারিত সময়ে খেলা ২-২ থাকার পর টাইব্রেকারে ৪-৩ গোলে জিতল পাহাড়ের দলটি। মোহনবাগানের লিস্টন কোলাসো এবং শুভাশিস বসুর শট বাঁচিয়ে নায়ক নর্থইস্ট ইউনাইটেডের গোলকিপার গুরমিত। গ্যালারিতে বসে গোটা ম্যাচ দেখলেন নর্থইস্টের কর্ণধার তথা অভিনেতা জন আব্রাহাম। প্রথমার্ধে চিন্তায় থাকলেও ম্যাচের শেষে তাঁর মুখে হাসি। দল প্রথম সর্বভারতীয় ট্রফির স্বাদ পেল যে!
দু’গোলে এগিয়েও টাইব্রেকারে মোহনবাগানের এই হার এটাই প্রমাণ করল, এখনও দলে বিস্তর ফাঁকফোকর রয়েছে। দ্বিতীয়ার্ধে মোহনবাগান যে ফুটবল খেলেছে তাঁকে ছন্নছাড়া বললেও কম বলা হয়। দলের ফুটবলারদের মধ্যে না ছিল কোনও বোঝাপড়া, না ছিল কোনও পরিকল্পনা। কে কাকে পাস দেবেন, কে কী ভাবে আক্রমণ করবেন তাই বুঝতে পারছিলেন না। ডাগআউটে থাকা কোচ হোসে মোলিনাও কোনও উপায় বার করতে পারলেন না দলকে এই পরিস্থিতি থেকে বার করে আনার। ফলস্বরূপ মোহনবাগানকে হারতে হল টাইব্রেকারে।
মরসুম শুরুর আগেই চার-চার জন আক্রমণ ভাগের খেলোয়াড় সই করিয়েছিল মোহনবাগান। জেসন কামিংস, দিমিত্রি পেত্রাতোসকে রেখে দেওয়ার পাশাপাশি নেওয়া হয়েছিল গ্রেগ স্টুয়ার্ট এবং জেমি ম্যাকলারেন। সেই ম্যাকলারেন এখনও মাঠে নামতে পারেননি। কিন্তু বাকি তিন জনের অবস্থা যে খুব ভাল তা নয়। তার থেকেও বড় কথা, মোহনবাগানের মিডফিল্ড বলে কিছুই তৈরি হয়নি এখনও পর্যন্ত। ভারতীয় ফুটবলারদের উপরেই ভরসা রেখেছেন মোলিনা। কিন্তু এই মিডফিল্ড নিয়ে আইএসএল বা এএফসি চ্যাম্পিয়ন্স লিগে কী হবে, তা নিয়ে এখন থেকেই আতঙ্কিত সমর্থকেরা।
তেমনই তথৈবচ অবস্থা রক্ষণের। প্রথমার্ধে চোট পেয়ে আলবের্তো রদ্রিগেস উঠে যাওয়ার পরেই নড়বড়ে লাগছিল মোহনবাগানকে। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে তারা যে এ ভাবে আত্মসমর্পণ করবে, তা কেউই ভাবতে পারেননি। দলের মধ্যে বার বার বোঝাপড়া এবং আত্মবিশ্বাস অভাব ধরা পড়েছে। রক্ষণ নিয়েও যথেষ্ট ভাবতে হবে দল পরিচালন সমিতিকে।
ফাইনালে দিমিত্রি পেত্রাতোসকে প্রথম একাদশে রাখেননি কোচ মোলিনা। সামনে রেখেছিলেন কামিংস এবং মনবীর সিংহকে। কিছুটা পিছন থেকে খেলছিলেন গ্রেগ স্টুয়ার্ট। যুবভারতীতে ম্যাচের শুরু থেকে আক্রমণাত্মক লাগছিল নর্থইস্টকেই। বল অনেক বেশি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখে খেলার চেষ্টা করছিল তারা। বেশ কয়েক বার আক্রমণও তুলে আনে মোহনবাগানের বক্সে। কিন্তু গোল করতে সফল হয়নি।
তবে খেলা যত এগোতে থাকে তত মোহনবাগানের প্রাধান্য বাড়তে থাকে। ১০ মিনিটেই প্রথম গোল পেয়ে যায় তারা। ডান দিক থেকে সাহালের উদ্দেশে বল ভাসিয়েছিলেন স্টুয়ার্ট। সাহাল সেই বল নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে গোলের দিকে ঘুরেও গিয়েছিলেন। এমন সময় তাঁকে জার্সি ধরে টেনে ফেলে দেন আশির আখতার। রেফারি পেনাল্টির সিদ্ধান্ত দিতে দেরি করেননি। পেনাল্টি থেকে নর্থইস্ট গোলকিপার গুরমিতকে উল্টো দিকে ফেলে ঠান্ডা মাথায় গোল করেন কামিংস।
গোল করে মোহনবাগানের আক্রমণের তীব্রতা আরও বাড়তে থাকে। নর্থইস্টের ফুটবলারেরা পাল্লা দিতে পারছিলেন না। ১৯ মিনিটের মাথায় সহজ সুযোগ নষ্ট করেন স্টুয়ার্ট। বাঁ দিক থেকে একাই বল নিয়ে বিপক্ষের বক্সে ঢুকে পড়েছিলেন। সামনে একা গোলকিপারকে পেয়েও বারের উপর দিয়ে বল উড়িয়ে দেন। দু’মিনিট পরেই সমতা ফেরানোর সুযোগ এসেছিল নর্থইস্টের কাছে। আলাদ্দিন আজারাইয়ের ক্রস থেকে জিতিনের হেড বাঁচিয়ে দেন বিশাল।
এর পর দু’দলের খেলার মধ্যেই আক্রমণ-প্রতি আক্রমণের খেলা চলতে থাকে। কিছুটা মন্থরও হয়ে পড়ে ম্যাচের গতি। চোট পেয়ে মাঠ ছাড়েন মোহনবাগানের আলবের্তো রদ্রিগেস। মাঠ ছাড়েন নর্থইস্টের মহম্মদ আলি বেমামেরও।
প্রথমার্ধের সংযুক্তি সময়ে ব্যবধান বাড়ায় মোহনবাগান। সাহাল গোল করলেও কৃতিত্ব পুরোপুরি প্রাপ্য লিস্টন কোলাসোর। নর্থইস্টের একাধিক ডিফেন্ডারকে এড়িয়ে বাঁ প্রান্ত ধরে দৌড়ে নর্থইস্ট বক্সে ঢুকে পড়েন। সেখান থেকে মাপা পাস পৌঁছয় সাহালের কাছে। চলতি বলে হালকা শটে বল জালে জড়িয়ে দেন কেরলের ফুটবলার।
দ্বিতীয়ার্ধে সাহালকে তুলে নিয়ে পেত্রাতোসকে নামিয়ে দেন মোলিনা। লক্ষ্য স্পষ্ট, আরও গোল করে ৯০ মিনিটেই জয় নিশ্চিত করতে চাইছিলেন তিনি। কিন্তু ফল হয় উল্টো। তিন মিনিটের ব্যবধানে দু’টি গোল হজম করে মোহনবাগান।
শুরু থেকেই দাপটের সঙ্গে খেলতে থাকে নর্থইস্ট। একের পর এক আক্রমণ করতে থাকে মোহনবাগানের বক্সে। সাফল্যও পায়। ৫৫ মিনিটের মাথায় একটি গোল শোধ করেন আলাইদ্দিন আজারাই। মোহনবাগানের বক্সের ঠিক বাইরে বল পেয়ে বাঁ দিকে থাকা আজারাইকে বল পাস করেন জিতিন। সেই বলে প্রথম পোস্টের নিখুঁত জায়গায় শট রেখে বিশালকে পরাস্ত করে গোল করেন মরক্কোর খেলোয়াড়।
তিন মিনিট পর তাঁর পাসেই সমতা ফেরায় নর্থইস্ট। বাঁ প্রান্তে বল পেয়ে ভাসিয়েছিলেন ডান দিকে থাকা গিলেরমো ফের্নান্দেসকে লক্ষ্য করে। চলতি বলে জোরালো শটে গোল করেন ফের্নান্দেস। বিশালকে নড়ারও সুযোগ দেননি। মুহূর্তের মধ্যে বদলে যায় খেলার গতিপ্রকৃতি। গোল পেয়ে তেড়েফুঁড়ে খেলতে শুরু করে নর্থইস্ট। আরও একটি গোল করে ম্যাচ শেষ করে দিতে চাইছিল তারা।
৬৮ মিনিটে গোলের সুযোগ পেয়েছিলেন জিতিন। আশিস রাইয়ের হেড গিয়ে পড়ে তাঁর পায়ে। জোরালো ভলি মেরেছিলেন। বিশাল তা কোনও মতে বাঁচিয়ে দেন। ৭৪ মিনিটে সুযোগ এসেছিল গিলেরমোর কাছে। টম অলড্রেডকে কাটিয়ে শট নিলেও তা বিশাল বাঁচিয়ে দেন। মোহনবাগানের রক্ষণ ভাগ তখন হতভম্ব। কী করবে কিছুই বুঝতে পারছিল না। বিশাল না থাকলে ৯০ মিনিটেই খেলা শেষ করে দিতে পারত নর্থইস্ট। খেলার শেষ দিকে পেত্রাতোসের একটি শট বাদে মোহনবাগানের বলার মতো কিছু নেই।
টাইব্রেকারে কামিংসের প্রথম শটই বারের উপর দিয়ে উড়ে গিয়েছিল। কিন্তু নর্থইস্ট গোলকিপার এগিয়ে আসায় রেফারি কামিংসকে আবার শট মারার নির্দেশ দেন। এ বার আর কামিংস ভুল করেননি। এর পর মোহনবাগানের মনবীর গোল করলেও লিস্টনের শট বাঁচান গুরমিত। অন্য দিকে, গিলেরমো, মিগুয়ের জ়াবাকো এবং পার্থিব গগৈ গোল করে নর্থইস্টকে ৩-২ এগিয়ে দিয়েছেন। চতুর্থ শটে পেত্রাতোস গোল করেন। পঞ্চম শটে আজারাই নর্থইস্টের হয়ে ৪-৩ করেন। শুভাশিসের উপর ভার ছিল মোহনবাগানকে বাঁচানোর। বাঙালি ফুটবলারের দুর্বল শট অনায়াসেই বাঁচিয়ে নর্থইস্টকে জিতিয়ে দেন পঞ্জাব-তনয় গুরমিত।