ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো (বাঁ দিকে) এবং লিয়োনেল মেসি। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
ফুটবল জীবনের শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছেন লিয়োনেল মেসি। নিজের ৩৬তম জন্মদিনে এসে আর কোনও আক্ষেপ থাকার কথাই নয় তাঁর। তবু আর্জেন্টিনার ফুটবলারকে নিয়ে চর্চা এখনও থামেনি। বিশ্বকাপ জেতার পরেও কোথাও না কোথাও ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর সঙ্গে এখনও তাঁর তুলনা টানা হয়। গত ২০ বছর ধরে ফুটবলবিশ্বকে আনন্দ দিয়েছেন তাঁরা। কে সেরা, সেই আলোচনা আর কিছু দিন পরেই হয়তো শেষ হয়ে যাবে। তবু মেসির ৩৬তম জন্মদিনের আগে আরও এক বার সেই আলোচনা ফিরে দেখা হল।
মেসির ৩৫ এবং ৩৬তম জন্মদিনের মাঝের সময়টায় কত কিছুই বদলে গিয়েছে। ৩৫তম জন্মদিন পূরণ হওয়ার সময় মেসির ট্রফি ক্যাবিনেটে সব কিছুই ছিল, শুধু বিশ্বকাপটা ছিল না। ৩৬তম জন্মদিনে সেই আক্ষেপ মিটে গিয়েছে। খেলা ছেড়ে দেওয়ার পরে মেসি যা-ই করুন, মাঝের এই ৩৬৫ দিনের কথা তিনি কখনওই ভুলতে পারবেন না। বিশ্বকাপ জেতার পর মেসির জীবনের সমস্ত অনুপ্রেরণা শেষের দিকে।
অনেক টালবাহানার পর মেসি নিজের নতুন ক্লাব বেছে নিয়েছেন। সৌদিতে যাবেন, না কি বার্সেলোনায় ফিরবেন, বেশ কিছু দিন এই চর্চা চলার পর সুদূর আমেরিকায় পাড়ি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মেসি। সেই সঙ্গে এটাও জানিয়েছেন, এই বয়সে এসে আর টাকার দরকার নেই। মেসি সৌদি আরবে গেলে আরও এক বার রোনাল্ডোর সঙ্গে তাঁর তুলনা হতেই পারত। স্পেনের পর আবার একটি লিগে তাঁদের একে অপরের বিরুদ্ধে খেলতে দেখা যেত। মেসি নিজেই সেই সম্ভাবনা শেষ করে দিয়েছেন। তবু এটা মনে রাখা দরকার যে, একটা প্রজন্ম বুঁদ হয়ে থেকেছে এই দুই ফুটবলারে। মেসি এবং রোনাল্ডোও একে অপরকে ছাপিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে গিয়েছেন। সেই লড়াই, সেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়তো শেষ হতে চলেছে।
স্পেনের লিগে খেলার সময় বার্সেলোনার মেসি (বাঁ দিকে) এবং রিয়ালের রোনাল্ডো। — ফাইল চিত্র
আশ্চর্যের হলেও সত্যি, এক সময় মেসি ও রোনাল্ডো সতীর্থ হতে পারতেন। সময়টা ২০০৩-এর মাঝামাঝি। মেসি তত দিনে বার্সেলোনার যুব দলে তারকা হয়ে উঠেছেন। অন্য দিকে রোনাল্ডো মাতাচ্ছেন পর্তুগালে লিসবনের হয়ে। বার্সেলোনা আগ্রহী ছিল লিসবন থেকে রোনাল্ডোকে কিনতে। কিন্তু সেই সময় পর্তুগালের ক্লাবটির তরফে যে দাম চাওয়া হয় তা দিতে রাজি হয়নি তারা। রোনাল্ডো যোগ দেন ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডে।
দু’জনের বয়সে ২৮ মাসের পার্থক্য থাকলেও ফুটবলজীবন তুঙ্গে উঠেছে একই সময়ে। ২০০৭-এ ব্রাজিলের কাকা বালঁ দ্যর জেতার বছরে রোনাল্ডো ছিলেন দ্বিতীয়, তার পরেই মেসি। পরের বছরই রোনাল্ডো এই পুরস্কার জেতেন। মেসি ছিলেন দ্বিতীয় স্থানে। ২০০৯-এ রোনাল্ডোকে পিছনে ফেলে মেসির হাতে ওঠে বালঁ দ্যর। সেই বছরই ম্যান ইউ ছেড়ে রিয়ালে যোগ দেন রোনাল্ডো। দুই ফুটবলার হয়ে ওঠেন একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী।
চ্যাম্পিয়ন্স লিগে খেলার সময় জুভেন্টাসের রোনাল্ডো (বাঁ দিকে) এবং বার্সেলোনার মেসি। — ফাইল চিত্র
কী দিয়ে সেরার বিচার করা যেতে পারে? অনেকে গোলসংখ্যার কথা বলবেন। প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক ফুটবলে ধারাবাহিক ভাবে গোল করে যাওয়া ফুটবলারের সংখ্যা খুব বেশি নয়। সে দিক থেকে এগিয়ে থাকবেন রোনাল্ডো। তবে এ ক্ষেত্রে তাঁকে সাহায্য করবে পেনাল্টি নেওয়ার দক্ষতা। পেনাল্টি নিয়ে রোনাল্ডোর গোলসংখ্যা এই মুহূর্তে ৮৩৮। মেসির ৮০৭। কিন্তু পেনাল্টি বাদ দিলে মেসি এগিয়ে থাকবেন। আর্জেন্টিনার ফুটবলারের গোল ৬৬০। রোনাল্ডোর ৬৫৭। মাথায় রাখতে হবে রোনাল্ডোর পেশাদার জীবনের দৈর্ঘ্য মেসির থেকে বেশি।
এ ছাড়া অ্যাসিস্ট, অর্থাৎ সতীর্থকে দিয়ে গোল করানোর ক্ষেত্রে মেসি অনেকটাই এগিয়ে।রোনাল্ডো ভাল গোলদাতা হতে পারেন।কিন্তু ভাল গোলদাতার পাশাপাশি সুযোগ তৈরির বিচারে এগিয়ে মেসি।রোনাল্ডো এ ক্ষেত্রে এক সময় টক্কর দিতেন ভালই। কিন্তু ২০১৫ থেকে হাঁটুর চোটে ভোগার পর থেকে তিনি নিজের পজিশন পাল্টে নেন। উইং থেকে সরে এসে ফরোয়ার্ডে খেলতে থাকেন। তখন গোল করানোর থেকে করাই তাঁর মূল কাজ হয়ে ওঠে। সেখানে মেসি এখনও কিছুটা পিছন থেকে খেলেন এবং গোল করাতে ভালবাসেন। তাই তাঁর অ্যাসিস্টও বেশি।
তবে অতীতে তারকা ফুটবলারদের থেকে মেসি এবং রোনাল্ডোর মূল বৈশিষ্ট্য হল, দু’জনেই টানা দু’দশক ধরে খেলে যেতে পেরেছেন। মেসি, রোনাল্ডোর আগে এতটা দীর্ঘ সময় ধরে ফুটবলপ্রেমীরা তারকাপুজো করেননি। ফুটবলে তখন ‘সুপারহিরো’র অভাব ছিল। তাই কখনও কাকা, কখনও জিদান, কখনও কানাভারো সেই জায়গা নিতেন।
প্রদর্শনী ম্যাচে প্যারিস সঁ জরমেঁর মেসি (বাঁ দিকে) এবং আল নাসেরের রোনাল্ডো। — ফাইল চিত্র
দ্বিতীয়ত, টিভি চ্যানেলের উত্থান। ১৯৯০-এর আগে বিশ্ব জুড়ে খুব কম ফুটবল ম্যাচই টিভিতে দেখানো হত। বেতনও ছিল নামমাত্র। সেরা ফুটবলারেরা ‘রকস্টার’দের মতো জীবন কাটাতেন। যেমন, জর্জ বেস্ট নেশাগ্রস্ত ছিলেন। জোহান ক্রুয়েফ ধূমপায়ী। দিয়েগো মারাদোনার ছিল নারীসঙ্গ এবং ড্রাগের নেশা। কিন্তু রুপার্ট মার্ডক এবং অধুনা প্রয়াত সিলভিয়ো বার্লুস্কোনির সৌজন্যে টেলিভিশনে নতুন বিপ্লব আসার সঙ্গে সঙ্গে তারকাপুজো বেড়ে গেল। রঙিন টিভিতে প্রিয় ফুটবলারদের দেখার সুযোগ পাওয়া গেল। রাতারাতি ক্লাবগুলি দলের তারকা ফুটবলারদের ধরে রাখার জন্যে উঠেপড়ে লাগল। কারণ যার দলে যত বেশি তারকা, তার বাজারদর তত বেশি। ফলে বেতন বাড়তে লাগল হু হু করে। মেসি এবং রোনাল্ডোও সেই জোয়ারে গা ভাসালেন।
টেলিভিশনের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে ফুটবলের নিয়মেও নিঃশব্দে কিছু বদল ঘটে গেল। রেফারিরা কড়া হলেন। ফাউল, ট্যাকলের ক্ষেত্রে অনেক বিধিনিষেধ এল। এমনকি রেফারি কোনও ফাউল দেখতে না পেলেও ক্যামেরায় তাঁর ধরা পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। সাধে কি সেই ২০০৫-এ মেসি বলেছিলেন, “পেশাদার ফুটবলে রেফারিদের সৌজন্যে চোরা মার কাকে বলে তা ভুলেই গিয়েছি। স্কুলে ‘আসল’ ফুটবলটা খেলেছিলাম।” মেসি এবং রোনাল্ডো তারকা হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁদেরও আলাদা ‘সুরক্ষা’ দেওয়া হতে লাগল।
আন্তর্জাতিক ফুটবলের ম্যাচে পর্তুগালের রোনাল্ডো (বাঁ দিকে) এবং আর্জেন্টিনার মেসি। —ফাইল চিত্র
একই সঙ্গে উন্নতি হতে লাগল ফুটবলারদের খাবার এবং অনুশীলন পদ্ধতির। কোচেরা নিত্যনতুন কৌশল আবিষ্কার করতে শুরু করলেন। প্রথম দিকে যে মেসি ছিলেন রোগা, অপুষ্টিতে ভোগা এক কিশোর, আধুনিক পদ্ধতির দৌলতে তিনিই শক্তিশালী ফুটবলার হয়ে গেলেন। মেসি এক সময় বলেছিলেন, “ছোটবেলার প্রচুর চকোলেট, নরম পানীয় খেয়েছিলাম। সে কারণে মাঠে নেমে অনেক বার বমি হয়েছে। এখন আমার খাবারদাবার অনেক ভাল।” রোনাল্ডো আবার গোড়া থেকেই নিজের শরীর-স্বাস্থ্যের ব্যাপারে সচেতন। যত সময় গিয়েছে ততই তিনি নিজের শরীর নিয়ে সচেতন হয়ে উঠতে শুরু করেন।
দু’জনের দ্বৈরথের একটা মূল কারণ, একে অপরকে ছাপিয়ে সেরা হয়ে ওঠার প্রচেষ্টা। দু’জনের কেউই কখনও তা স্বীকার করেননি। কিন্তু সেরা হয়ে ওঠার লড়াইয়ে কখনও পিছিয়েও আসেননি। সেরা ফুটবলারেরা যে একে অপরের দিকে নজর রাখেন, এটা সম্প্রতি বলেছিলেন ফ্রান্সের আর এক প্রতিভা কিলিয়ান এমবাপে। তাঁর কথায়, “আপনি যে কাজের সঙ্গে যুক্ত, সেই কাজে যে সেরা তার দিকে সব সময় লক্ষ্য রাখুন। যে কেক বানায়, সে সব সময় খেয়াল করে সবচেয়ে ভাল কেকটা কে বানাচ্ছে? মেসির ভালর পিছনে যেমন রোনাল্ডোর অবদান রয়েছে, তেমনই রোনাল্ডোর পিছনেও মেসির অবদান রয়েছে। একে অপরের দিকে খেয়াল না রাখলে টানা ১৫ বছর কোনও ভাবেই সেরা থাকতে পারত না।”
বালঁ দ্যরের অনুষ্ঠানে রোনাল্ডো (বাঁ দিকে) এবং মেসি। — ফাইল চিত্র
কী ভাবে ফুটবলাররা নজর রাখেন, তার একটা উদাহরণ এমবাপে নিজেই দিয়েছেন। ২০১৮-১৯ মরসুমের কথা উল্লেখ করে এমবাপে বলেছেন, “আমি দু’গোল করছি, তো মেসি তিন গোল করছে। আমি তিনটে করলে ও চারটে গোল করছে। এক সময় আমি ডেম্বেলেকে (তখন বার্সেলোনায় মেসির সতীর্থ ছিলেন) জিজ্ঞাসা করেছিলাম, মেসি কি ইচ্ছে করে এটা করছে? ও বলেছিল, ঠিক। মেসি লক্ষ্য রাখছে আমার উপর।” সে বার ইউরোপের সর্বোচ্চ গোলদাতা হন মেসি। তাঁর ৩৬টি গোল ছিল। এমবাপের ৩৩।
মেসি-রোনাল্ডোর দ্বৈরথের সঙ্গে আরও একটি লড়াইয়ের তুলনা টানা যেতে পারে। টেনিসে রজার ফেডেরার এবং রাফায়েল নাদালের দ্বৈরথ। ফেডেরার অনেক আগে শুরু করেছিলেন। নাদাল আসার আগে পর্যন্ত তাঁকে যোগ্য এক জন প্রতিদ্বন্দ্বীর জন্যে অপেক্ষা করতে হয়েছিল। কিন্তু পরের দিকে ফেডেরার স্বীকার করে নিয়েছিলেন, নাদাল না থাকলে তাঁর এই সাফল্য আসত না।
একই ভাবে তুলনা টানা যেতে পারে জন ম্যাকেনরো এবং বিয়র্ন বর্গের। দ্বিতীয় জন আচমকাই ১৯৮৩ সালে টেনিস ছেড়ে দেন, যা অবাক করেছিল ম্যাকেনরোকে। অনেক বছর পরে বলেছিলেন, “খুব ভাল হত যদি আরও কয়েক বছর ওর বিরুদ্ধে খেলতে পারতাম। ওকে ছাড়া এই সাফল্য সম্ভব ছিল না। ওর কাছে এক নম্বর র্যাঙ্কিং হারিয়েছিলাম। কোনও দুঃখ নেই তাতে। কিন্তু আরও কয়েক বছর খেললে ভাল হত।”
২০০৮ থেকে ২০২১— মাঝের এই ১৩ বছরে মেসি সাত বার বালঁ দ্যর জিতেছেন, রোনাল্ডো পাঁচ বার। তার আগে কেউ তিনটেও জেতেননি। ২০১৯-এ চ্যাম্পিয়ন্স লিগের একটি অনুষ্ঠানে অংশ নিতে গিয়ে মেসি বলেছিলেন, “খুব সুন্দর একটা শত্রুতা। ও মাদ্রিদে থাকার সময়টা উপভোগ করেছি।” রোনাল্ডো পাল্টা বলেন, “আমাদের মতো ১৫ বছর ধরে এই লড়াই ফুটবলে আগে কোনও দিন দেখা গিয়েছে বলে মনে হয় না। আশা করি ওকে নিয়ে এক দিন নৈশভোজে যেতে পারব।”
আসলে রোনাল্ডো বা মেসি এমন গোত্রের ফুটবলার, যাঁদের মধ্যে যে কোনও এক জনের সমর্থক হওয়া মুশকিল। কেউ যতই রোনাল্ডোর কট্টর সমর্থক হোন না কেন, ফুটবল ভালবাসলে মেসির খেলা তাঁকে মুগ্ধ করবেই। একই কথা প্রযোজ্য রোনাল্ডোর ক্ষেত্রেও। আসলে শুধু দুই ফুটবলারই নয়, তাঁদের সমর্থকেরাও বরাবর নজর রেখে গিয়েছেন একে অপরের প্রতি। তাই তুলনা টানতে গেলে কখনওই এক জনের নাম বলা যাবে না।
কারণ, মেসি-রোনাল্ডো একে অপরের পরিপূরক।