সেমিফাইনালে হেরে হতাশ মরক্কোর ফুটবলাররা। স্বপ্নভঙ্গের কান্না হাকিমির। সান্ত্বনা সতীর্থের। ছবি: রয়টার্স
এ বারের বিশ্বকাপের চমক মরক্কো। যে ভাবে গ্রুপ পর্ব থেকে সেমিফাইনাল পর্যন্ত তারা খেলেছে তাতে বিশ্ব ফুটবলে আরবের এই দেশ এক বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে। ফুটবলের মধ্যে দিয়ে দেশকে এক সম্মানের আসনে বসিয়েছেন আশরফ হাকিমি, হাকিম জিয়েচরা। গোটা বিশ্ব কুর্নিশ করছে তাদের লড়াইকে। সেমিফাইনালে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সের কাছে হারলেও গোটা বিশ্বের মন জয় করেছে তারা।
কিন্তু এটা কি নিছকই ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে পিছিয়ে পড়া একটি দেশের লড়াই, ইতিহাসের কাল বেয়ে উঠে আসা আরবের একটি দেশের নিজেকে মেলে ধরার গল্প, না কি ফুটবলের মাধ্যমে বিশ্বে নিজেদের সম্মান আদায়ের কাহিনি। এ বছরের বিশ্বকাপে মরক্কো যে ফুটবল খেলছে তাতে বলা যেতে পারে, ফুটবল শুধু মাত্র আর ইউরোপ বা লাতিন আমেরিকায় সীমাবদ্ধ নেই, বরং তা দেশ-কালের সীমানা ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছে গোটা বিশ্বে।
সেমিফাইনালে মরক্কো এমন একটা দেশের বিরুদ্ধে খেলতে নেমেছিল, যে দেশ ৪৪ বছর তাদের শাসন করেছে। শুধু তাই নয়, স্বাধীন হওয়ার পরেও দুই দেশের সংস্কৃতির এক অদ্ভুত মেলবন্ধন হয়েছে। মরক্কোর প্রায় ৫০ লাখ বাসিন্দা থাকেন ফ্রান্সে। তাঁদের একটা বড় অংশের দু’দেশেরই নাগরিকত্ব রয়েছে। মরক্কোর কোচ ওয়ালিদ রেগরাগুই এবং দুই ফুটবলার রোমান সাইস ও বৌফাল মরক্কোর পাশাপাশি ফ্রান্সেরও নাগরিক। এমন অনেক সমর্থক কাতারে এসেছেন যাঁদের বাবা-মায়ের এক জন মরক্কোর, তো অন্য জন ফ্রান্সের।
দু’দেশের দুই সেরা ফুটবলার কিলিয়ান এমবাপে ও আশরফ হাকিমিও খুব ভাল বন্ধু। ক্লাবে সতীর্থ তাঁরা। কিন্তু সেমিফাইনালে নিজের নিজের দেশের জন্য তাঁরা খেললেন। মরক্কো দেখাল, ধারে ভারে তারা ফ্রান্সের থেকে যতই পিছিয়ে থাকুক না কেন, আবেগ ও আত্মবিশ্বাস কোনও দলকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে। বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সের বিরুদ্ধে সমানে সমানে লড়াই করল তারা। শুরুতে গোল খাওয়ার পরেও হতোদ্যম না হয়ে পুরো শক্তি নিয়ে ঝাঁপাল। একটা সময় দেখে মনে হচ্ছিল, কোনও রকমে গোল বাঁচানোর চেষ্টা করছে ফ্রান্স। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হার মানতে হয়েছে মরক্কোকে। তার একমাত্র কারণ, সুযোগ কাজে লাগাতে না পারা। শেষ পর্যন্ত ফ্রান্সের কাছে ০-২ গোলে হেরে স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে মরক্কোর।
মাথা উঁচু করে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিয়েছে মরক্কো। খেলায় সমানে সমানে টক্কর দিয়েছে তারা। কোনও কোনও সময় তো বিশ্বচ্যাম্পিয়নদেরও টেক্কা দিয়েছেন রেগরাগুইয়ের ছেলেরা। গোল লক্ষ্য করে শট বেশি মেরেছে তারা। কিন্তু সুযোগ কাজে লাগাতে পারেনি। খেলা শেষ হওয়ার ১১ মিনিট আগে এমবাপের শট মরক্কোর ডিফেন্ডারের গায়ে লেগে পৌঁছয় কোলো মুয়ানির কাছে। ফরাসি ফুটবলার দলের দ্বিতীয় গোল করার পরেই স্বপ্ন শেষ হয়ে যায় মরক্কোর।
এ বারের বিশ্বকাপে মরক্কোর ফুটবলাররা যে খেলাটা খেলেছেন, হয়তো পরে এ রকম আর খেলতে পারবেন না তাঁরা। কিন্তু ২৮ দিন ফুটবল বিশ্বকে আনন্দ দিয়েছেন তাঁরা। ফুটবলের শক্তিতে তথাকথিত পিছিয়ে থাকা দেশ সেরাদের চোখে চোখ রেখে খেলেছে। বিদায়ের আগে পর্যন্ত লড়াই করেছে।
হেরে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন মরক্কোর ফুটবলাররা। ছবি: রয়টার্স
এ বারের বিশ্বকাপে মরক্কো যে গ্রুপে ছিল সেখান থেকে প্রি-কোয়ার্টার ফাইনালে তাদের পৌঁছানোটাই অবিশ্বাস্য। গত বারের বিশ্বকাপের ফাইনালিস্ট ক্রোয়েশিয়া ও গত বারেরই তৃতীয় স্থানাধিকারী বেলজিয়ামের গ্রুপে ছিল তারা। কিন্তু সেখান থেকে তারা যে শুধু পরের ধাপে গিয়েছে তাই নয়, গ্রুপ শীর্ষে থেকে গিয়েছে। গ্রুপের একটি ম্যাচেও হারেনি মরক্কো। ক্রোয়েশিয়ার সঙ্গে ড্র করেছে। বেলজিয়াম ও কানাডাকে হারিয়েছে।
প্রি-কোয়ার্টার ফাইনালে মরক্কোর সামনে ছিল স্পেন। সেই স্পেন, যারা গ্রুপের প্রথম ম্যাচেই কোস্টা রিকাকে ৭ গোল দিয়েছিল। সেই স্পেনকেই হারিয়ে দিয়েছে মরক্কো। এই জয় কি শুধু ফুটবলের জয়? না কি ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে জিতেছে মরক্কো। একটা সময় স্পেনের অধীনে ছিল মরক্কো। তা হলে এই জয় তো শাসকের বিরুদ্ধে শোষিতের জয়ও।
ঘটনাচক্রে কোয়ার্টার ফাইনালে মরক্কোর সামনে এমন একটা দেশ পড়ল, যাদেরও ঔপনিবেশিক শাসনের ইতিহাস রয়েছে। পর্তুগাল। ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর পর্তুগালকেও হারিয়েছে মরক্কো।
না, এগুলো অঘটন নয়। কারণ, অঘটন এক বার হয়। বার বার হলে সেটা ঘটনা। আর ঘটনা বলছে, ক্রোয়েশিয়া, বেলজিয়াম, স্পেন, পর্তুগালের মতো ফুটবলের শক্তিশালী দেশের বিরুদ্ধে মরক্কো যে ফুটবল খেলেছে তা সমীহ করার মতো। কোনও ম্যাচেই কিন্তু রক্ষণাত্মক খেলেনি মরক্কো। বদলে আক্রমণাত্মক খেলে জিতেছেন। প্রতিপক্ষের চোখে চোখ রেখেছেন হাকিমি, জিয়েচরা। সেমিফাইনাল পর্যন্ত পাঁচ ম্যাচে মাত্র একটি গোল খেয়েছে তারা। সেটাও আত্মঘাতী। বিশ্ব ফুটবলের মঞ্চে আবির্ভাব হয়েছে এমন এক দেশের যারা পিছিয়ে পড়া, তৃতীয় বিশ্বের পতাকা বহন করছেন। হোক না সে ফুটবল মাঠে। মরক্কোর হাত ধরে স্বপ্ন দেখছে বিশ্ব ফুটবলের মঞ্চে পিছিয়ে থাকা আরও অনেক দেশ।