মেসিকে অবশেষে আর্জেন্টিনারই একজন মানছে সে দেশের অধিবাসীরা। ফাইল ছবি
দীর্ঘ ৩৬ বছর পর আবার বিশ্বকাপ জেতার সামনে দাঁড়িয়ে আর্জেন্টিনা। নিজের অধরা স্বপ্ন পূরণ করার জন্যে অপেক্ষা করছেন লিয়োনেল মেসিও। কিন্তু প্রশ্নটা না চাইতেও উঠে আসছে, বিশ্বকাপ জিতলে সেটা কি আর্জেন্টিনা জিতবে, না কি জিতবেন মেসি? অনেকেই প্রশ্ন তুলতে পারেন, আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয় আর মেসির বিশ্বকাপ জয় আলাদা হতে পারে নাকি? হতে পারত। তবে এখন আর নয়। এখন আর্জেন্টিনা এবং মেসির বিশ্বকাপ জেতা সমার্থক। মেসি এখন আর্জেন্টিনারই একজন।
তা হলে কি এত দিন মেসি আর্জেন্টিনার কেউ ছিলেন না? কেন তা হলে স্পেনের হয়ে খেলার সুযোগ থাকলেও তিনি নামেন নিজের জন্মদেশের হয়েই? ঘটনাপ্রবাহ বলছে, মেসি জন্মসূত্রে আর্জেন্টিনার হলেও, এত দিন আর্জেন্টিনার কেউ হয়ে উঠতে পারেননি। কিছু দিন আগে পর্যন্ত দেশের এক বড় সংখ্যক মানুষ মনে করতেন, মেসি যতই আর্জেন্টিনার হয়ে খেলুন, তিনি আসলে সেই দেশের নন। তিনি বার্সেলোনার। দেশের হয়ে সাফল্য না থাকাই তার কারণ। তবে গত কয়েক বছরে সেটা অনেকটাই বদলেছে। এত দিন যাঁরা মেসির সমালোচনা করতেন, তাঁরাই এখন মেসিকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছেন। রবিবার দোহাতে যে কাতারে কাতারে আর্জেন্টিনীয় সমর্থক দেখা যাচ্ছে, তাঁরা এসেছেন মেসির টানেই। পাঁচ কোটির দেশ রবিবার বেলায় (আর্জেন্টিনার স্থানীয় সময়) যখন খেলা দেখতে বসবেন, তখন চোখ থাকবে এক জনের দিকেই। তিনি লিয়োনেল মেসি। আর্জেন্টিনার নয়নের মণি।
সময়টা ২০১১। কলম্বিয়ার বিরুদ্ধে গোলশূন্য ড্র করেছিল আর্জেন্টিনা। সেই ম্যাচেই মেসিকে শুনতে হয়েছিল ব্যাঙ্গাত্মক শিস। সমালোচনায় ভরিয়ে দিয়েছিলেন সমর্থকেরা। “ধুর, ও খেলতেই পারে না। ও আসার পর থেকে আমরা কিছুই জিতিনি,” বলেছিলেন খেলা দেখতে আসা এক সমর্থক। আর এক জন বলেছিলেন, “মেসির সঙ্গে কোনও দিন মারাদোনার তুলনা করা উচিত নয়। ও কোনও দিন মারাদোনা হতে পারে না।” আর্জেন্টিনার মতো ফুটবল পাগল দেশ খুব কমই আছে। সেখানে মারাদোনার পর যদি কোনও উজ্জ্বল নক্ষত্র এসে থাকেন, তা হলে নিঃসন্দেহে তিনি মেসি। অথচ, কয়েক বছর আগে পর্যন্ত মেসিকে পাত্তা দিত না আর্জেন্টিনা। রোসারিয়ো শহরে জন্ম হলেও মেসি বেড়ে উঠেছেন ইউরোপে। একের পর এক ট্রফি জিতেছেন বার্সেলোনার হয়ে। আর্জেন্টিনায় থেকে যেতে হয়েছে নিজের ছায়া হয়েই। মারাদোনার মধ্যে যে আর্জেন্টিনীয় চরিত্র ছিল, সেটাই কোনও দিন নাকি খুঁজে পাওয়া যায়নি মেসির মধ্যে।
রোসারিয়োর একটি বাড়িতে মেসির ছবি আঁকা। ছবি: রয়টার্স
সমালোচনা আরও বেড়ে যায় অল্প সময়ের জন্য আর্জেন্টিনা দল থেকে মেসি অবসর নিয়ে ফেলায়। কিন্তু ৩৫ বছরে এসে বিশ্বকাপে মাতিয়ে দেওয়ার পর আর্জেন্টিনা এখন নিজের ছেলেকে ‘আপন’ করে নিয়েছে। মেসির ছোটবেলার কোচ আদ্রিয়ান কোরিয়া বলেছেন, “গোটা বিশ্বে যেখানেই গিয়েছি সেখানে মেসিকে দেখার জন্য লোক হাঁকপাক করেছে। এখানে মেসি বিমানবন্দরে নামলে ওকে অভ্যর্থনা জানানোর কেউ থাকে না। এখন দেখছি সেটা অবিশ্বাস্য ভাবে বদলে গিয়েছে।”
আর্জেন্টিনার বেশির ভাগ শহরে গেলেই এখন দেওয়ালে দেখা যাবে মেসির ম্যুরাল। নীল-সাদা জার্সিধারী দশ নম্বরকে চিনে নিতে ভুল হওয়ার কথা নয়। রাঙিয়ে তোলা হয়েছি বাড়ি, হোটেল, কাফে, স্টেডিয়াম সর্বত্র। এর প্রধান কারণ দেশের হয়ে মেসির সাফল্য। গত বছর মেসি দেশকে কোপা আমেরিকা জিতিয়েছেন। দীর্ঘ ২৮ বছর পর অন্তর্মহাদেশীয় প্রতিযোগিতায় সেই সাফল্য পাল্টে দিয়েছে সব কিছু। এ বার দেশকে ফাইনালে সেই জনপ্রিয়তাকেই অন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে। ফলে এখন মেসিকে নিয়ে মাতামাতি শুধু রোসারিয়োয় নয়, গোটা দেশেই ছড়িয়ে পড়েছে। আর্জেন্টিনার ক্রীড়া সাংবাদিক সোফিয়া মার্তিনেস বলছিলেন, “ফলাফল যা-ই হোক, একটা জিনিস মেসির থেকে কেউ আর কেড়ে নিতে পারবে না। সেটা হল, মেসি এখন আর্জেন্টিনারই একজন। প্রত্যেকে এখন মেসিকে ভালবাসে। আশা করি, এ বার আর কেউ ফলাফল দিয়ে ওকে বিচার করবে না।”
মেসির ম্যুরান রোসারিয়োর রাস্তায়। ছবি: রয়টার্স
বুয়েনোস আইরেস থেকে চার ঘণ্টা লাগে রোসারিয়োয় ড্রাইভ করে যেতে। মূলত চাষাবাদের জন্যেই বিখ্যাত। ২০০১ সালে ১৩ বছর বয়সে ফুটবল প্রশিক্ষণ এবং শরীরে হরমোনের সমস্যা মেটাতে বার্সেলোনায় চলে গিয়েছিলেন মেসি। তখন থেকে সেখানেই রয়েছেন। ১৭ বছর বয়স থেকে প্রায় দু’দশক শুধু ইউরোপ নয়, গোটা বিশ্বকে মাতিয়ে দিয়েছেন। ক্লাবে যত সাফল্য পেয়েছেন, দেশে সমালোচনা ততই বেড়েছে। দেশেই চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিলেন মেসি। সাধে কি তাঁর ছোটবেলার আর এক কোচ ফাবিয়ান বাসুয়ালদো বলেছেন, “মেসিকে যা সহ্য করতে হয়েছে, আমি হলে কবেই আর্জেন্টিনার হয়ে খেলা ছেড়ে দিতাম। আগে তো বন্ধুবান্ধবদের আড্ডায় মেসি সম্পর্কে বলতাম, দয়া করে দেশে ফিরে এসো না। ইউরোপেই থাকো।”
মেসির বিরুদ্ধে ছিল দু’টি বিষয়। প্রথমত, তাঁর আগে দিয়েগো মারাদোনা নামে এক ব্যক্তিত্ব আর্জেন্টিনাকে ফুটবলের সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছে দিয়েছেন। তাঁর ছায়ার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হত সর্ব ক্ষণ। দ্বিতীয়, মেসির আচার-আচরণ। ১৯৮৬-এ যখন আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ জেতান মারাদোনা, তখন এবং বাকি জীবন তিনি ছিলেন কিছুটা উচ্ছৃঙ্খল, মেজাজি, খামখেয়ালি এবং দাপুটে। চারিত্রিক ভাবে মেসি এর উল্টো। মাঠে এবং মাঠের বাইরে আদ্যোপান্ত ভদ্র, মার্জিত, নম্র। বেশির ভাগ আর্জেন্টিনীয়ই মেসির সঙ্গে নিজেকে মেলাতে পারতেন না।
রোসারিয়োর রাস্তায় উড়ছে মেসির বৃহদাকার জার্সি। ছবি: রয়টার্স
সেটাও বদলে দিয়েছে এ বারের বিশ্বকাপের একটি ঘটনা। নেদারল্যান্ডসের বিরুদ্ধে আর্জেন্টিনা জেতার পর বিপক্ষের ফুটবলারকে উদ্দেশ্য করে মেসি বলেছেন, “এ দিকে তাকিয়ে কী দেখছ নির্বোধ?” তার আগে মাঠে ঝামেলা করেন রেফারির সঙ্গেও। বিপক্ষ কোচের চোখে চোখ রেখে কথা বলেন। তাতেই আর্জেন্টিনীয়রা মনে করছেন, এ তো আমাদেরই একজন! বিপক্ষ ফুটবলারের উদ্দেশে মেসির বলা ওই কথা এখন জাতীয় উচ্ছ্বাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংবাদপত্রগুলি অবশেষে লিখেছে, মেসি এখন মারাদোনার মতো আচরণ করছেন। মেসির ছোটবেলার ক্লাবের যিনি দেখভাল করেন, সেই রাউল অলিভিয়েরি বলেছেন, “মেসি বুঝিয়ে দিয়েছে ও আর্জেন্টিনারই। কোনও দিন এই দেশ ছেড়ে যায়নি।”
ইউরোপে কাটানো সত্ত্বেও প্রতি বছর রোসারিয়োয় নিজের বাড়ি যান মেসি। বিয়ে করেছেন সেখানকারই মেয়ে আন্তোনেল্লা রোকুজ়োকে। গত বছর এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “রোসারিয়োয় গেলেই মনটা ভাল হয়ে যায়। জানি না কী ভাবে এর ব্যাখ্যা দেব। নিজের মানুষ, বন্ধুবান্ধব, পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে, ওদের সঙ্গে বার্বিকিউ করতে ভাল লাগে। ছোটবেলায় স্পেনে চলে যাওয়ায় নিজের দেশটাকেই ভাল করে দেখতে পারিনি। তাই সেই আক্ষেপটা এখন পূরণ করে নিতে চাই।”
রোসারিয়োতে মেসির জনপ্রিয়তা এতটাই যে সেখানকার প্রায় প্রতিটি বাড়িতে তাঁর ম্যুরাল। তাঁকে নিয়ে একটি গান বানিয়ে ফেলেছে স্থানীয় ব্যান্ড। মেসি ছোটবেলায় যেখানে যেখানে যেতেন, যেখানে থাকতেন, যে স্কুলে পড়তেন, যে শিক্ষিকার কাছে পড়াশোনা করতেন, সবই এখন দর্শনীয় বিষয়। এখন আর সাফল্য মেসিকে আর্জেন্টিনীয় বলে প্রমাণ করে না। মেসি যে আর্জেন্টিনারই একজন, এটা মনে গেঁথে নিয়েছেন সে দেশের মানুষ।