FIFA World Cup 2022

চোখভরা শূন্যতা নিয়ে মাঠ ছাড়লেন মেসি, তাকিয়ে থাকলেন শুধু স্কোর বোর্ড আর রেফারির দিকে

শেষ বাঁশি বাজার পর মেসির মুখ ছিল অভিব্যক্তিহীন। সকলের সঙ্গে করমর্দন করলেন বটে। সেই সৌজন্য বিনিময় ছিল শুরুর মতোই পেশাদার মোড়কে ঢাকা। বাড়তি ছিল শুধু চোখে শূন্য দৃষ্টি।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ২২ নভেম্বর ২০২২ ১৯:২২
Share:

খেলা শেষ। সৌদি আরবের কাছে হার যেন বিশ্বাসই করতে পারছেন না মেসি। ছবি: রয়টার্স

ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেলেন লোকচক্ষুর আড়ালে। কিছুটা কি মিলিয়ে গেল তাঁর বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন? লিয়োনেল মেসির মুন্সিয়ানার ঝলকও জেতাতে পারল না অর্জেন্টিনাকে! আরও এক বার স্পষ্ট হয়ে গেল দিয়েগো মারাদোনার উত্তরসূরি হওয়া সহজ। কিন্তু মারাদোনা হওয়া নয়। জীবনের শেষ বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে দলকে একার দক্ষতায় উতরে দিতে পারলেন না মেসি।

Advertisement

সৌদি আরবের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় মিনিটেই গোল করার সহজ সুযোগ পেয়েছিলেন। গোল করতে পারলেন না মেসি। তাঁর দুর্বল শট আটকাতে তেমন বেগ পেতে হল না সৌদি গোলরক্ষককে। মেসির কি চোট আছে? প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডারকে ছিটকে দেওয়া মেসির গোলমুখী শট এত দুর্বল! বিশ্বাস করা কঠিন। যাঁর শিল্প ফুটবল বিশ্বকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছে এত বছর ধরে, তাঁকে শেষ বিশ্বকাপে কি সেরা ছন্দে দেখা যাবে না?

আসলে তা নয়। চকিতে ঘুরে শট নেওয়ার সময় বলের সঙ্গে তাঁর পায়ের সংযোগ ঠিক মতো হয়নি। ঠিক মতো সংযোগ হল ১০ মিনিটের মাথায়। পেনাল্টি থেকে গোল করলেন মেসি। শুরু হয়ে গেল তাঁর শেষ বিশ্বকাপ। প্রতিপক্ষ গোলরক্ষককে বাঁ দিকে ফেলে দিয়ে বলে আলতো টোকা। সৌদি গোলরক্ষকের ডান দিক দিয়ে বল জড়িয়ে গেল জালে। ফুটবল কত সূক্ষ্ম হতে পারে, কাতারের মাঠে নেমেই আরও এক বার বুঝিয়ে দিলেন মেসি।

Advertisement

তাঁর পায়ে নাকি অল্প চোট। ম্যাচের আগের দিন সাংবাদিকদের সামনে এসে নিজেই চোটের কথা জানিয়েছিলেন আর্জেন্টিনার অধিনায়ক। চোটের জন্যই দু’দিন আলাদা অনুশীলন করেছেন। সতীর্থদের সঙ্গে তাল মেলাতে চাননি। আসলে নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন আসল সময় যাতে তাল না কাটে। খেলা শুরুর আগে গা ঘামানোর জন্য মেসি মাঠে আসতেই গর্জে উঠল লুসেইল স্টেডিয়ামের গ্যালারি। শব্দই তখন ফুটবল বিশ্বকাপের ব্রহ্ম। সেই গর্জনের মধ্যেও মেসি ধীর, স্থির। মুখে আবেগের চিহ্ন নেই। শুধুই সংকল্পের আলপনা। প্রতিপক্ষের দিকে চাহনি নেই। নজরে যেন অধরা বিশ্বকাপ। মাঠের মাঝখানে তখন রাখা ছিল বিশ্বকাপ ট্রফির বিশাল অবয়ব। এক বার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিলেন। অর্জুন যে ভাবে পাখির চোখ দেখেছিলেন, ঠিক সে ভাবে। ট্রফির অবয়বটাই বোধহয় তাঁর ভিতরের আগুনটা জ্বালিয়ে দিয়েছিল। হয়তো তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের শ্লাঘাতে খোঁচা দিয়েছিল। গা ঘামানোর পর মেসির চোয়াল যেন আরও শক্ত।

টস করতে এলেন আর্জেন্টিনার অধিনায়ক। সৌদি অধিনায়কের অন্তত ৬ সেকেন্ড আগে পৌঁছে যান রেফারিদের কাছে। টসের আগে করমর্দন। নেহাতই সৌজন্য। পেশাদারি মোড়কে ঢাকা। সে সময়ই তাঁর পিছন দিয়ে মাঠের বাইরে চলে গেল ট্রফির বিশালাকার অবয়ব। মেসি পিছন ঘুরে দেখলেন ট্রফি নেই! এই ট্রফিটা এখনও নেই তাঁর জীবনেও। দেশে নিয়ে যাওয়ার শেষ সুযোগ। এক বার তাকালেন আকাশের দিকে। তিনি কি মারাদোনাকে খুঁজলেন?

কোচ লিয়োনেল স্কালোনি দল সাজিয়েছিলেন ৪-৫-১ ছকে। মেসির ভূমিকা ঠিক স্ট্রাইকারের নয়। আক্রমণাত্মক মিডফিল্ডারের। কোচের ছকের মধ্যমণি। এর মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু নেই। যেমন অস্বাভাবিক নয় পেনাল্টি থেকে তাঁর গোল করা। ১০ মিনিটের মাথায় গোল করার পর মেসি সতীর্থদের সঙ্গে উৎসব করলেন। কিন্তু উচ্ছ্বাসে ভাসলেন না। ২৩ মিনিটে সৌদি বক্সের কিছুটা আগে বল পেলেন মেসি। গোলও করলেন। কিন্তু অফ সাইডের জন্য গোল বাতিল হয়ে গেল। মেসির মুখে স্পষ্ট হতাশা। সেই হতাশা আরও বাড়ল আর্জেন্টিনার পর পর তিনটি গোল অফ সাইডের জন্য বাতিল হওয়ায়।

সেই হতাশা মাত্রা ছাড়াল খেলার দ্বিতীয়ার্ধে সৌদি পর পর দু’গোল দেওয়ায়। থমথমে মুখ। চোখে অবিশ্বাস। চোয়াল তখনও শক্ত। মুহূর্তে মেপে নিলেন সতীর্থদের শরীরী ভাষা। বুঝলেন বাড়তি দায়িত্ব নিতে হবে। নিলেনও। সৌদি রক্ষণে আরও বেশি আক্রমণ তুলে আনলেন। মাঝেমাঝে স্টেডিয়ামের ইলেকট্রনিক্স বোর্ডের দিকে তাকিয়ে দেখে নিচ্ছিলেন স্কোরলাইন। পেশাদারি মোড়কে ঢেকে রাখছিলেন অনুভূতি। ম্যাচের ৭৯ মিনিটে ডায়রেক্ট ফ্রিকিক আর্জেন্টিনার পক্ষে। এগিয়ে এলেন মেসি। প্রতিপক্ষের খেলোয়াড় এবং নিজের সতীর্থদের অবস্থান বুঝে নিলেন ভাল করে। গোটা ফুটবল বিশ্ব তাঁর পায়ের জাদুর অপেক্ষায়। মেসির শট উড়ে গেল। গোল পোস্টের মধ্যেই থাকল না! মিনিট পাঁচেক পরেই তাঁর হেড সরাসরি জমা হল সৌদি গোলরক্ষকের হাতে। এ বার কিছুটা বিভ্রান্ত দেখাল মেসিকে। সংযুক্ত সময়েও গোল করতে পারলেন না ফ্রিকিক থেকে।

সময় যত এগিয়েছে স্কোর বোর্ড ছেড়ে মেসি তত বেশি তাকিয়েছেন রেফারির দিকে। ম্যাচ শেষের বাঁশি যেন তিনি বাজিয়ে না দেন! যতক্ষণ না বাঁশি বাজছে, ততক্ষণ আশা। শেষ পর্যন্ত পূরণ হল না আশা। সৌদির কাছে হেরে বিশ্বকাপ অভিযান শুরু করল মেসির আর্জেন্টিনা। শেষ বাঁশি বাজার পর মেসির মুখ ছিল কার্যত অভিব্যক্তিহীন। প্রতিপক্ষ বা সতীর্থদের সঙ্গে করমর্দন করলেন বটে। সেই সৌজন্য বিনিময়ও শুরুর মতোই পেশাদার মোড়কে ঢাকা। চোখে শূন্য দৃষ্টি।

টসের সময় মেসির পিছন থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ট্রফির বিশাল অবয়ব। প্রথম ম্যাচের পর মেসির কাছ থেকে হয়তো সত্যিই আরও দূরে চলে গেল বিশ্বকাপ। চোখে অবিশ্বাস, শরীরে ক্লান্তি নিয়ে মাঠ ছাড়লেন অবসন্ন মেসি। বয়সের ভার বেড়েছে তাঁর। কমেছে পায়ের ধার।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement