লিয়োনেল মেসি (বাঁ দিকে) এবং ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো। — ফাইল চিত্র।
ইউরোপীয় ফুটবলে দু’জনেরই দিন শেষ। লিয়োনেল মেসি এবং ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো নিজেদের ফুটবলজীবনের শেষ অধ্যায়টা কাটাচ্ছেন বিশ্বের দুই প্রান্তে। রোনাল্ডো আট মাস আগেই যোগ দিয়েছেন সৌদি আরবের ক্লাব আল নাসেরে। মেসি গিয়েছেন পশ্চিম প্রান্তে, ইন্টার মায়ামির হয়ে খেলতে। নতুন ক্লাবে রোনাল্ডোর অনেক দিন কাটানো হয়ে গেলেও মেসি সবে মাসখানেক হল ক্লাবের হয়ে খেলা শুরু করেছেন। নতুন ক্লাবে কেমন কাটছে দু’জনের জীবন? আগের মতোই ক্ষুরধার রয়েছেন তাঁরা? বিশ্লেষণ করল আনন্দবাজার অনলাইন।
রোনাল্ডো গত বছর সৌদি আরবের ক্লাবে যখন গেলেন, অনেকেই বিস্মিত হয়েছিলেন। কিন্তু সিদ্ধান্ত কতটা সঠিক ছিল তার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে নতুন মরসুম শুরুর আগে। দলে দলে নামী ফুটবলাররা যোগ দিয়েছেন সৌদি আরবের লিগে। রিয়াদ মাহরেজ, করিম বেঞ্জেমা, সাদিয়ো মানে, মার্সেলো ব্রোজ়োভিচ, এনগোলো কান্টের মতো ফুটবলাররা ইউরোপের লোভনীয় প্রস্তাব ছেড়ে সৌদিতে চলে গিয়েছেন। মেসি আমেরিকায় যোগ দেওয়ার আগে রোনাল্ডো সাধে কি আর বলেছিলেন, “সৌদি লিগ এমএলএসের থেকে অনেক ভাল। আমিই দরজা খুলে দিয়েছি।”
রোনাল্ডো যেখানে আল নাসেরের হয়ে ২৫টি ম্যাচ খেলেছেন, সেখানে চারটি ম্যাচ খেলা মেসির সঙ্গে তাঁর তুলনা করা সম্ভব নয়। কিন্তু দু’জনের প্রভাব কতটা তার একটা আন্দাজ নিশ্চয়ই পাওয়া যায়। সেই হিসাবে এটা আলোচনা করা যেতেই পারে, দুই খেলোয়াড় কি আগের মতোই ডিফেন্স চিরে আক্রমণ করতে পারেন? দু’জনেই কি ফ্রিকিকে এখনও আগের মতো তীক্ষ্ণ? দু’জনেই কি এখনও বিপক্ষের ত্রাস?
গোল করার ক্ষমতা
খাতায়কলমে সৌদি প্রো লিগে ৩৭-৩৮ বছরের একজন খেলোয়াড়ের কাছে ১৬ ম্যাচে ১৪ গোল খারাপ নয়। কিন্তু প্রতি ম্যাচে গোলপ্রতি শটের সংখ্যা অনেকটাই কমে গিয়েছে। যে পরিমাণ সুযোগ তিনি নষ্ট করেছেন তা অকল্পনীয়। গোলের সামনে এক সময় ত্রাস ছিলেন তিনি। আর এখন ১২ গজ দূর থেকে ভলি বা সহজ সুযোগও মিস্ করছেন। রোনাল্ডো এখন মূলত অন্যের পাসের উপরেই নির্ভরশীল। গোলের সামনে তিনি ক্ষিপ্র। কিন্তু নিজের প্রচেষ্টায় নয়, সতীর্থদের সাহায্যই তাঁর গোল করার অন্যতম ভরসা।
ইন্টার মায়ামিতে এ ব্যাপারে এখনও পর্যন্ত মেসি এগিয়ে। নিজে তো গোল করছেনই। সতীর্থদের দিয়েও গোল করাচ্ছেন। মাঝমাঠ থেকে বল কেড়ে নিয়ে সতীর্থদের সঙ্গে পাস খেলে গোল করেছেন। আবার নিজেও একক প্রচেষ্টায় গোল করেছেন। এখনও পর্যন্ত মায়ামিতে মেসিকে পুরনো ছন্দেই দেখা গিয়েছে। চারটি ম্যাচে সাতটি গোল করেছেন তিনি।
ড্রিবল করার ক্ষমতা
রোনাল্ডো আল নাসেরে যোগ দেওয়ার সময়েই আল-হুরাইফি নামের এক ফুটবলার বলেছিলেন, “রোনাল্ডোর আর আগের মতো ড্রিবল করার ক্ষমতা নেই। ওকে বাকিদের উপরে নির্ভর করতেই হবে।” খুব একটা ভুল কথা বলেননি। ইউটিউবে খুঁজলে আল নাসেরে রোনাল্ডোর খারাপ খেলার নিদর্শনের একাধিক ভিডিয়ো পাওয়া যাবে। আগের মতো স্টেপ ওভার বা টার্ন এখন আর নেই। এখনও পর্যন্ত সফল ড্রিবলের সংখ্যা ২৩। অর্থাৎ, ম্যাচপিছু একটিও নয়। আল নাসেরের রোনাল্ডো অনেকাংশেই অতীতের ছায়ামাত্র।
চার ম্যাচে মেসিকে সে ভাবে ড্রিবল করতে দেখা যায়নি। তবে দক্ষতার ঝলক দেখা গিয়েছে বেশ কয়েক বার। কোমরের মোচড়ে বিপক্ষের ফুটবলারদের ছিটকে দেওয়া, চোরা গতিতে বিপক্ষকে ফাঁদে ফেলার মতো পরিচিত ছন্দ দেখা গিয়েছে কয়েক বার। সমর্থকদের আশা, যত সময় যাবে তত মেসির আসল রূপ প্রকাশ্যে আসবে।
অফসাইডের ফাঁদে রোনাল্ডো
বিপক্ষের রক্ষণ এড়িয়ে চোরা গতিতে দৌড়নোর কারণে বিখ্যাত ছিলেন রোনাল্ডো। ফলে বিপক্ষ দলগুলি রোনাল্ডোকে অফসাইডের ফাঁদে ফেলতে গিয়ে নিজেরাই বোকা বনে যেত। এখন হচ্ছে উল্টোটা। সহজেই অফসাইডের ফাঁদে পড়ে যাচ্ছেন রোনাল্ডো। তাঁর চোরা গতিও বয়সের কারণে কমে গিয়েছে। ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডে দ্বিতীয় বার খেলার সময় বার বার অফসাইড হতেন। ২০২১-২২ মরসুমে মোট ২৫ বার অফসাইড হয়েছিলেন তিনি। সৌদির ফুটবলের গতি এমনিতেই কম। ফলে সেখানে আরও বেশি অফসাইড হচ্ছেন তিনি।
মেসির ক্ষেত্রে এই সমস্যা কম। কারণ এমনিতেই তিনি অনেকটা পিছন থেকে খেলেন। বিপক্ষের ফুটবলারদের গতিতে হারিয়ে গোল করার চেষ্টা খুব একটা করেন না। বরং ড্রিবল করে বা সেট পিস থেকে গোল করার চেষ্টা করেন। না হলে সতীর্থদের পাস দিয়ে দেন। ফলে এ ক্ষেত্রেও রোনাল্ডোর থেকে এগিয়ে থাকবেন মেসি।
ফ্রিকিকেও এগিয়ে মেসি
রোনাল্ডো এবং মেসি, এক সময়ের দু’জনেরই ফ্রিকিকে গোল দেখতে মুখিয়ে থাকতেন ফুটবলপ্রেমীরা। দূর থেকে গোলার মতো শটে বল জালে জড়ানো যদি রোনাল্ডোর ট্রেডমার্ক হয়, তা হলে মেসির ফ্রিকিক শিল্প। বাঁকানো শটে পোস্টের দুরূহ কোণ দিয়ে বল জালে জড়াতেই তিনি অভ্যস্ত। নতুন ক্লাবে গিয়ে খুব অল্প সময়েই মেসি টেক্কা দিয়ে দিয়েছেন রোনাল্ডোকে। আল নাসেরের হয়ে ফ্রিকিক থেকে সরাসরি মাত্র একটি গোল করেছেন রোনাল্ডো। সেটি এসেছে মার্চে আভার বিরুদ্ধে। ১৬টি প্রয়াসে আর একটিও সরাসরি গোল করতে পারেননি। তার আগে ২০২০-র জুলাইয়ে জুভেন্টাসের হয়ে শেষ বার ফ্রিকিক থেকে গোল করেছিলেন তিনি। রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে প্রথম মরসুম সরাসরি ফ্রিকিকে ছ’টি গোল করেছিলেন তিনি। এর পর সংখ্যাটা শুধুই কমেছে।
অন্য দিকে, চারটি ম্যাচেই দু’টি ফ্রিকিক থেকে গোল হয়ে গিয়েছে তাঁর। দু’টিতেই রয়েছে অতীতের শৈল্পিক ছন্দ। বক্সের বাইরে থেকে বাঁকানো শটে গোল করেছেন। প্যারিস সঁ জরমেঁর হয়ে দু’বছরে ফ্রিকিক থেকে যতগুলি গোল করেছিলেন, মায়ামিতে চারটি ম্যাচেই সেই সংখ্যক গোল করে ফেলেছেন।
পরিসংখ্যান বলছে, নতুন ক্লাবে এখনও পর্যন্ত রোনাল্ডোর থেকে এগিয়ে মেসি। তবে আমেরিকায় মেসির ফুটবলজীবন সবে শুরু হয়েছে। এখনও দু’জনের মধ্যে তুলনা করার সময় আসেনি। রোনাল্ডো যেমন প্রথম বার আল নাসেরের হয়ে মরসুমের শুরু থেকে খেলতে চলেছেন, মেসির কাছেও ব্যাপারটা তাই। ভক্তদের আশা, আগামী একটি বছর বুঝিয়ে দেবে দুই তারকা কোন জায়গায় রয়েছেন।