শুরু করেছিলেন অনেক প্রত্যাশা জাগিয়ে। ক্রিকেটার হিসেবে যাত্রাপথের বেশ কিছু দূর চলেছিল ঠিকঠাক ভাবেই। সুর কাটল এক দুর্ঘটনায়। দেশকে যুব বিশ্বকাপ জেতানো যোগিন্দর শর্মা এখন হরিয়ানা পুলিশের ডিএসপি।
হরিয়ানার রোহতকে যোগিন্দরের জন্ম ১৯৮৩ সালের ২৩ অক্টোবর। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে আত্মপ্রকাশ ২০০২-০৩ মরসুমে। হরিয়ানার হয়ে প্রথম রণজি ম্যাচে খেলেছিলেন মধ্যপ্রদেশের বিরুদ্ধে।
দলীপ ট্রফিতে তিনি নির্বাচিত হন উত্তরাঞ্চল দলে। পশ্চিমাঞ্চলের বিরুদ্ধে ৫৯ রানে ৬ উইকেট নিয়ে নির্বাচকদের নজর কাড়েন যোগিন্দর। এরপর ‘ভারত এ’ দলের হয়ে জাতীয় দলের বিরুদ্ধে তাঁর পারফরম্যান্স ছিল তাক লাগানো। সেই ম্যাচে রাহুল দ্রাবিড়, ভিভিএস লক্ষ্মণ এবং যুবরাজ সিংহের মতো সিনিয়র ক্রিকেটারদের উইকেট তিনি নেন।
ইরানি ট্রফিতে মুম্বইকে পরাজিত করা অবশিষ্ট ভারত দলেরও সদস্য ছিলেন তিনি। ২০০৪ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে তিনি প্রথম একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেন। তিন বছর পরে প্রথম সুযোগ আন্তর্জাতিক টি-২০ ম্যাচে।
অলরাউন্ডার যোগিন্দর ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি মিডিয়াম ফাস্ট বোলিংও করতেন। ২০০৭-এ দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রথম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ সাক্ষী ছিল তাঁর জীবনের সেরা পারফরম্যান্সের। ফাইনালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে শেষ ওভার বল করতে এসেছিলেন তিনি। ৬ বলে ১৩ রান প্রয়োজন ছিল পাকিস্তানের। ভারতের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্য দরকার এক উইকেট।
উইকেটে থিতু হয়ে যাওয়া পাক অধিনায়ক মিসবা উল হক তখন বিধ্বংসী হয়ে উঠেছিলেন। হরিয়ানার তরুণ মিডিয়াম পেসার যোগিন্দর শর্মার হাতে বিশ্বকাপ জেতার সমস্ত দায়িত্ব তুলে দেন ধোনি।
প্রথম দুই বলে সাত রান দিয়ে বসেন তিনি। চার বলে দরকার ছিল ছয় রানের। যোগিন্দরের বল স্কুপ করতে গিয়ে শর্ট ফাইন লেগে ক্যাচ দিয়ে বসেন মিসবা। যা তালুবন্দি করেন শ্রীসন্থ। উৎসব শুরু হয়ে যায় ওয়ান্ডারার্সে।
ফাইনালের আড়ালে চাপা পড়ে গিয়েছে সেমিফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে যোগিন্দরের পারফরম্যান্স। সেখানেও ম্যাচের শেষ ওভারে বাজিমাত করেছিলেন তিনি। জেতার জন্য অস্ট্রেলিয়ার দরকার ছিল ২২ রান। ক্রিজে মাইকেল হাসি। সেই ওভারে দু’টি উইকেট নিয়ে ভারতকে ১৫ রানে জয় এনে দেন অলরাউন্ডার যোগিন্দর।
এই পারফরম্যান্সের পরে যে উচ্চতায় পৌঁছনোর কথা ছিল, তার অনেক আগেই থেমে যান যোগিন্দর। ২০০৭-এর পর আর ডাক পাননি টি-২০ ম্যাচে। একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে অভিষেক হয়েছিল ২০০৪-এর ডিসেম্বরে, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। শেষ ওয়ানডে ম্যাচ খেলেছিলেন তার তিন বছর পরে, প্রতিপক্ষ ছিল শ্রীলঙ্কা।
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ফাইনালের ওই ম্যাচই ছিল যেগিন্দরের কেরিয়ারের শেষ ম্যাচ। মাত্র চারটি ওয়ান ডে এবং চারটি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলা যোগিন্দর রয়ে গেলেন ভারতের ক্রিকেটে ওয়ান ম্যাচ ওয়ান্ডার হয়েই। চারটি ওয়ান ডে-তে তাঁর মোট রান ৩৫। উইকেট পেয়েছেন একটি। পাশাপাশি কেরিয়ারের সব টি-টোয়েন্টি ম্য়াচে তাঁর শিকার চারটি।
বিধ্বস্ত কেরিয়ারকে সংক্ষিপ্ত করে দেয় দুর্ঘটনা। ২০১১ সালের নভেম্বরে গাড়ি দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হন যোগিন্দর। তাঁর মাথায় অস্ত্রোপচারও করতে হয়। পরবর্তী সময়ে বাইশ গজে ফিরে আসেন ঠিকই। কিন্তু আগের ফর্মের কাছে আর পৌঁছতে পারেননি।
আইপিএল-এ যোগিন্দর খেলেছিলেন চেন্নাই সুপার কিংস-এর হয়ে। ১৬টি আইপিএল ম্যাচে তাঁর সংগ্রহ ১২টি উইকেট। মোট রান ৪১৯। ২০১১-র এপ্রিলে মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের বিরুদ্ধে তিনি শেষ আইপিএল ম্যাচ খেলেন।
প্রথম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জেতানোর সেই নায়ক এখন খেলতে নেমেছেন নতুন ম্যাচে। দেশকে করোনভাইরাসের আক্রমণ থেকে রক্ষা করার কাজে নিজেকে সঁপে দিয়েছেন। বিশ্বকাপে সাফল্যের পরেই হরিয়ানা পুলিশে চাকরি পেয়েছিলেন যোগিন্দর। এখনও সেখানেই কর্মরত।
পুলিশের ভূমিকায় দেশকে করোনার থাবা থেকে বাঁচানোর তাগিদে সকাল থেকে কাজ শুরু করছেন তিনি। রাস্তায় মানুষ দেখলে তাঁদের আবার বাড়িতে ফিরিয়ে দিচ্ছেন। কোনও ধরনের সমস্যা দেখলে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন।
শত ব্যস্ততার মধ্যেও ঐতিহাসিক টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ফাইনালের প্রসঙ্গ উঠলেই স্মৃতিমেদুর হয়ে পড়েন। তাঁর কথায়, “সেই স্মৃতি কি কখনও ভোলা যায়? যত দিন বেঁচে থাকব, সেই মুহূর্তই আমার জীবনের সেরা হয়ে থাকবে। সেই ওভারের আগে পর্যন্ত ভারতের হয়ে খেললেও সমর্থকদের মনে জায়গা করতে পারিনি। কিন্তু মিসবাকে আউট করার পরে বুঝতে পেরেছিলাম, ক্রিকেট সমর্থকরা এর পরে আমাকে চিনতে আর ভুল করবেন না।”
দু’টি ভূমিকার মধ্যে কিছুটা হলেও এগিয়ে রাখেন জীবনের দ্বিতীয় ইনিংসকে। তাছাড়া মনে করেন, সাম্প্রতিক অতিমারি পরিস্থিতি আরও কঠিন করে দিয়েছে চ্যালেঞ্জকে। কারণ প্রতিপক্ষ যতই কঠিন হোক, ম্যাচে প্রাণসংশয় থাকে না।
ময়দান পাল্টে গিয়েছে। কিন্তু যোদ্ধা যোগিন্দরের লড়াকু মানসিকতায় ভাটা পড়েনি এক বিন্দুও।