রাজ লিম্বানী। ছবি: এক্স।
ছোটদের বিশ্বকাপে ফাইনাল খেলছে ভারত। বড়দের বিশ্বকাপের ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার কাছে ঘরের মাঠে হারের বদলা নেওয়ার সুযোগ। ভারতের সাফল্যের নেপথ্যে রয়েছে রাজ লিম্বানীর পারফরম্যান্স। কঠোর পরিশ্রম করে উঠে এসেছেন তিনি।
মরুভূমির শহর থেকে উঠে আসা রাজ আগামী দিনে ভারতীয় ক্রিকেটে যে নতুন সম্ভাবনা, তা মনে করছেন অনেকেই। তবে ক্রিকেটে আসা মোটেই সহজ ছিল না। অধ্যবসায় এবং কঠোর পরিশ্রমই তাঁকে এই জায়গায় এনেছে।
ছোটবেলার রাজের কাছে দুটোই বিকল্প ছিল। হয় বাকি ভাইদের মতো পড়াশোনায় মন দেওয়া বা চাষের কাজে বাবাকে সাহায্য করা। কিন্তু ভাইবোনেদের পথে হাঁটেননি রাজ। তিনি রাজস্থানের কচ্ছের রনের গ্রাম দয়াপার থেকে ৫৫০ কিলোমিটার দূরে বরোদাতে চলে যান। একটাই স্বপ্ন ছিল, ক্রিকেটার হওয়া।
রাজের বাবা বসন্ত পটেল বলেছেন, “আমাদের গ্রাম থেকে পাকিস্তানের সীমান্ত মাত্র ২৭ কিলোমিটার দূরে। তাই আমাদের ছেলেরা পড়াশোনা করতে সাধারণত আমদাবাদ, সুরত বা বরোদায় যায়। রাজের ব্যাপারটা ছিল আলাদা। ২০১৭ সালে ও বরোদায় চলে যায় শুধু ক্রিকেট খেলতে। আমি কৃষক। তবু ওকে বলেছিলাম স্বপ্নের পিছনে ধাওয়া করতে। না হলে তো আরান্ডির খামারবাড়ি ওর জন্য রয়েছেই। কিন্তু ছোট থেকেই ক্রিকেটের প্রতি ওর অদ্ভুত নেশা ছিল। আমরাও সেটা বুঝতে পারতাম না। ভারতের হয়ে খেলা অবশেষে আমাদের মুখে হাসি ফুটিয়েছে।”
ফাইনালে ১০ ওভারে ৩৮ রান দিয়ে ৩ উইকেট নিয়েছেন। এ বারের বিশ্বকাপে ছ’টি ম্যাচে ১১ উইকেট নিয়েছেন রাজ। নতুন বলে উইকেট নেওয়ার দক্ষতা তাঁকে বাকিদের থেকে আলাদা করে তুলেছে। ভারতীয় দলও তাতে উপকৃত হচ্ছে। ফলে প্রতিযোগিতার সবক’টি ম্যাচে জিততে কোনও অসুবিধা হয়নি। তবে রাজস্থানে সেই সুবিধা ছিল না। না ছিল কোনও পরিকাঠামো, না ছিল কোনও পিচ। টেনিস বলে বোলিং শুরু করেন রাজ। পেশাদার ক্রিকেটার হওয়ার ব্যাপারে মনস্থির করে ফেলার পর টেনিস বলের জায়গায় কর্ক বলে অনুশীলন শুরু করেন। কিন্তু কচ্ছের রনের মতো কঠিন আবহাওয়াপূর্ণ জায়গা থেকে উঠে আসা সহজ ছিল না।
বসন্ত বলেছেন, “আমরা মরুভূমিতে থাকি। গরম হোক বা ঠান্ডা, আবহাওয়া খুবই চড়া। গরমে ঠা ঠা রোদ হোক বা তীব্র ঠান্ডা, ওকে ব্যাট করতে দেখেছি। কখনও আটকাইনি। বালির মধ্যে খেলা সহজ ছিল না। কোনও সরঞ্জামও ছিল না। কিনতে গেলে ১০০ কিলোমিটার দূরে শহরে যেতে হত।”
পরিবারের বড় মেয়ের পরীক্ষা হয়ে যাওয়ার পর ২০১০ সালে বরোদায় চাকরি নিয়ে চলে যান। সাত বছর পরে সেখানে রাজও যান। তবে পড়াশোনা নয়, ক্রিকেট খেলতে। রাজের খুড়তুতো দাদা হার্দিক বলেছেন, “আমরা যাতে ভাল মানের শিক্ষা পাই তাই বাবা বরোদাতে ট্রান্সফার নিয়ে চলে আসেন। ২০১৭-তে রাজ আসার পর ভাল স্কুলে ভর্তি হওয়ার বদলে ভাল ক্রিকেট অ্যাকাডেমি খুঁজছিল। মোতি বাগ ক্রিকেট ক্লাব ছিল আমাদের বাড়ি থেকে চার কিলোমিটার দূরে। সেই ক্লাব থেকেই পাঠান ভাইয়েরা (ইরফান এবং ইউসুফ) এবং পাণ্ড্য ভাইয়েরা (হার্দিক এবং ক্রুণাল) উঠে এসেছেন। দীপক হুডাও সেই ক্লাবের ছেলে। সেখানে রাজকে ভর্তি করাতে সমস্যা হয়নি।”
রাজের কোচ দিগ্বিজয় সিংহ রাঠওয়া জানিয়েছেন, প্রতিভা বা পারিবারিক সাহায্য না থাকা নিয়ে কোনও দিন ভাবেননি। শুরু থেকেই নিজের খেলা নিয়ে রাজের মনে যে স্বচ্ছতা ছিল, সেটাই তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। তিনি বলেছেন, “প্রথম বার অনূর্ধ্ব-১৬ শিবিরে রাজের সঙ্গে পরিচয় হয়। যখন কাউকে জিজ্ঞাসা করতাম তারা কী হতে চায়, উত্তর শুনতাম একটাই। ভারতের হয়ে খেলতে চাই। কিন্তু রাজ সঙ্গে একটা ডায়রি নিয়ে এসেছিল। সেখানে সব কিছু লিখে রাখত।”
কী লেখা থাকত সেই ডায়রিতে? দিগ্বিজয় জানিয়েছেন, প্রথমে অনূর্ধ্ব-১৬, তার পর অনূর্ধ্ব-১৯, তার পর জাতীয় ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে প্রশিক্ষণ পাওয়ার ইচ্ছের কথা লিখে রেখেছিলেন রাজ। তার পরে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ খেলা এবং বরোদার হয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলার স্বপ্নের কথা লেখা ছিল। এর পর ভারত ‘এ’ দল এবং শেষে ভারতের সিনিয়র দল। এতটা স্বচ্ছতা উঠতি ক্রিকেটারদের মধ্যে দেখা যায় না। এখনও পর্যন্ত সব কাজই ও করেছে। আশা করি সিনিয়র দলেও খেলবে।
অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের আগে রাজ প্রথম পছন্দের পেসার ছিলেন না। কিন্তু এশিয়া কাপে নেপালের বিরুদ্ধে ১৩ রানে ৭ উইকেট তাঁকে বাকিদের থেকে এগিয়ে দেয়। এখন তাঁকে নিয়ে পরিবারের এতটাই আগ্রহ যে, খেলা থাকলেই বাবা দুপুর ১টার মধ্যে কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরে টিভির সামনে বসে যান। রবিবারও নিশ্চয়ই তাই করেছেন। রাজের পারফরম্যান্স দেখে গর্বে হয়তো তাঁর বুক ভরে গিয়েছে।