(বাঁ দিকে) দেবু বণিক। সিরিজ় সেরার ট্রফি হাতে উইল ইয়ং (ডান দিকে)। ছবি: সংগৃহীত।
ভারতের বিরুদ্ধে তিনটি টেস্টেই প্রথম একাদশে সুযোগ পেয়েছিলেন। কেন উইলিয়ামসনের বদলে নেওয়া হয়েছিল তাঁকে। সেই উইল ইয়ং যে সিরিজ়ের সেরা ক্রিকেটার হবেন ভাবা যায়নি। গোটা সিরিজ়ে একটিও শতরান নেই। তবু তিনটি ইনিংস তাঁকে সিরিজ় সেরা হতে সাহায্য করেছে। নিউ জ়িল্যান্ড তথা ইয়ংয়ের সাফল্যের নেপথ্যে রয়েছে বাঙালি-যোগ। ইয়ংকে তুলে আনা এবং জাতীয় দলের ক্রিকেটার হতে সাহায্য করার পিছনে রয়েছে তিন দশক আগে কলকাতা ময়দানে খেলে যাওয়া দেবু বণিকের অবদান।
বেঙ্গালুরুতে কঠিন পিচে দ্বিতীয় ইনিংসে ইয়ংয়ের অপরাজিত ৪৮ রান এবং মুম্বইয়ের ঘূর্ণি পিচে দুই ইনিংসে ৭১ এবং ৫১ রান সিরিজ় জিততে সাহায্য করেছে কিউয়িদের। তবে ইয়ংয়ের ইনিংস দেখে খুব একটা অবাক নন দেবু। ছোটবেলা থেকেই ইয়ংকে চোখের সামনে দেখার সুবাদে তিনি জানেন, কঠিন পরিস্থিতিতে কী ভাবে মাথা ঠান্ডা রাখতে পারেন তাঁর ছাত্র।
নিউ জ়িল্যান্ডের প্লাইমাউথ থেকে ফোনে আনন্দবাজার অনলাইনকে দেবু বললেন, “তখন আমি তারানাকি ক্রিকেট ক্লাবের অনূর্ধ্ব-১২ দলের কোচ। ইয়ংও তারানাকির ছেলে। ওর সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের সময়ে বয়স কত আর হবে! ১১ মতো। তখনই দেখেছিলাম ওর মাথা খুব শান্ত। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা খুব ভাল। শুধু প্রতিভা থাকলেই হয় না, তার সঙ্গে কঠোর পরিশ্রম, মূল্যবোধ এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা থাকতে হয়। ছোট বয়স থেকেই ইয়ং সে ব্যাপারে বাকিদের থেকে এগিয়ে ছিল।”
দেবুর জন্ম এবং বেড়ে ওঠা কলকাতার টালিগঞ্জে। নব নালন্দা স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। তার পরে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকে অর্থনীতি নিয়ে ভর্তি হন। সেই সঙ্গেই দাপিয়ে চলত ময়দানের বিভিন্ন মাঠে ক্রিকেট খেলা। নব্বইয়ের দশকে কালীঘাট, রাজস্থান ক্লাব, স্পোর্টিং ইউনিয়ন, টালিগঞ্জ— বিভিন্ন দলের হয়ে স্থানীয় লিগে খেলেছেন। সে সময় স্থানীয় লিগের বাছাই করা ক্রিকেটারদের ইংল্যান্ডে খেলতে নিয়ে যেতেন বাংলার প্রাক্তন ক্রিকেটার গোপাল বসু। সেই দলের নাম ছিল ‘ক্যালকাটা ব্লুজ়’।
রাজর্ষি চৌধুরির নেতৃত্বে সেই দলের হয়ে বেশ কয়েক বার ইংল্যান্ডে খেলতে গিয়েছেন দেবু। সেখানেই পরিচয় তারানাকির ক্রিকেটার কিথ মুলারের সঙ্গে। নিউ জ়িল্যান্ডে গিয়ে ক্রিকেট খেলা এবং কোচিং করানোর আব্দার করেছিলেন মুলার। দেবু ফেলতে পারেননি। ২০০৩ সালে নিউ জ়িল্যান্ডে খেলতে চলে যান। সেখানে ইঙ্গলউড ক্রিকেট ক্লাবের হয়ে তিন বছর এবং ফ্রান্সিস ডগলাস মেমোরিয়াল কলেজের হয়ে চার বছর খেলেছেন। মাঝে ‘লেভেল-২’ পর্যায়ের কোচিং প্রশিক্ষণ নেওয়াও হয়ে গিয়েছে।
ক্রিকেট ছাড়ার পর অনেক দিন থেকে পাকাপাকি ভাবে কোচিং করাচ্ছেন তিনি। এখন তিনি নিউ জ়িল্যান্ডের প্লাইমাউথের বাসিন্দা এবং সে দেশের নাগরিক। শুরু থেকেই তারানাকির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ২০ বছর কাজ করার পর ২০২২ সালের শেষ দিকে নর্দার্ন ডিস্ট্রিক্ট ক্রিকেটে যোগ দেন। বছর দেড়েক কাটিয়ে আবার ফিরে এসেছেন তারানাকিতে। সে দেশের ক্লাবস্তরের ক্রিকেটে দেবু প্রায় কিংবদন্তির সমান। তারানাকি ছাড়ার সময় সেই ক্লাবের ক্রিকেট ডিরেক্টর ক্রিস কুম্বে বলেছিলেন, “দেবু আমাদের এখানে কিংবদন্তি। বিভিন্ন বয়সভিত্তিক প্রতিযোগিতা থেকে অসংখ্য ক্রিকেটার তুলে এনেছে। ম্যাটি টমাস, রায়ান ওয়াটসন, ডিন রবিনসন, কেট ইব্রাহিমের পাশাপাশি জাতীয় দলের হয়ে খেলা উইল ইয়ং এবং টম ব্রুসও রয়েছে। ক্রিকেটের টেকনিক্যাল দিকগুলো দেবুর থেকে ভাল কেউ বোঝে না।”
যাঁকে ঘিরে এত প্রশংসা, সেই দেবু ইয়ংয়ের উত্থানের জন্য কোনও কৃতিত্বই নিতে চান না। প্রশ্ন করতেই বললেন, “ভাল খেলোয়াড়কে কোনও দিন হাত ধরে তুলে আনতে হয় না। তারা নিজে থেকেই প্রচারের আলোয় এসে যায়। আমাদের কাজ হল তাদের ঘষেমেজে তৈরি করা, যাতে বড় মঞ্চে খেলতে গিয়ে কোনও অসুবিধা না হয়। ভাল ক্রিকেটার হতে গেলে প্রতিভার পাশাপাশি কঠোর পরিশ্রম, মূল্যবোধ, সময়জ্ঞানও জরুরি। সত্যি বলতে, খুব ছোটবেলা থেকে ইয়ংয়ের মধ্যে আমি সেগুলো দেখতে পেয়েছিলাম। ওর মধ্যে শেখার প্রবল ইচ্ছা রয়েছে।”
দেবুর সংযোজন, “ছোটবেলায় ও খেলার পিছনে অনেক সময় দিত। পরিশ্রম করত। পরিস্থিতি কঠিন হলেও মাথা ঠান্ডা রাখতে পারত। ঘাবড়ে যেত না সহজে। এটাই ওকে বাকিদের থেকে আলাদা করে দিয়েছে।” মাত্র ১২ বছর বয়স থেকে ইয়ং জোরে বোলিং অনায়াসে খেলতেন। প্রতি ঘণ্টায় ৮০-৮৫ মাইল গতিবেগে করা বলও খেলতে সমস্যা হত না। ১৫ বছরের মধ্যে তিনি এলাকার সমস্ত ক্রিকেটীয় নজির ভেঙে দিয়েছিলেন।
ভারতের বিরুদ্ধে তৃতীয় টেস্টে উইল ইয়ংয়ের ব্যাটিং। ছবি: পিটিআই
প্রতিভা এবং কঠোর পরিশ্রমের জন্যই ইয়ং ভারতে সফল হয়েছেন বলে মনে করেন দেবু। তাঁর মতে, “অনেক বার ভারতে এসেছে ও। ২০২১ সালে আগের টেস্ট সিরিজ়েও খেলেছিল। এক দিনের বিশ্বকাপে খেলেছে। এ ছাড়া পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা-সহ উপমহাদেশের বিভিন্ন মাঠে খেলার অভিজ্ঞতা রয়েছে ওর। সেই অভিজ্ঞতাগুলোকেও ঠিকঠাক কাজে লাগিয়েছে। ভারতে ভাল খেলার জন্য বাড়তি পরিশ্রম করেছে।” সম্প্রতি সে দেশের সেন্ট্রাল ডিস্ট্রিক্টের হক্স বে-র মাঠে একটি পিচ মেরামতের জন্য সামান্য খোঁড়া হয়েছিল। সেই পিচে বল পড়লেই লাফাচ্ছিল। অসমান বাউন্স ছিল। উপমহাদেশে খেলতে আসার আগে সেই পিচেই অনুশীলন চালিয়েছিলেন ইয়ং। মুম্বই টেস্টে তাঁর ইনিংসের নেপথ্যে সেই পরিশ্রম রয়েছে।
২০১৯ সালে ক্রাইস্টচার্চে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে টেস্ট অভিষেক হওয়া নিশ্চিত ছিল ইয়ংয়ের। কিন্তু ম্যাচের দিন সকালে স্থানীয় একটি মসজিদে দুষ্কৃতিরা হামলা করে বহু মানুষকে হত্যা করে। সিরিজ় বাতিল করে দেওয়া হয়। ইয়ং দুঃখ পেয়েছিলেন। তবে অভিষেকের সুযোগ হাতছাড়া হওয়ার জন্য নয়। এতজন দেশবাসী মারা যাওয়ায় তিনি কষ্ট পেয়েছিলেন। ইয়ং বরাবরই বিশ্বাস করেন, খেলার আগে মানুষের জীবন। সন্ত্রাসের পরিবেশে খেলা হতে পারে না। সেই সময়ে তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন দেবুও। বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে ইয়ংকে আড্ডা মারার ব্যবস্থা করে দেন। পুরনো কথা মনে করান। কিছুটা সময়ের জন্য ইয়ংয়ের মাথা থেকে ক্রিকেট ব্যাপারটাই বার করে দিয়েছিলেন।
ছাত্রের সুযোগ হাতছাড়া হওয়ায় কি তাঁর কষ্ট হয়নি? দেবু বললেন, “দুঃখ-কষ্টের থেকেও বড় ব্যাপার হল ক্রিকেট স্রেফ একটা খেলা। মানুষের জীবন সবার আগে। ইয়ংও সেটাই বিশ্বাস করে। নিউ জ়িল্যান্ডের ইতিহাসে অন্যতম ভয়ঙ্কর জঙ্গি হামলা ছিল ওটা। ইয়ং নিজেও সেটা জানত। জীবন সবার আগে। তাই অভিষেক হয়নি বলে ওর মনে কোনও দুঃখ ছিল না। বরং যাঁরা সেই ঘটনায় মারা গিয়েছিল তাঁদের পরিবার এবং আত্মীয়স্বজনের কথা ভেবে বেশি চিন্তায় ছিল ও।”
সেই কষ্ট হাসিতে বদলে যায় বছর খানেক পরেই। ওয়েস্ট ইন্ডিজ়ের বিরুদ্ধে প্রথম বার টেস্ট খেলার সুযোগ পান। সেই অনুভূতি জানাতে গিয়ে দেবু বললেন, “ওটা ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব। এতটাই ভাল লেগেছিল যে শব্দে বর্ণনা করা যাবে না। অদ্ভুত একটা আনন্দ হয়েছিল। কখনও মনে করি না যে, আমি না থাকলে ওর উঠে আসা হত না। ও এমনিতেই উঠে আসত। আমি স্রেফ ওর সঙ্গে ছিলাম, ওকে পরামর্শ দিয়ে সঠিক পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছিলাম। আসল নায়ক ও নিজেই।”
ইয়ংয়ের সঙ্গে অনেক সুখ-দুঃখের স্মৃতি রয়েছে দেবুর। তবে সবচেয়ে ভাল স্মৃতি এই ভারতেরই শহর বেঙ্গালুরুতে। ২০১৩ সালের কথা। নিউ জ়িল্যান্ড ‘এ’ দলের হয়ে ভারতে খেলতে এসেছিলেন ইয়ং। সঙ্গে ছিলেন দেবুও। সফর শেষে দেশে ফেরার পথে ইয়ংকে দেবু প্রশ্ন করেছিলেন, ভারতে এসে কী শিখেছে সে। ইয়ংয়ের উত্তর অবাক করে দিয়েছিল। দেবু বললেন, “ভারতে মানুষ কত কষ্টে থাকে, সেই প্রসঙ্গ বার বার ওর কথায় উঠে এসেছিল। বলেছিল, কোনও জিনিসই সহজলভ্য নয়। তা অর্জন করে নিতে হয়। নিজের জীবনেও ইয়ং সেটা পালন করেছে।”
সেই ভাবনা থেকেই সম্ভবত সমাজকে কিছু ফিরিয়ে দেওয়ার ইচ্ছা জেগেছিল ইয়ংয়ের মধ্যে। তৈরি করেছেন ‘দ্য উইল ইয়ং ক্রিকেট ট্রাস্ট’। প্রতি বছর এলাকার উঠতি ক্রিকেটারদের অর্থ এবং কিট দিয়ে সাহায্য করে তাঁর সংস্থা। যে কোনও প্রয়োজনে পাশে থাকে।
নিউ জ়িল্যান্ডে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থাকলে নিয়মিত দেখতে যান দেবু। নিউ জ়িল্যান্ডে অফ সিজন থাকাকালীন ইংল্যান্ডের কেন্ট, চেশায়ার, মিডলসেক্সে গিয়ে কোচিং করিয়ে এসেছেন। তবে ভারতের ব্যর্থতা বা রোহিত শর্মা, বিরাট কোহলিদের খারাপ ফর্ম নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাইলেন না। জানালেন, ভারত ক্রিকেটীয় প্রতিভায় পরিপূর্ণ দেশ। তারা একটা সময়ে ঠিক ঘুরে দাঁড়াবে।
এখন তিনি নিউ জ়িল্যান্ডের স্থায়ী বাসিন্দা। তবু প্রতি বছর নিয়ম করে এক বার কলকাতায় আসবেনই। স্থানীয় ক্লাবগুলিতে এখনও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছেন বন্ধুরা। তাঁদের সঙ্গে আড্ডাও মারেন। নিউ জ়িল্যান্ডে ফিরে আবার ডুবে যান নিজের কাজে। কে বলতে পারে, কিছু বছর পরে হয়তো আরও একটা উইল ইয়ং বা টম ব্রুসকে তৈরি করে ফেলবেন না দেবু! ভারতে কি একটা বিরাট কোহলি বা রোহিত শর্মা তৈরি করতে পারবেন? জবাবে শুধু হাসলেন টালিগঞ্জের দেবু।