কমনওয়েলথে ফের পদক চানুর। —ফাইল চিত্র
বার্মিংহামে কমনওয়েলথ গেমসে ভারতের প্রথম সোনা এল মীরাবাই চানুর হাত ধরে। ভারোত্তোলনে বাকি প্রতিযোগীদের উড়িয়ে দিয়ে সোনা জিতলেন ভারতের প্রতিযোগী। অলিম্পিক্সে রুপোর পর কমনওয়েলথে দ্বিতীয় বার সোনা জিতলেন চানু। স্ন্যাচিং ও ক্লিন এবং জার্ক বিভাগে তুললেন ২০১ কিলো।
স্ন্যাচিংয়ে প্রথম চেষ্টায় ৮৪ কিলো তোলেন চানু। পরের বার তোলেন ৮৮ কিলো। তৃতীয় বার ৯০ কিলো তুলতে গিয়ে ব্যর্থ হন। স্ন্যাচিং বিভাগের শেষে শীর্ষে ছিলেন তিনিই। ৮৮ কিলো তুলে গেমস রেকর্ড গড়েন চানু। এটি তাঁর ব্যক্তিগত রেকর্ডও।
ক্লিন এবং জার্ক বিভাগেও রেকর্ড গড়েন চানু। তিনি প্রথম বারে তুললেন ১০৯ কিলো। দ্বিতীয় বারে এসে তুললেন ১১৩ কিলো। সেটিও গেমস রেকর্ড। মোট ২০১ কিলো তুললেন চানু। গেমসের ইতিহাসে যা সর্বোচ্চ। বাকি প্রতিযোগীদের অনেকটা পিছনে ফেলে দেন তিনি। রুপো পেলেন মরিশাসের মেরি রানাইভোসোয়া। দুই বিভাগ মিলিয়ে তিনি তোলেন ১৭২ কিলো। যা চানুর থেকে ২৯ কিলো কম। তৃতীয় স্থানে কানাডার হান্নাহ কামিনস্কি। তিনি তোলেন ১৭১ কিলো।
টোকিয়ো অলিম্পিক্সে রুপো জিতেছিলেন চানু। ছবি: এএফপি
গত বছর টোকিয়ো অলিম্পিক্সে রুপো পেয়েছিলেন মীরাবাই চানু। সেই পদক জয়ের পথ মোটেই পাপড়ি বিছানো ছিল না। তাঁর ম্যাচের আগের দিন বিকেলের দিকে ঋতুস্রাবের যন্ত্রণা শুরু হয়। পদক জয়ের লড়াইয়ে নামার আগে তাই অনুশীলনের যে পরিকল্পনা ছিল, তা ভেস্তে যায়। প্রশিক্ষক বিজয় শর্মাকে ‘প্ল্যান বি’ ভেবে ফেলতে হয় সঙ্গে সঙ্গে। সেই প্রসঙ্গে চানু বলেছিলেন, “প্রচণ্ড চিন্তায় ছিলাম। বুঝতেই পারছিলাম না কেন হঠাৎ হল। আমার পদক জয়ের আগের রাতেই এমন হল। শরীর অন্য রকম ভাবে কাজ করতে শুরু করে। স্বাভাবিক ছন্দ হারিয়ে যায়। সেই নিয়েও চিন্তা ছিল। কিন্তু আমি লক্ষ্যে অবিচল ছিলাম। খেলার মাঝে এমন হতেই পারে। আমরা অভ্যস্ত।”
চানু যে লড়াইয়ে অভ্যস্ত তা ভালই জানে দেশবাসী। ২০১৬-র রিয়ো অলিম্পিক্সেও নেমেছিলেন তিনি। ইভেন্টের শেষে তাঁর নামের পাশে লেখা ছিল ‘ডিএনএফ’, অর্থাৎ ‘ডিড নট ফিনিশ’। বাংলায় যার অর্থ, সেই ইভেন্ট শেষ করতেই পারেননি চানু। চোখের জলে বিদায় নিতে হয়েছিল জীবনের প্রথম অলিম্পিক্স থেকে। ওই ইভেন্টের পর মারাত্মক চোট পান চানু। কোমরের সেই চোটে একসময় কেরিয়ারই শেষ হয়ে যেতে বসেছিল। মানসিক ভাবেও তিনি প্রচণ্ড ভেঙে পড়েছিলেন। শরণাপন্ন হয়েছিলেন মনোবিদের।
পাঁচ বছর পরে তিনি ফের অলিম্পিক্সে নামলেন। এ বার চোখে জল নয়, মুখে শুধুই অমলিন হাসি। মণিপুরের প্রত্যন্ত গ্রামের সাইখোম মীরাবাই চানুর হাত ধরে টোকিয়ো অলিম্পিক্সে খাতা খুলেছিল ভারত।
মণিপুরের ইম্ফলের নংবক কাকচিং গ্রামে ১৯৯৪ সালে ৮ অগস্ট জন্ম চানুর। জন্ম থেকেই তাঁর শারীরিক শক্তি আর পাঁচটা মেয়ের তুলনায় বেশি। সেটা বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর বাবা-মা। জ্বালানির জন্য বনে কাঠ কাটতে যেত চানুর পরিবার। ভারী কাঠের বোঝা তাঁর দাদা তুলতে পারতেন না। কিন্তু চানু অনায়াসেই কাঁধে করে তা বাড়ি বয়ে নিয়ে আসতেন।
চানুর প্রথম পছন্দের খেলা ছিল তিরন্দাজি। কিন্তু বাবা-মায়ের ইচ্ছেতেই তিনি ১২ বছর বয়সে ভারোত্তোলনে ভর্তি হন। অনুশীলন শুরু করেন ইম্ফলের খুমান লাম্পাক স্টেডিয়ামে। সেখান থেকে মণিপুরের স্পোর্টস অথরিটি অব ইন্ডিয়া (সাই), সেখান থেকে পটিয়ালায়। চানুর জয়যাত্রা চলতে থাকে। এক বছর অনুশীলনের পরেই সাফল্য পান তিনি। ছত্তীসগঢ় যুব চ্যাম্পিয়নশিপে সোনা জেতেন। ২০১৪-য় গ্লাসগো কমনওয়েলথ গেমসে জীবনের প্রথম বড় সাফল্য পান চানু। ৪৮ কেজি বিভাগে রুপো জেতেন। এরপর কুঞ্জরানি দেবীর ১২ বছরের রেকর্ড ভেঙে ১৯২ কেজি তোলেন। দুরন্ত ছন্দ নিয়েই আত্মবিশ্বাসী হয়ে গিয়েছিলেন রিয়োতে।
সব স্বপ্নই সেখানে মাটিতে মিশে যায়। ক্লিন এবং জার্ক বিভাগে তিন বারই ওজন তুলতে ব্যর্থ হন চানু। স্ন্যাচে মাত্র এক বার ওজন তুলতে পেরেছিলেন। ফলে তাঁর নামের পাশে ছিল না কোনও সংখ্যা। লেখা হয়েছিল তিনি ইভেন্ট শেষ করতে পারেননি।
চানু ঘুরে দাঁড়ালেন পরের বছরই। ২০১৭-র বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে সোনা জিতলেন। স্ন্যাচ ও ক্লিন এবং জার্ক মিলিয়ে মোট ১৯৪ কেজি তুলেছিলেন তিনি। পরের বছরেও সাফল্য। গোল্ড কোস্টে কমনওয়েলথ গেমসে গিয়ে পেলেন সোনা। সেখানে আরও দু’কেজি ওজন বেশি তুললেন। এ বছর তিনি আরও পাঁচ কেজি বেশি তুলে গেমস রেকর্ড গড়লেন।