ছোটবেলার কোচ মুরলীর সঙ্গে ময়াঙ্ক। ফাইল চিত্র।
দেশের সেরা নয়। বিশ্বের সেরা। ছাত্র ময়াঙ্ক আগরওয়ালকে বিশ্বের সেরা ব্যাটসম্যান হিসেবেই দেখতে চান তিনি। ইনদওরের ডাবল সেঞ্চুরি গুরু-শিষ্যের সেই সম্মিলিত স্বপ্নে জল-হাওয়া দিচ্ছে বলেই মনে করছেন ডানহাতি ওপেনারের ব্যক্তিগত কোচ আরএক্স মুরলীধর।
মঙ্গলবার দুপুরে আনন্দবাজার ডিজিটালকে মোবাইলে তিনি বললেন, “দেখুন, স্টিভ স্মিথ যখন খেলতে শুরু করেছিল, তখন কেউ ভাবতে পারেনি যে আজকের জায়গায় পৌঁছতে পারবে। প্রত্যেকেই শুরু করে একই বিন্দু থেকে। এবং খেলার সঙ্গে সঙ্গে উন্নতি করতে থাকে। যদি তোমার স্বপ্নকে পাগলামি বলে না মনে হয়, তবে সেটা স্বপ্নই নয়। স্বপ্নকে এমন ক্রেজি হতেই হয়। তবেই তো সেটাকে অর্জন করার জন্য ছোটার মধ্যে মজা থাকে। সেটাই গড়ে তোলে চূড়ান্ত মানুষকে। কে বলতে পারে এটা হবে না?”
বিরাট কোহালি থেকে স্টিভ স্মিথ, জো রুট থেকে কেন উইলিয়ামসন। হালফিল বিশ্বের সেরা ব্যাটসম্যান বলতে ক্রিকেটপ্রেমীদের চোখে ভাসে এই চেহারাগুলোই। ময়াঙ্কের কোচ কিন্তু আগামী দিনে এঁদের সবাইকে ছাপিয়ে ছাত্রকে শীর্ষে দেখছেন। এবং ছাত্রের মধ্যে এই ইতিবাচক তরঙ্গ ভরে দিয়েওছেন তিনি। ময়াঙ্কের ক্রিকেট কেরিয়ার যখন অফস্টাম্পের বাইরে অনিশ্চয়তার করিডোরে সুইং করে বেরিয়ে যাওয়া বলের সামনে ব্যাট বাড়িয়ে দেওয়া ব্যাটসম্যানের মতোই নড়বড়ে দেখাচ্ছিল, তখন তাঁর রক্ষাকবচ হিসেবে এই পজিটিভ এনার্জিকেই আমদানি করেছিলেন কোচ। আর সেটাই মানসিক সমস্যার অন্ধকার থেকে তুলে এনেছিল ইনদওরের নায়ককে।
আরও পড়ুন: দ্বিতীয় বছরেও ময়াঙ্কের ব্যাটে রান দেখতে চাইছেন গাওস্কর
লোকেশ রাহুল, করুণ নায়ারদের আগে অনূর্ধ্ব-১৯ জাতীয় দলে সুযোগ পেয়েছিলেন ময়াঙ্ক আগরওয়াল। ক্রিকেটমহলে চিহ্নিত হয়েছিলেন নতুন সহবাগ হিসেবে। কিন্তু, তার পর ক্রমশ হারিয়ে যেতে লাগলেন তিনি। বড় রান আসছিল না। ২০-৩০ রানে আটকে যাচ্ছিলেন। আইপিএলেও ঘটছিল একই ব্যাপার। হতাশা ক্রমশ গ্রাস করছিল। তার মধ্যেই রাহুল-নায়াররা জাতীয় দলের হয়ে খেলে ফেলেছেন। নিজের মধ্যেই সংশয় তৈরি হচ্ছিল ময়াঙ্কের। এই পর্যায়ে কতটা যোগ্য তিনি, প্রশ্ন করছিলেন নিজেকেই।
ইনদওরে ডাবল সেঞ্চুরির পর ময়াঙ্ক। ছবি: পিটিআই।
আর এখানেই মুরলীধর জোর দিয়েছিলেন ছাত্রের মানসিকতা পাল্টানোয়। শুরু করেছিলেন নতুন ভাবে নেট। কোনও সপ্তাহে হয়তো বললেন যে, উইকেটে আসা বল খেলতে হবে। এটা বললেন না যে উইকেটের বাইরে থাকা বল ছাড়তে হবে। কোচের যুক্তি, “দেখুন, স্টাম্পে থাকা বল খেলা মানে যদি বাইরের বল খেলেও দেয় তা হলে তো আউট হবে না। কিন্তু যদি উল্টোটা বলতাম, বল ছাড়তে ছাড়তে যদি স্টাম্পের বলও ছেড়ে দিত, তা হলে কিন্তু আউট হওয়ার আশঙ্কা। চেষ্টা করতে লাগলাম, গুড হ্যাবিটস গড়ে তোলায়। চাইছিলাম ও যেন নিজে থেকেই সমস্যাগুলোর উত্তর খুঁজে নেয়। আমি ওঁকে একের পর এক প্রশ্নের মুখে দাঁড় করাতে লাগলাম। ও তখন সেগুলো নিয়ে ভাবতে থাকল। প্রশ্নের উত্তর কিন্তু দেওয়া হয়নি। সেগুলো ওর নিজস্ব চিন্তার ফসল। ও ধীরে ধীরে উপলব্ধি করল যে এটা আমার শক্তি। এগুলো আমি ভাল পারি। ও তাই যখন কোনও ভাল স্পেল বা প্রতিকূল কন্ডিশনের মুখে পড়ে, তখন ঘাবড়ে যায় না। সেগুলো থেকে বেরিয়ে আসার রাস্তাটা খোঁজে।”
আরও পড়ুন: শহরে ঢুকছে গোলাপি-জ্বর, এসে পড়লেন কোহালি-রাহানে
অর্থাৎ, কী করলে সফল হওয়া যাবে, সেই সিদ্ধান্তে পৌঁছনোটা ছাত্রের উপরই ছেড়ে দিয়েছিলেন কোচ। তিনি শুধু চাইতেন, নেটে প্রতিনিয়ত নানা রকম চ্যালেঞ্জের মুখে ময়াঙ্ককে ফেলতে। যাতে সেই চ্যালেঞ্জ টপকে রান করার পথ নিজেই বের করে নেওয়া যায়। কোচের কথায়, “শরীরের সঙ্গে তো মনের সম্পর্ক রয়েছে। মন যা ভাবছে, সে ভাবেই চলে শরীর। তাই মনে যদি উৎকণ্ঠা, ভয়, উদ্বেগ, রান না-পাওয়া, দলে নির্বাচিত না-হওয়া আসতে থাকে, তখন শরীরও নেতিবাচক ভাবে সাড়া দেয়। আর মনে যদি খুশি-শান্তি থাকে, যদি নিজের অ্যাপ্রোচ নিয়ে ভাবনা পরিষ্কার থাকে, সাফল্য নিয়ে সংশয় না থাকে, তবে রানও আসবে। ব্যাটিং কিন্তু সাবকনসাস অ্যাক্ট। এটা পুরোটাই মানসিক। সেকেন্ডের ভগ্নাংশে তো একটা বল খেলতে হয়। তার মধ্যেই সিদ্ধান্ত নিতে হয়। সেই কারণেই এমন ভাবে ট্রেনিং করিয়েছি যাতে অবচেতন মনেও ঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে। প্র্যাকটিস মন দিয়ে করো, প্রস্তুতিতে ভরসা রাখো, তার পর সব ভাবনা ছুড়ে ফেলে দাও। এটাই সাফল্যের মন্ত্র।”
কেন উদ্বেগ আসছে ময়াঙ্কের মনে, সেটাই এক সময় খুঁজে বের করেছিলেন। আর তা যে এখনও আসে না, এমন মোটেই নয়। কিন্তু তার বিরুদ্ধে বর্ম হয়ে উঠছে ট্রেনিং। ময়াঙ্ক জানেন, কী ঘটছে আর কী করেই বা তার থেকে উদ্ধার মিলবে। এখন তাই তিনি অনেক শান্ত, অনেক খুশিও। আগে সফল হওয়ার জন্য মরিয়া প্রয়াস থাকত। আর সেটাই বিপদ ডেকে আনত। সেই ছটফটানি এখন নেই। যেন পুনর্জন্ম ঘটেছে। নিজেকে আবিষ্কার করেছেন নতুন ভাবে। আর শেষ পাঁচ ইনিংসে দুটো দ্বিশতরানের রহস্য সেটাই।
এক সময় ছাত্রকে মুরলীধর বলেছিলেন যে ইনিংসে কতগুলো সিঙ্গলস রয়েছে, তা গুনতে। কেন, ফাঁস করলেন নিজেই, “ও হল বাউন্ডারি হিটার। বাউন্ডার মারতে ভালবাসে ছোট থেকে। দ্রুত বলকে সীমানায় পাঠানোতেই আনন্দ। আর সেটা করতে গিয়ে আউট হয়ে যেত। ধারাবাহিকতা থাকত না। দেখতে দারুণ লাগলেও বড় রান আসত না। আমি সেই মানসিকতা পাল্টাতে মরিয়া ছিলাম। তাই ওর ব্যাটিং থেকে বাউন্ডারির গুরুত্ব কমাতে জোর দিলাম খুচরো রানে। বললাম, কতগুলো সিঙ্গলস নেওয়া হয়েছে, তা গুনতে। ও হয়ত বলল, আজ ৩০টা সিঙ্গলস নিয়েছে। দেখা গেল তার ফলে করেছে হয়ত ৮০। এ বার সেটাকে একশোয় নিয়ে যেতে হত। একশোকে করতে হত দেড়শো।”
আরও পড়ুন: রাতে দেখায় সুবিধা, জেল্লা থাকে অনেকক্ষণ, গতি-বাউন্স বেশি, অনেকটাই আলাদা গোলাপি বল
কোচের মতে স্কিলের দিক থেকে ময়াঙ্কের খামতি ছিল না। দুর্বলতা যদি থেকে থাকে, তবে তা ওই মানসিকতাতেই। ছাত্রকে বুঝিয়ে ছিলেন, জীবনে যাই করতে চাও না কেন, সেটাকে ভেবে ফেলতে হবে। ভিসুয়ালাইজ করতে হবে। তবেই তা ঘটানো সম্ভব বাস্তবে। কোচের মতে, মাঝের যে দুই বছরে রান পাচ্ছিলেন না ময়াঙ্ক, সেটাই তৈরি করেছিল তাঁকে। মুরলীধর বললেন, “এখন ৮০তে পৌঁছলেই ওর মনে ফিরে আসে যন্ত্রণার সেই দিনগুলোর কথা। সহবাগ বলা হচ্ছিল ওকে। অথচ, এক সময় উপলব্ধি করল যে পিছিয়ে পড়েছে। বড় রান আসছে না। রাহুল-করুণরা এগিয়ে গিয়েছে অনেকটা। এটা মস্ত বড় মানসিক ধাক্কা হয়ে উঠেছিল। অন্য কেউ হলে হয়ত ছেড়েই দিত। কিন্তু ও পরিশ্রম দ্বিগুণ করে ফেলেছিল। এখন প্রচণ্ড খাটে। আর সেই কারণেই অল্প রানে সন্তুষ্ট হয় না। থামতে চায় না। দেখুন, একজন ব্যাটসম্যান সারা বছরে বড় জোর দশটা ভাল দিন পায়। তাই যে দিন ব্যাটিং খুব ভাল হচ্ছে, সে দিন বড় রান করতেই হবে।”
ময়াঙ্ক তা করেও দেখিয়েছেন। পরের লক্ষ্য সামনে টাঙিয়েও ফেলেছেন। তা হল নিজেকে ঘষা-মাজা করতে থাকা। উন্নতির রাস্তায় থাকা। বেটার অ্যান্ড বেটার। উৎকর্ষের পিছনে নিরন্তর দৌড়নো। এই দৌড়ের শেষ স্টেশন অবশ্যই বিশ্বের সেরা ব্যাটসম্যানের শিরোপা। পৌঁছনোর নিশ্চয়তা অবশ্যই নেই, কিন্তু যে কোনও সাফল্যের শর্ত একমাত্র সাধনা। ময়াঙ্ককে কিন্তু সাধনায় মগ্ন পূজারির মতোই লাগছে।