Roger Federar

আল্পসের মতোই সুন্দর এবং ভয়ঙ্কর, টেনিস কোর্টে ফেডেরার এক অজাতশত্রু যুগ

জল্পনাটা মিলিয়ে দিলেন। হাঁটু যে আর সায় দিচ্ছে না মেনে নিলেন। টেনিসকে বিদায় জানালেন ফেডেরার। সেরিনার পর তাঁকেও আর দেখা যাবে না কোর্টে। আরও বিবর্ণ হল টেনিস।

Advertisement

অভিরূপ দত্ত

শেষ আপডেট: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২২ ২০:২৮
Share:

টেনিসকে বিদায় জানালেন ‘টেনিসের রাজা’ ফেডেরার।

সেরিনা উইলিয়ামস অবসর নেওয়ার পর তাঁকে আবেগঘন বার্তা দিয়েছিলেন রজার ফেডেরার। লিখেছিলেন, ‘‘অনুগ্রহ করে আবার টেনিসে ফিরে এসো। টেনিসবিশ্ব তোমাকে যে কোনও সময়ে দু’হাতে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত থাকবে। তোমাকে আবার দেখতে পেলে খুব খুশি হব।’’

Advertisement

ফেডেরারকেও একই বার্তা দিতেই পারে টেনিসবিশ্ব। বৃহস্পতিবার তিনিও বিদায় জানালেন টেনিসকে। লেভার কাপের পর আর কখনও প্রতিযোগিতামূলক টেনিসে দেখা যাবে না ২০টি গ্র্যান্ড স্ল্যামের মালিককে। ১৯৯৮ সালে পেশাদার টেনিসে পা দেওয়া ফেডেরারের সফর শেষ হল ২৪ বছর পর। দু’যুগ মিলিয়ে অবসান হল টেনিসের এক যুগের। যে যুগের পরতে পরতে মিশে রয়েছে শিল্প। স্নিগ্ধ আক্রমণ!

১৯৯৫ সালে পেশাদার টেনিসে পা রাখেন সেরিনা। অথচ ১৯৯৮ সালেও জুনিয়র গ্র্যান্ড স্ল্যাম খেলতেন এক বছরের বড় ফেডেরার! শুরুটা একটু দেরিতেই করেছিলেন হয়তো। তবু সেই শুরুর পর আর রোখা যায়নি তাঁকে। শুধুই এগিয়েছেন। এক মাত্র ফরাসি ওপেনে বার বার আটকেছে তাঁর জয়রথ। রাফায়েল নাদাল নামে এক প্রবল প্রতিপক্ষ পাহাড় হয়ে দাঁড়িয়েছেন। তাই ফেডেরারের ঝুলিতে থাকা ২০টি গ্র্যান্ড স্ল্যামের মধ্যে ফরাসি ওপেনের সংখ্যা মাত্র একটি!

Advertisement

ফেডেরারের তিন বছর পর রাফায়েল নাদাল, আরও দু’বছর পর নোভাক জোকোভিচ পা রেখেছিলেন পেশাদার টেনিসে। পুরুষদের টেনিসে তৈরি হয়েছে শক্তির তিন কেন্দ্রস্থল। তবু ফেডেরার এগিয়েছেন স্বচ্ছন্দে। ২০১৮ সালের অস্ট্রেলিয়ান ওপেন তাঁর শেষ গ্র্যান্ড স্ল্যাম। গত বছর উইম্বলডনের পর আর টেনিস কোর্টে দেখা যায়নি তাঁকে। হাঁটুর চোট বেশ ভুগিয়েছে। গত এক বছরে তিন বার অস্ত্রোপচার হয়েছে। ফেডেরার কবে ফিরবেন কোর্টে? একটি প্রশ্নই বার বার ফিরে এসেছে। নাদাল, জোকোভিচরা এগিয়ে যাচ্ছেন যে! উৎকণ্ঠা বেড়েছে ফেডেরার-ভক্তদের মধ্যে। ফেডেরারের কি ভাল লেগেছে এত দিন কোর্টের বাইরে থাকতে? লাগেনি। নিজেই সে কথা জানিয়েছেন ফেডেরার। কিন্তু হাঁটু যে সায় দিচ্ছিল না।

সময় যত এগিয়েছে, প্রশ্নচিহ্ন তত বড় হয়েছে। আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। ফেডেরার কোর্টে ফিরবেন তো? ফিরতে পারবেন তো? বয়স যে ক্রমশ বাড়ছে।

ফেডেরারকে নিয়ে টেনিস বিশ্বের আবেগ এমনই। ফেডেরারের অনুপস্থিতি উৎকণ্ঠা বাড়িয়েছে তাঁর প্রতিপক্ষদের মনেও। নাদাল বলেছিলেন, ‘‘আশা করব ফেডেরার সুস্থ হয়ে কোর্টে ফিরবে। টেনিস জীবনের এই পর্যায়ে স্বাস্থ্যই সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ। জরুরি হল খুশি থাকা। যদি আর কোর্টে ফিরতেও না পারে, তা হলেও ওকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। যা যা অর্জন করেছে, সে সব কিছুর জন্যই ধন্যবাদ ফেডেরারকে।’’ নেয়োমি ওসাকা বলেছেন, ‘‘টেনিস খেলার জন্য যাঁরা আমাকে অনুপ্রাণিত করেন, তাঁদের অন্যতম ফেডেরার। চাইব আরও কিছু দিন ওঁকে কোর্টে দেখতে।’’

নাদাল, জোকোভিচের মতো প্রতিপক্ষরাও তাঁকে সমীহ করেন। নাদালের বিরুদ্ধে ৪০টি ম্যাচ খেলেছেন ফেডেরার। মুখোমুখি লড়াইয়ে ২৪-১৬ ব্যবধানে এগিয়ে নাদাল। তিনি বলেছিলেন, ‘‘ফেডেরার যদি নিজের সেরা টেনিস খেলে, তা হলে আমার কোনও সুযোগ থাকে না। আমি যদি দুর্দান্ত টেনিস খেলি আর ফেডেরার যদি সেরা ছন্দে না থাকে, তা হলেই শুধু ওকে হারাতে পারি।’’ জোকোভিচও বলেছিলেন, ‘‘নিজের সেরা টেনিস খেললেও ফেডেরারকে হারানোর দক্ষতা আমার নেই। আপনি যত ভালই খেলুন, রজার এমন কিছু শট মারবে যেগুলোর জবাব আপনার কাছে নেই।’’

টেনিস কোর্টে ফেডেরার হতাশ হয়েছেন বহু বার। কিন্তু রেগে গিয়েছেন, এমন ঘটনা খুব বেশি নেই। আম্পায়াররা ভুল করলেও হাসিমুখে মেনে নিতে দেখা গিয়েছে তাঁকে। ২০১১ সালের অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের ফাইনালে জোকোভিচের কাছে হেরেছিলেন ফেডেরার। একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে আম্পায়ারের সঙ্গে সামান্য বাদানুবাদে জড়ান তিনি। ম্যাচের পরে বলেছিলেন, ‘‘আম্পায়ার ভদ্রলোক বেশ ভাল। আমার উচিত ছিল ওঁর সঙ্গে আরও নরম ভাবে কথা বলা।’’

টেনিসজীবনে ফেডেরার কখনও ভদ্রতার সীমা ছাড়াননি। বরং হাসতে হাসতে কেড়ে নিয়েছেন প্রতিপক্ষের পয়েন্ট। নেটের অন্য প্রান্তে থাকা প্রতিপক্ষ হয়তো বুঝতেও পারেননি তিনি হেরে যাচ্ছেন। হাসিমুখের মধ্যেও শক্ত রাখতেন চোয়াল। চোখ থাকত বলের উপর। নজরের আড়ালে যেতে দিতেন না প্রতিপক্ষের একটি পদক্ষেপকেও। এক সময়ে তাঁর মিক্সড ডাবলস সঙ্গী ছিলেন মিরকা। পরে তিনিই ফেডেরারের স্ত্রী। যখন একসঙ্গে খেলতেন, তখন সুইৎজারল্যান্ডের টেনিসে মিরকাই ছিলেন তুলনায় বড় তারকা। তিনি টেনিস ছেড়ে দেন আগেই। স্বামীর পাশে থাকার জন্য। ফেডেরারকে বিশ্বের সর্বকালের অন্যতম সেরা টেনিস খেলোয়াড় করতে। খেলোয়াড়-জীবনে স্ত্রীর এই ত্যাগের কথা বার বার স্বীকার করেছেন ফেডেরার। কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। যেমন প্রতিপক্ষদের প্রতি বরাবর শ্রদ্ধাশীল থেকেছেন।

অবসরের সিদ্ধান্ত জানানোর সময় ফেডেরার বলেছেন, ‘‘২৪ বছর যেন ২৪ ঘণ্টার মতো কেটে গেল!’’ আসলে টেনিস তাঁকে এতটাই ব্যস্ত রেখেছিল। তার থেকেই বেশি তিনি বোধ হয় সম্মোহিত রেখেছিলেন ভক্তদের। মায় প্রতিপক্ষদেরও।

টেনিস ফেডেরারকে খ্যাতি দিয়েছে। অর্থ দিয়েছে। অথচ অহঙ্কার দেয়নি। প্রাক্তন টেনিস খেলোয়াড় স্ট্যান স্মিথ, টড উডব্রিজ, গুস্তাভো কুয়ের্তেন, মার্টিনা নাভ্রালিতোভা এবং সেরিনা অনেক আগেই বলেছেন ফেডেরারই সর্বকালের সেরা টেনিস খেলোয়াড়। প্রশংসার জবাবে ফেডেরার শুধু হেসেছেন আর একগুচ্ছ খেলোয়াড়ের নাম বলেছেন। বার বার বলেছেন তাঁর আদর্শের নাম পিট সাম্প্রাস।

তিনি নিজেও তো অসংখ্য টেনিস খেলোয়াড়ের আদর্শ। টেনিসজীবনে এমন প্রতিপক্ষের মুখোমুখিও হয়েছেন, যাঁরা মেনে নিয়েছেন তাঁকে দেখেই টেনিস খেলোয়াড় হয়েছেন। সেই প্রতিপক্ষদের অন্যতম জোকোভিচ। তিনি এক বার বলেছিলেন, ‘‘আমাকে যে আপনারা টেনিস কোর্টে দেখতে পান, সেটা রজারের জন্য। ও-ই আমার অনুপ্রেরণা। ওর বিরুদ্ধে খেলা সব সময়ই একটা দুর্দান্ত অভিজ্ঞতা। সেখানে জয়-পরাজয়টা মুখ্য নয়।’’

সেরা ছন্দের ফেডেরারের সঙ্গে কোর্টের লড়াইয়ে এঁটে ওঠা ছিল কঠিন। তার থেকেও বোধ হয় শক্ত ছিল তাঁর বিরোধিতা করা। ফেডেরার এমনই। টেনিসকে ফেডেরার উজাড় করে দিয়েছেন। টেনিসও তাঁকে সমান ভাবে ফিরিয়ে দিয়েছে। যা কখনও অস্বীকার করেননি। শুধু ২০টি গ্র্যান্ড স্ল্যাম, ছ’টি ট্যুর ফাইনাল-সহ ১০৩টি খেতাব জেতেননি, জিতে নিয়েছেন প্রতিপক্ষ থেকে সমর্থকদের মনও। এ জন্যই তিনি রজার ফেডেরার। যাঁর টেনিস আল্পসের মতোই সুন্দর এবং ভয়ঙ্কর।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement