নোভাক জোকোভিচ। ফাইল ছবি
উইম্বলডনের ফাইনালে মাত্তেয়ো বেরেত্তিনিকে হারিয়ে নিজের ষষ্ঠ খেতাব জিতেছেন নোভাক জোকোভিচ। ছুঁয়ে ফেলেছেন রজার ফেডেরার, রাফায়েল নাদালের ২০টি গ্র্যান্ড স্ল্যাম জয়ের রেকর্ডকে। দুই মারকাটারি খেলোয়াড়ের সামনে তৃতীয় শক্তি হিসেবে তাঁর উত্থান রীতিমতো অবাক করার মতোই।
শান্ত, ঠান্ডা মাথা, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, জেদি — শুধুমাত্র এই কয়েকটি বিশেষণ দিয়ে জোকোভিচকে হয়তো বর্ণনা করা যাবে না। তিনি নিঃশব্দে, নিশ্চুপে এমন একটি কাজ করে চলেছেন, যা তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতোই।
তিনি যে দেশ থেকে এসেছেন, সেই সার্বিয়া আদতে যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশ। বলকান যুদ্ধের রেশ এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি পূর্ব ইউরোপের এই ছোট্ট দেশটি। অনুন্নয়ন, অশিক্ষা, খাদ্য এবং বাসস্থানের অভাব এখনও এই দেশে বিদ্যমান।
শিশুদের শিক্ষা ও উন্নয়নে কাজ করছে জোকোভিচের সংস্থা।
জোকোভিচ সাফল্য পেয়েছেন, আকাশ ছুঁয়েছেন ঠিকই, কিন্তু ভুলে যাননি নিজের শিকড়কে। নিজের উপার্জন দিয়ে গড়ে তুলেছেন ‘নোভাক জোকোভিচ ফাউন্ডেশন’, যা প্রতিনিয়ত সার্বিয়ার উন্নয়নে এবং শিশুশিক্ষার প্রসারে কাজ করে চলেছে।
রজার বা রাফারও নিজস্ব সংস্থা রয়েছে যারা সমাজসেবামূলক কাজ করে। কিন্তু সুইৎজারল্যান্ড বা স্পেনের সঙ্গে সার্বিয়ার পরিস্থিতির আকাশ-পাতাল তফাত। অর্থনীতি, পরিকাঠামো, শিক্ষা, উন্নয়ন সবদিক থেকেই। জোকোভিচের সংগঠন এ কারণেই বাকিদের থেকে আলাদা।
জোকোভিচ লিখেছেন, “আমি একটা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ থেকে এসেছি যেখানে শিশুরা বড় কোনও স্বপ্ন দেখতে পারে না। আমি পরিবারের সমর্থন পেয়েছি আগাগোড়া, কিন্তু সবার পক্ষে সেটা সম্ভব হয় না। আমি ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের সাহায্য করতে চাই এবং নিজের উদাহরণ থেকে এটা বিশ্বাস করতে চাই যে, নিজেদের উপর বিশ্বাস রাখলে এবং স্বপ্নকে সত্যি করতে কঠোর পরিশ্রম করলে অনেক কিছুই সম্ভব।”
জোর দেওয়া হয় শিশুদের সার্বিক বিকাশে।
ঠিক কী কাজ করে জোকোভিচের সংস্থা? তারা ‘চ্যাম্পিয়ন’ তৈরি করে। জোকোভিচ ফাউন্ডেশনের বিশ্বাস, চ্যাম্পিয়নরা জন্মান না। তাদের তৈরি করতে হয়। সঠিক লালন-পালন, উৎসাহ এবং ভালবাসা দিলে তবেই চ্যাম্পিয়ন তৈরি করা যায়।
শিক্ষা প্রতিটি শিশুরই প্রাথমিক অধিকার। কিন্তু বিদ্যালয়-পূর্ববর্তী শিক্ষার অভাব রয়েছে সার্বিয়ায়। জোকোভিচ ফাউন্ডেশন এই জায়গাটা নিয়ে বিশেষ উদ্যোগের সঙ্গে কাজ করছে। শিশুদের সঠিক শিক্ষার সুযোগ দিয়ে তাদের স্বপ্ন দেখতে উৎসাহিত করা হচ্ছে। শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষাকে বিশেষ ভাবে গুরুত্ব দিয়ে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা তৈরি করা হচ্ছে, যাতে প্রত্যেকের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করা যায়।
মূলত সেই সমস্ত প্রকল্পেই বিনিয়োগ করা হয়, যেগুলি দীর্ঘমেয়াদী। এই কাজে জোকোভিচ ফাউন্ডেশনকে সাহায্য করছে স্থানীয় প্রশাসনও। তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তৈরি করা হচ্ছে একের পর স্কুল, অথবা কোনও স্কুলের পরিকাঠামো আরও উন্নত করা হচ্ছে। ইতিমধ্যেই ‘বুবামারা’ নামে একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুল প্রায় নতুন করে তৈরি করা হয়েছে। ক্লাসরুমের পরিকাঠামো উন্নতির পাশাপাশি শিশুদের খেলার জন্য রয়েছে বিশাল মাঠ।
২০১৪-য় বিরাট বন্যায় বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছিল সার্বিয়া। কার্যত ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল বহু স্কুল। জোকোভিচ ফাউন্ডেশন দায়িত্ব নিয়ে সেই স্কুলগুলিকে ফের নতুন করে গড়ে তুলেছে।
আলাদা করে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় শিক্ষকদের।
এ ছাড়া, সাহায্য করা হচ্ছে শিক্ষকদের, তাঁদের বিশেষ ভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে, যাতে তাঁরা ছোট শিশুদের সেরা শিক্ষা উপহার দিতে পারেন। জোকোভিচ ফাউন্ডেশনের মতে, সঠিক শিক্ষাই তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যত গড়ে তুলতে পারে। তাই সঠিক শিক্ষকও একই কারণে বেশি করে প্রয়োজন।
২০১৪ সালে বেলগ্রেডের বিখ্যাত থিয়েটার ‘বসকো বুহা’র দায়িত্ব নিয়েছে জোকোভিচ ফাউন্ডেশন। এটি মূলত ছোটদের থিয়েটার। নতুন করে এটিকে সাজিয়ে তোলা হয়েছে। জোকোভিচ ফাউন্ডেশনের বিশ্বাস, নাটক মানুষের চরিত্রগঠন সাহায্য করে। তাই সমস্ত ছেলেমেয়েদের নাটকে অংশ নিতে উৎসাহ দেওয়া হয় এখানে।
সংগঠন যেখানে জোকোভিচের, সেখানে খেলাধুলো থাকবে না তা কি হয়? জোকোভিচ চান, ক্লাসরুমের বাইরেও শিশুদের প্রতিভার বিকাশ হোক। তাঁর সংগঠনের তরফে প্রতি বছর আয়োজন করা হয় ফ্রেন্ডশিপ গেমসের। প্রিবোজে একটি টেনিসের পরিকাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে। নতুন কোর্ট, আলো, ড্রাইং ম্যাট, কোর্ট বেঞ্চ, আম্পায়ার্স বেঞ্চ ইত্যাদি তৈরির পিছনে প্রায় ২৫ হাজার ইউরো খরচ হয়েছে।
খেলাধুলোর পরিকাঠামো উন্নয়নেও সাহায্য করা হয়।
স্ত্রী জেলিনার সঙ্গে নিজের সংগঠনের অনুষ্ঠানে জোকোভিচ।
জোকোভিচের এই সংগঠনের বয়স খুব বেশি নয়। তবে এর মধ্যেই ৪৭টি স্কুল তৈরি করা হয়েছে, সাড়ে সাত হাজার অভিভাবককে সাহায্য করা হয়েছে। প্রশিক্ষণ পেয়েছেন ২,২০০ শিক্ষক। ৪৭ হাজারেরও বেশি শিশু এই কর্মকাণ্ডে উপকৃত হয়েছে।
জোকোভিচের সংগঠনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত তাঁর স্ত্রী জেলিনা। তিনি গ্লোবাল সিইও পদে রয়েছেন। এ ছা়ড়া বিভিন্ন দায়িত্বে রয়েছেন বিভিন্ন ব্যক্তি। সবার উপরে রয়েছেন জোকোভিচ নিজে, টেনিস নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও সমাজসেবায় যাঁর কড়া নজর রয়েছে।