স্টিয়ারিং হাতে প্রতিমা পোদ্দার।—নিজস্ব চিত্র।
রোজ অগুন্তি মিনিবাস চলাচল করে এই শহরে। কন্ডাক্টরের তারস্বর চিৎকার, মিনিবাসের দরজায় মানুষের ঝুলতে থাকা, এ সব চিত্রই আমাদের বড় পরিচিত। এমনই অজস্র লাল-হলুদ মিনিবাসের মধ্যে একটি বাসের দৃশ্যপট একটু হলেও আলাদা। সেখানেও আছে কন্ডাক্টরের চিৎকার, বাসের দরজা ধরে মানুষের ঝুলতে থাকা, ভারী জিনিসপত্র রাখা নিয়ে যাত্রীদের সঙ্গে দর-কষাকষি, এ সবের মাঝেই লুকিয়ে আছে বাসের চালক আর কন্ডাক্টরের মিষ্টি একটা ভালবাসার গল্প।
পুরনো একটি গাড়ি কিনে তা চালাচ্ছিলেন শিবেশ্বর পোদ্দার। সেই বাসেরই কন্ডাক্টর রেখেছিলেন স্ত্রী প্রতিমাকে। কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা বেরিয়ে যাচ্ছিল কেবল লোনের পিছনে। হঠাৎই খবর পান যে সরকার ১৫ বছরের পুরনো সব বাস বাতিল করে দিচ্ছে। মাথায় বাজ পড়ার উপক্রম হয় শিবেশ্বরের। এ বার ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে নতুন একটা বাস কিনে ফেলেন শিবেশ্বর। কিন্তু সেখানেও গোদের উপর বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়ায় একটা দুর্ঘটনা। যে দুর্ঘটনার পর গাড়ি চালানো প্রায় বন্ধই হয়ে যায় তাঁর।
ড্রাইভিংয়ের প্রতি বরাবরই ঝোঁক ছিল প্রতিমাদেবীর। চার চাকা গাড়ি অল্পবিস্তর চালাতেও জানতেন। কিন্তু বিরাট খরচের সংসার একা চালাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন তাঁর স্বামী শিবেশ্বর। তাই কাজ করবেন বলে ঠিক করেন প্রতিমাদেবী। শুরু করেন একটি বেসরকারি সংস্থা দিয়ে। তাঁর কথায়: ‘‘উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে কি খুব একটা ভাল চাকরি জোটে? আর টাকা যা পেতাম তাতে দুই মেয়ে, শাশুড়িকে নিয়ে সংসার চালানো শক্ত হয়ে যাচ্ছিল। তার পরে আবার চাকরিতে কোনও স্বাধীনতা নেই। তাই এক দিন ঠিক করি গাড়িই চালাবো।’’
আর তখনই পুরোদমে সংসারের হাল ধরতে হয় প্রতিমাদেবীকে। শিবেশ্বরের কাছে ড্রাইভিং ভাল ভাবে রপ্ত করে অ্যাম্বুল্যান্স চালানো শুরু করে দিলেন প্রতিমা। তার পর কিছু দিন ট্যাক্সি। বেশ কিছুটা টাকা জমিয়ে প্রতিমাদেবী শুরু করে দিলেন হাওড়া-নিমতা রুটে মিনিবাস চালানো। আর খালাসি হলেন শিবেশ্বর।
হাওড়া-নিমতা মিনিবাস। চালাচ্ছেন কলকাতার একমাত্র মহিলা বাস ড্রাইভার প্রতিমা। বাসের খালাসি তাঁরই স্বামী শিবেশ্বর। গত ৬ বছর ধরে এই রুটে বাস চালাচ্ছেন প্রতিমাদেবী, কখনও কোনও ভুলচুক হয়নি। এই কৃতিত্বের সিকিভাগটাই প্রতিমাদেবী দিচ্ছেন স্বামী শিবেশ্বরকে। মুচকি হেসে বলছেন, ‘‘প্রতিটা মুহূর্তে ও আমাকে সজাগ রাখে। খুব সন্তর্পণেই আমি বাস চালাই। কারণ, ছোট্ট ভুল হলেও কেউ ছেড়ে কথা বলবে না।’’
আরও পড়ুন
আমার ছদ্মবেশী মেয়েদের কথা
যুগলের সংসারে দুই মেয়ে এবং শিবেশ্বরের ৯৫ বছরের বৃদ্ধা মা। পরিবারের সকলের থেকে সমান সমর্থন পেয়েছেন প্রতিমাদেবী। বড় মেয়ে রাখী যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাথামেটিক্স অনার্সে পাঠরত। খেলাধূলায় দুই মেয়েরই তীব্র ঝোঁক। রাখী ইতিমধ্যেই সাঁতারে রাজ্যের হয়ে একাধিক পুরস্কারও নিয়ে এসেছেন। অল্পবিস্তর ড্রাইভিংও জানা আছে রাখীর। আর তার বোন সাথী এখন ক্লাস নাইনের ছাত্রী।
হাওড়া-নিমতা রুটে যে ট্রাফিক পুলিশেরা রয়েছেন, তাঁদের সকলের কাছেই প্রতিমাদেবী এক জন সেফ ড্রাইভার। তাঁদের মতে, প্রতিমাদেবীর মতো আরও সাবধানী চালকদের এই শহরে প্রয়োজন আছে। আর প্রতিমাদেবী বলছেন, ‘‘অন্য ড্রাইভারদের মতোই স্পিডে গাড়ি চালাতে পারি। কিন্তু পুরোপুরি নিয়ম মেনে চালাই। কখনও কেউ আমাকে ওভারটেক করতে দেখতে পাবেন না। চলন্ত বাসে যাত্রী তুলতে বা নামাতেও দেখবে না।’’ ভোর সাড়ে তিনটেয় নিমতা থেকে হাওড়ার উদ্দেশে প্রথম ট্রিপটি শুরু করেন প্রতিমা এবং শিবেশ্বর।
আরও পড়ুন
‘কেরিয়ার আর সংসার সমান তালে চলে না’
তবে এই ৬ বছরে জীবন অনেকটাই বদলেছে পোদ্দার দম্পতির। হাওড়া-নিমতা বাসস্ট্যান্ড দু’টিতেই সাংবাদিকদের ভিড়, বাসে যুগলের সঙ্গে দেদার সেলফি— এই সব মিলিয়েই প্রতিমা যেন এখন এক সেলিব্রিটি। তবে সেই সেলিব্রিটি তকমাকে বিন্দুমাত্র পাত্তা দিতে নারাজ প্রতিমা পোদ্দার। বলছেন, ‘‘আমি আমার কাজ করে যাব। বাকিটা নিয়তি।’’ আর একটু যোগ করে বললেন, ‘‘আমার বাবা রাজমিস্ত্রি ছিলেন, আর আমি বিএ পড়তে শুরু করেও শেষ করতে পারিনি। সংবাদপত্রে নিজের ছবি বেরবে, কল্পনাতেও আসেনি। এ সবই মানুষের ভালবাসা।’’
পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নিজেকে মানিয়ে নিতে কখনও সমস্যা হয়নি প্রতিমা পোদ্দারের। বলছেন, ‘‘আমার সাফল্যের পুরোটা জুড়েই এক জন পুরুষ। আবার তেমনই এক জন সফল পুরুষের পিছনেও এক জন নারীরই হাত থাকে। নারী-পুরুষ একে অন্যের পরিপূরক, দু’জনের অবদানেই তো এগিয়ে চলবে সমাজ।’’ আর আন্তর্জাতিক নারী দিবসে সমাজের পিছিয়ে পড়া নারীদের কাছে তাঁর বার্তা, হীনম্মন্যতায় না ভুগে, ভয় না পেয়ে এগিয়ে আসুন। বাস চালিয়ে রুজি রোজগার করতে চাইলে আমাদের সবসময় পাশে পেয়ে যাবেন।’’