স্কুলের গণ্ডি পার হওয়ার সময় যে রচনাটা আমরা বহু বার পড়ি, তা হল ‘বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ’। সেখানে বিজ্ঞানের পক্ষে ও বিপক্ষে আলোচনাটা দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়েছে। স্টেম সেল অর্থাৎ অঙ্কুর কোষের গবেষণা অনেকটা সেই রকম। এই গবেষণা আমাদের শরীরের কঠিন অসুখ-বিসুখগুলো নিরাময়ে কতটা উপকারে আসবে, সামাজিক জীবনে কী প্রভাব ফেলবে, তা নিয়ে বিতর্ক তুঙ্গে। তা সত্ত্বেও বিজ্ঞানীদের নজর অঙ্কুর কোষ গবেষণার দিকেই, জারি রয়েছে গবেষণা।
আমাদের গোটা দেহটাই কোটি কোটি কোষ দিয়ে বানানো। এই কোষগুলোর চরিত্র আবার এক ধরনের নয়। এই কোষগুলোর মধ্যে থাকে ফিতের মতো দেখতে ক্রোমোজ়োম। জনন কোষ অর্থাৎ শুক্রাণু ও ডিম্বাণু ছাড়া মানুষের সমস্ত কোষের ক্রোমোজ়োম সংখ্যা একই— ২৩ জোড়া বা ৪৬টা। শুধু জনন কোষের ক্ষেত্রে এই সংখ্যাটা কমে ঠিক অর্ধেক হয়। এই ২৩টা ক্রোমোজ়োমের মালিক শুক্রাণু ও ডিম্বাণু নিজেদের মধ্যে মিলিত হয়ে প্রথম যে কোষটা সৃষ্টি করে, তার ক্রোমোজ়োম সংখ্যা আগের মতো ২৩ জোড়া হয়ে যায়। এই তৈরি হওয়া প্রথম কোষকে বলে অঙ্কুর কোষ। মাতৃজঠরে যে শিশু ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠে, এই অঙ্কুর কোষ থেকে তার জয়যাত্রা শুরু হয়। আমাদের দেহে আর পাঁচটা যে সাধারণ কোষ রয়েছে, তা থেকে এই অঙ্কুর কোষের চরিত্র একেবারেই আলাদা। আর এর ক্ষমতা? সাধারণ কোষের সঙ্গে কোনও তুলনাই চলে না। আমাদের পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তৈরিতে অঙ্কুর কোষের বিশাল ভূমিকা আছে। সবচেয়ে অবাক করা ঘটনা হল, অঙ্কুর কোষ বিভাজিত হয়ে যে কোষগুলো তৈরি হচ্ছে, সেগুলো কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রের। কেউ বানাচ্ছে হৃৎপিণ্ড তো অন্য কতগুলো কোষ ফুসফুস তৈরিতে ব্যস্ত থাকছে। একটা কোষ থেকে এই রকম ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রের নানা কোষ তৈরি করতে পারে বলেই অঙ্কুর কোষের এত আদর বিজ্ঞানীদের কাছে।
সাধারণত তিন ধরনের অঙ্কুর কোষ পাওয়া যায়। শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর মিলনের ফলে সবচেয়ে প্রথম যে অঙ্কুর কোষ তৈরি হয়, তার নাম দেওয়া হয়েছে টোটিপোটেন্ট। ইংেরজি শব্দ ‘টোটাল পোটেনশিয়াল’ থেকে এটা এসেছে, অর্থাৎ সর্বক্ষমতাসম্পন্ন অঙ্কুর কোষ। সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সহ একটা গোটা দেহ তৈরি হয়ে যায় ওই একটামাত্র কোষ থেকে। কিন্তু টোটিপোটেন্ট অঙ্কুর কোষ প্রথমেই বিভাজিত হয়ে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তৈরি করে না। তারা বিভাজিত হয়ে যে কোষগুলো তৈরি করে, তা প্রথম কোষের হুবহু কার্বন কপি। যদি এই সদ্য তৈরি হওয়া টোটিপোটেন্ট অঙ্কুর কোষগুলোকে আলাদা আলাদা করে বাড়তে দেওয়া হয়, তবে তারা প্রত্যেকে এক-একটা আস্ত মানবশিশু তৈরির ক্ষমতা ধরে। টোটিপোটেন্ট অঙ্কুর কোষগুলো শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বানানোর প্রক্রিয়া শুরু করলে তৈরি হয় একটা পিণ্ড। নাম ব্লাস্টোসিস।
ব্লাস্টোসিস-এর মধ্যের কোষগুলো বিভাজিত হয়ে বাড়তে থাকে। সেখানে যে অঙ্কুর কোষগুলো তৈরি হচ্ছে, তা কিন্তু টোটিপোটেন্ট থেকে আলাদা। এরা ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রের কোষ তৈরি করে। কোনওটা রক্ত তৈরি করছে, তো কোনওটা ত্বক। এই ধরনের অঙ্কুর কোষগুলোর নাম দেওয়া হয়েছে প্লুরিপোটেন্ট, যার অর্থ নানাবিধ ক্ষমতাযুক্ত।
এই কোষগুলো আবার নিজেরা ভাঙতে থাকে। প্রথমে এক থেকে দুই, তার পর দুই থেকে চার, চার থেকে আট, এই ভাবে ভাঙতে ভাঙতে হাজার হাজার কোষ তৈরি হয়। কিন্তু সমস্ত কোষ একই রকম। নাম দেওয়া হয়েছে মাল্টিপোটেন্ট।
টোটিপোটেন্ট ও প্লুরিপোটেন্ট অঙ্কুর কোষ একমাত্র ভ্রূণ ছাড়া অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। কিন্তু মাল্টিপোটেন্ট অঙ্কুর কোষ যে কোনও বয়সের মানুষের দেহ থেকে পাওয়া যেতে পারে। যেমন, আমাদের গায়ের চামড়ায় ও রক্তে। রক্তের বিভিন্ন কোষ, যেমন— লোহিত, শ্বেত, অনুচক্রিকা— এরা একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বাঁচে। তার পর মৃতদের বদলে নতুনরা এসে কাজকর্ম করতে থাকে বলেই আমরা বেঁচে থাকি। এই নতুন তরতাজা কোষ সরবরাহ করার পিছনে রয়েছে মাল্টিপোটেন্ট অঙ্কুর কোষ।
স্টেম সেল বা অঙ্কুর কোষ নামটা প্রথম জনসমক্ষে আনেন আলেকজ়ান্ডার ম্যাক্সিমো, ১৯০৯ সালে। রক্তের কোষগুলো কী ভাবে তৈরি হয়, তা নিয়ে তিনি গবেষণা করছিলেন। কিন্তু ১৯৬৩ সালে প্রথম রক্তের অঙ্কুর কোষ তৈরি করে তাক লাগিয়ে দেন কানাডার দুই বিজ্ঞানী আরনেস্ট ম্যাককুলোচ এবং জেমস টিল। তার পরে এই বিষয়ে গবেষণা অনেক এগিয়েছে। জাপানের বিজ্ঞানী শিনইয়া ইয়ামানাকা আর একটু এগিয়ে দেন জেমস টমসনের কাজকে। ২০০৭ সালে বিশ্বকে চমকে দিয়ে দেখালেন, জিন-এর কাজে সামান্য অদলবদল করে ত্বকের কোষকে অঙ্কুর কোষে পরিণত করা যায়।
গত ৫০ বছরের গবেষণা এই ইঙ্গিত দিয়েছে, রোগগ্রস্ত বা নষ্ট হয়ে যাওয়া কোষগুলোকে চিহ্নিত করে তাদের জায়গায় যদি নতুন সুস্থ কোষ প্রতিস্থাপন করে দেওয়া যায়। কিন্তু বিভিন্ন ধরনের সুস্থ কোষ তৈরি হবে কোথা থেকে? সমাধান অঙ্কুর কোষ।
চিকিৎসায় যুগান্তর আনার সম্ভাবনা রয়েছে যে গবেষণায়, সেই অঙ্কুর কোষ নিয়ে এত বিতর্ক কেন? আসলে বিতর্ক এই অঙ্কুর কোষের উৎপত্তিস্থল ভ্রূণকে নিয়ে। টেস্টটিউব বেবির কথা এখন অজানা নয়। এ ক্ষেত্রে, চিকিৎসকরা সন্তানহীন দম্পতির কাছ থেকে শুক্রাণু ও ডিম্বাণু সংগ্রহ করে পরীক্ষাগারে উপযুক্ত পরিবেশে অনেকগুলো ভ্রূণ তৈরি করেন। তার থেকে প্লুরিপোটেন্ট অঙ্কুর কোষ তৈরি হয়।
অঙ্কুর কোষ গবেষণায় টেস্টটিউব বেবির পদ্ধতি কিছুটা অনুসরণ করা হয়। কিন্তু বাদ সাধছে ভ্রূণ সংগ্রহের পদ্ধতি ও তার ব্যবহার। কাজে না লাগা ভ্রূণগুলো বিজ্ঞানীরা ব্যবহার করছেন অঙ্কুর কোষ তৈরি করতে। তার পর তা থেকে প্রয়োজনমতো বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বানিয়ে বাকিটাকে নষ্ট করে ফেলা হচ্ছে। আর এইখানেই আপত্তি জানাচ্ছেন বিভিন্ন ধর্মীয় ও মানবাধিকার সংগঠন এবং সমাজের নানা স্তরের কিছু মানুষ। তাঁদের মতে, সুযোগ পেলে এই ভ্রূণগুলো থেকে এক-একটা শিশু জন্ম নিতে পারবে। প্রবল চাপের কাছে বিজ্ঞানী ও তাঁদের সমর্থনকারীদের যুক্তি খড়কুটোর মতো উড়ে গিয়েছে। সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে আসা চাপের কাছে নতি স্বীকার করে অনেক উন্নত দেশ অঙ্কুর কোষ গবেষণা আংশিক অথবা পুরোপুরি নিষিদ্ধ করতে বাধ্য হয়েছে।
এখন সীমিত ভাবে যে অঙ্কুর কোষ চিকিৎসা চলছে, তা খুবই ব্যয়বহুল। পুরোপুরি অঙ্কুর কোষ চিকিৎসা চালু না হলে খরচ সাধারণ মানুষের নাগালে আসবে না। এই বিতর্কের মধ্যে অঙ্কুর কোষের ভবিষ্যৎ কী, সেটাই দেখার।