ইনসেটে, কলকাতার এম পি বিড়লা তারামণ্ডলের অধিকর্তা দেবীপ্রসাদ দুয়ারি। গ্রাফিক: নিরূপম পাল।
গত পাঁচ দশকে ‘লাল গ্রহ’ মঙ্গলে অভিযানে তো কোনও খামতি ছিল না নাসার। শুধুই প্রদক্ষিণ নয়। মঙ্গলকে ছুঁয়ে দেখার ক্ষেত্রেও।
১৯৭৫ থেকে ২০২১। এ বারের রোভার পারসিভের্যান্স-কে নিয়ে গত ৪৬ বছরে মঙ্গলে নাসা পা ছোঁয়াতে চলেছে দশম বার। তা হলে এ বার কেন লাল গ্রহে নাসার রোভার পারসিভের্যান্স-এর পদার্পণ নিয়ে গোটা পৃথিবীর এত কৌতূহল? কেন এই মঙ্গল অভিযানকে বলা হচ্ছে ঐতিহাসিক ঘটনা? কেন ভারতীয় সময় রাত পৌনে ১টা থেকে তার সরাসরি সম্প্রচার করতে চলেছে নাসা?
তার কারণ মূলত একটাই। আর ১৫ কী ২০ বছরের মধ্যে সভ্যতার দ্বিতীয় উপনিবেশ লাল গ্রহে গড়ে তোলা সম্ভব হবে কি না, তার জন্য মূল যে যে উপাদানগুলির দরকার সেগুলি মঙ্গলেই বানিয়ে নেওয়া যাবে কি না, গেলে কী পরিমাণে, এই প্রথম সেই সব জানতেই লাল গ্রহে রোভার পাঠাল নাসা। সঙ্গে পাঠাল একটি হেলিকপ্টারও। ১৯ মার্চের পর এক মাস ধরে যা ওড়ানো হবে মঙ্গলের আকাশে। অন্তত বার পাঁচেক। দেড় থেকে দু’মিনিটের জন্য। পৃথিবীতে প্রথম উড়ান সম্ভব হয়েছিল রাইট ভাইদের দৌলতে। তার ১০০ বছর পর অন্য কোনও গ্রহে এ বারই প্রথম হেলিকপ্টার ওড়াতে চলেছে সভ্যতা। আর এক ইতিহাস।
রোভার নামাতে গেলেই ল্যান্ডার নামাতে হয়। ল্যান্ডার নামলে তার শরীরের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে রোভার। পরে তা ভিন মুলুকের নানা এলাকা চষে বেড়ায়।
১৯৭৫ থেকে এ বার পর্যন্ত যে দশ বার মঙ্গলে পা ছোঁয়াতে চলেছে নাসা, তার শুরু হয়েছিল ’৭৫-এ দু’টি আলাদা মিশন ‘ভাইকিং-১’ এবং ‘ভাইকিং-২’ দিয়ে। দু’টিই ছিল ল্যান্ডার। মঙ্গলে সেই প্রথম ল্যান্ডার পাঠিয়েছিল নাসা। তার পর ২১ বছর লাল গ্রহে আর পা ছোঁয়ানোর তেমন চেষ্টা করেনি নাসা। তার মধ্যে এক বার ব্যর্থও হয়েছিল। ’৯৬-এ ফের মঙ্গলে ল্যান্ডার পাঠায় নাসা। ‘পাথফাইন্ডার’। একই মিশনে সঙ্গে ছিল রোভারও। ‘সোজর্নার’। তার ৭ বছর পর, ২০০৩ সালে একটি ল্যান্ডার থেকে বেরিয়ে ফের লাল গ্রহের মাটি চষেছিল নাসার ‘স্পিরিট’ রোভার। ওই বছরই আর একটি মিশনে একটি ল্যান্ডার নিয়ে মঙ্গলে নেমেছিল নাসার ‘অপরচুনিটি’ রোভার। এর পর ‘ফিনিক্স’ ল্যান্ডার নামাল নাসা, ২০০৭-এ। নাসার ‘কিউরিওসিটি’ রোভার নামল তার ৪ বছর পর। ২০১১-এ। ৩ বছর আগে মঙ্গলে নাসা পাঠিয়েছিল আর একটি ল্যান্ডার ‘ইনসাইট’। মঙ্গলের ‘হৃদকম্পন’ (‘মার্সকোয়েক’ বা মঙ্গলের ভূকম্প বুঝতে)। নাসার এই মঙ্গলকাব্যে নতুন সংযোজন- রোভার ‘পারসিভের্যান্স’। যে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছে হেলিকপ্টার ‘ইনজেনুইটি’।
এটাই (পারসিভের্যান্স) মঙ্গলে নাসার প্রথম অ্যাস্ট্রোবায়োলজি মিশন। এখানেই এ বারের অভিযানের প্রধান অভিনবত্ব।
সভ্যতাকে লাল গ্রহে দ্বিতীয় উপনিবেশ গড়ে তুলতে হলে, সেখানে লম্বা একটা সময় অতিবাহিত করতে হলে, গাছপালা নিয়ে বেঁচেবর্তে থাকতে হলে সবচেয়ে প্রথমে যে দু’টির প্রয়োজন তা হল, শ্বাসের বাতাস। গ্যাসীয় অবস্থায় থাকা অক্সিজেন। আর দরকার তরল অবস্থায় থাকা পর্যাপ্ত জল।
এত দিনের বিভিন্ন মঙ্গল অভিযানের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা জানতে পেরেছেন, মঙ্গলের পিঠের (‘সারফেস’) মাত্র ইঞ্চিদু’য়েক নীচে এখনও রয়েছে জলীয় বরফ। সেখানকার তাপমাত্রা শূন্যের নীচে থাকে বলে সেই জল বরফ হয়ে রয়েছে। তা মঙ্গলের পিঠের উপরের মতো পুরোপুরি বাষ্পীভূত হয়ে যায়নি, এখনও পর্যন্ত।
কিন্তু বাঁচার, শ্বাস নেওয়ার জন্য অক্সিজেন একেবারেই নেই, এখনও যৎসামান্য টিঁকে থাকা লাল গ্রহের বায়ুমণ্ডলে। সেই মুলুকের বায়ুমণ্ডলের ৯৬ শতাংশই ভরে আছে বিষাক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাসে।
নাসার এ বারের অভিযানের অন্যতম মূল লক্ষ্য- মঙ্গলের বায়ুমণ্ডলের কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস থেকে অক্সিজেন গ্যাসকে টেনে বের করে নেওয়া যায়। লাল গ্রহের মাটিতে দাঁড়িয়েই। সে ক্ষেত্রে আর পৃথিবীর গবেষণাগারের প্রয়োজনই থাকবে না।
তাতে সভ্যতা দ্বিতীয় উপনিবেশ গড়ে তোলার জন্য প্রাথমিক ভাবে টিঁকে থাকার অক্সিজেন লাল গ্রহ থেকেই জোগাড় করে নিতে পারবে। তার পর যে গাছপালা পৃথিবী থেকে পাঠানো হবে তারাই মঙ্গলের বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস টেনে নিতে পারবে নিজেদের সালোকসংশ্লেষের মাধ্যমে। আর সেই গাছপালাই তখন বাতাসে ছাড়বে অক্সিজেন। যা সভ্যতার দ্বিতীয় উপনিবেশের শ্বাসের বাতাসের ঘাটতি মেটাতে পারবে।
আবার এই অক্সিজেনই হয়ে উঠবে লাল গ্রহে সভ্যতার বিকল্প জ্বালানিও। তার ফলে মঙ্গল থেকে পৃথিবীতে ফেরার জন্য রকেট তার জ্বালানি ভরে নিতে পারবে লাল গ্রহেই। সেই জ্বালানি আর পৃথিবী থেকে ভরে পাঠাতে হবে না মহাকাশযানে। সাধারণত কোনও মহাকাশযানে ২৭ টন অক্সিজেন ভরে পাঠাতে হয়। সেটা যদি মঙ্গলের বায়ুমণ্ডল থেকেই জোগাড় করে নেওয়া যায় তা হলে পৃথিবী থেকে পাঠানো মহাকাশযানের ওজন কমবে। সেই মহাকাশযানে আরও কম শক্তির ব্যাটারিতেও কাজ হবে। তাতে ব্যাটারিরও ওজন কমবে।
মঙ্গলে এ বার যেখানে নামছে পারসিভের্যান্স সেই জায়গাটার নাম ‘জেজোরো ক্রেটার’। সুবিশাল একটা গহ্বর। যার ব্যাস ৪৯ কিলোমিটার। গ্রহাণু বা অন্য কোনও মহাজাগতিক বস্তুর সঙ্গে সংঘর্ষে সুদূর অতীতে এই সুবিশাল গহ্বরের সৃষ্টি হয়েছিল লাল গ্রহের পিঠে। জায়গাটা লাল গ্রহের উত্তর গোলার্ধ আর বিষুবরেখার মাঝামাঝি, উত্তর গোলার্ধের উত্তর-পশ্চিমে।
এই জায়গায় মাটির নীচে জলের উপস্থিতি থাকলেও থাকতে পারে। এমনকি এই গহ্বরের মুখের কাছে পাওয়া গিয়েছে বদ্বীপের মতো দু’টি এলাকাও। তাই অতীতে তরল অবস্থায় থাকা জলের সম্ভাবনার জন্য এই জায়গাটিকেই বেছে নিয়েছে নাসা।
এ বার পারসিভের্যান্স-এ এমন কয়েকটি যন্ত্র রয়েছে যা আগে পাঠানো নাসার যন্ত্রগুলির আধুনিক সংস্করণ। একটি যন্ত্র লেসার রশ্মি পাঠিয়ে মঙ্গলের পাথর ফাটিয়ে দেবে। সেখান থেকে বাষ্পীভূত হওয়া ধুলোর বিশ্লেষণ করে বোঝার চেষ্টা করবে কোন কোন খনিজ পদার্থ রয়েছে লাল গ্রহে। আর একটি যন্ত্রে রয়েছে এমন একটি রাডার যা থেকে রেডিও তরঙ্গ পাঠিয়ে মঙ্গলের অভ্যন্তর সম্পর্কে জানার চেষ্টা হবে। সেখানকার ভূপ্রাকৃতিক গঠন আর তার নিয়মিত রদবদল কতটা কী হচ্ছে তা বুঝতে।
সভ্যতা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব লাল গ্রহে দ্বিতীয় উপনিবেশ গড়ে তোলার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। নাসার এ বারের মঙ্গল-অভিযানে সেই বার্তাই ধ্বনিত হল।
লেখক কলকাতার এম পি বিড়লা তারামণ্ডলের অধিকর্তা।