কাজের ফাঁকে: বায়োএনটেক-এর কর্ণধার ওজ়লেম টুরেসি ও উগর শাহিন। ফাইজ়ারের টিকার নেপথ্যে তুর্কি বংশোদ্ভূত এই জার্মান দম্পতিই।
এখনও নিয়মিত সাইকেল চালিয়ে নিজের অফিসে আসেন বছর পঞ্চান্নর উগর শাহিন। তাঁর গিন্নি, তিপ্পান্ন বছর বয়সি গবেষক ওজ়লেম টুরেসির জীবনযাপনও অত্যন্ত সাদামাঠা। দেখলে বোঝা দায় যে, তুর্কি বংশোদ্ভূত এই জার্মান দম্পতি প্রায় ৩০০ কোটি ইউরো মূল্যের এক সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা! গত কালের একটি ঘোষণার পরে যে সংস্থার বাজারদর আরও তরতরিয়ে বাড়ছে।
বায়োএনটেক— গবেষক দম্পতির এই সংস্থার বিশেষ এমআরএনএ প্রযুক্তির সাহায্যে তৈরি করোনার টিকা তৃতীয় দফার ট্রায়ালে ৯০% সফল হয়েছে বলে সুখবর শুনিয়েছে আমেরিকার ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থা ফাইজ়ার। ভবিষ্যতে এটিই করোনা প্রতিরোধে নয়া দিশা দেখাতে চলেছে বলে বাজি রাখছেন অনেকেই।
দু’জনেই অভিবাসী পরিবারের সন্তান। উগর শাহিনের জন্ম সিরিয়া সীমান্তবর্তী ইসকেনদেরানে। মাত্র চার বছর বয়সে পরিবারের সঙ্গে তুরস্ক থেকে জার্মানিতে পাড়ি। কোলোনের একটি গাড়ি কারখানায় সাধারণ কর্মী ছিলেন শাহিনের বাবা। চার বছর বয়সে পরিবারের সঙ্গে জার্মানিতে চলে আসেন টুরেসিও। ইস্তানবুলের এক মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে তিনি। বাবা ছিলেন শল্যচিকিৎসক। বাবাকে দেখতে দেখতেই চিকিৎসাবিদ্যার প্রতি আগ্রহ তৈরি। মেডিসিনের প্রতি উগরের টান অবশ্য জন্মেছিল বিজ্ঞানের বইয়ের হাত ধরেই।
হমবার্গের ‘সারল্যান্ড ইউনিভার্সিটি হসপিটাল’-এ প্রথম দেখা। উপলক্ষ, একটি বিশেষ প্রজেক্ট— ক্যানসারের চিকিৎসায় একটি ওষুধ তৈরি। যে ওষুধ শরীরের নিজস্ব প্রতিরোধ ক্ষমতাকে এমন ভাবে গড়ে তুলবে, যাতে টিউমার জাতীয় কিছুকে গোড়াতেই চিহ্নিত করে সেটির অস্তিত্ব নির্মূল করা যায়।
২০০১ সালে একজোট হয়ে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন শাহিন এবং টুরেসি। নাম, গ্যানিমেড ফার্মাসিউটিক্যাল্স। ‘মোনোক্লোনাল অ্যান্টিবডিজ়’— এই নয়া ধরনের ওষুধ তৈরিই ছিল সংস্থাটির বিশেষত্ব। যা ক্যানসার কোষকে চিহ্নিত করার জন্য শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতাকেই কাজে লাগায়।
আরও পড়ুন: পাখি দেখার নেশায়
সংস্থার কর্ণধার হিসেবে একসঙ্গে যাত্রা শুরুর বছর ঘুরতে না-ঘুরতেই একে অপরকে জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নেন দুই গবেষক। ২০০২ সালে গাঁটছড়া বাঁধেন। তবে তাঁদের জীবনযাত্রার মতোই সেই বিয়ের আসরও ছিল অত্যন্ত অনাড়ম্বর। সংশ্লিষ্ট দফতরে সইসাবুদ সেরে বিয়ের দিনেও ল্যাব-কোট পরে নেন দু’জনেই। তার পর গবেষণাগারেই কাটে বাকি দিনটা।
ক্যানসার নিয়েই এগোচ্ছিল গবেষণা। বিশেষ উপসর্গের ভিত্তিতে ক্যানসারের টিকা তৈরির লক্ষ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নেন দম্পতি। ২০০৮ সালে প্রতিষ্ঠা করেন বায়োএনটেক। এমআরএনএ পদ্ধতি নিয়েই চলছিল পরীক্ষা-নিরীক্ষা।
এ বছরের জানুয়ারিতে ‘ল্যানসেট’ পত্রিকায় শাহিন পড়েছিলেন চিনের উহান শহরে ব্যাপক হারে সংক্রমণ ছড়ানো একটি বিশেষ ভাইরাসের কথা। এই নয়া ভাইরাস যে বিশ্বের উপরে বেশ কঠিন প্রভাব ফেলতে পারে, তা ওই প্রতিবেদন পড়েই খানিকটা আন্দাজ করে নিয়েছিলেন তিনি।
সময়ের সঙ্গে সংক্রমণের ঢেউ আছড়ে পড়ে জার্মানিতেও। এ বার আর দেরি করতে চাননি শাহিন-টুরেসি। দু’জনে মিলে এমআরএনএ পদ্ধতির সাহায্যে করোনাভাইরাস দমন সংক্রান্ত পদ্ধতির গবেষণা শুরু করে দেন জোরকদমে। সঙ্গে নেন কয়েক জন সহকর্মী বিশেষজ্ঞকে। কিছু দিনের মধ্যেই এই টিকা সংক্রান্ত গবেষণায় বাণিজ্যিক দিক থেকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে আমেরিকার ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থা ফাইজ়ার। যৌথ উদ্যোগে ঝড়ের গতিতে চলে গবেষণা। একে একে তিন দফার ট্রায়ালের মধ্যে দিয়ে যায় তাদের এই ভ্যাকসিন ক্যান্ডিডেট। সাম্প্রতিক ট্রায়ালে যা ‘অভাবনীয় সাফল্যের মুখ দেখেছে’ বলে মত বিশেষজ্ঞদের একাংশের।
সম্ভাব্য ভ্যাকসিন হিসেবে নজর কাড়ায় সেপ্টেম্বর থেকেই এক লাফে প্রায় ২০০ কোটি ইউরো বেড়ে যায় বায়োএনটেক-এর বাজারদর। ভ্যাকসিন বাজারে এলে, যা আকাশ ছুঁতে পারে বলে মত অনেকের। ইতিমধ্যেই ১০০ জন সবচেয়ে বিত্তশালী জার্মানের তালিকায় উঠে এসেছে শাহিনের নাম। ঘনিষ্ঠেরা আশাবাদী, সব ঠিক থাকলে ভবিষ্যতে অতিমারি পরিস্থিতি থেকে বিশ্বকে উদ্ধারের স্বীকৃতি হিসেবে নোবেলও হয়তো আসতে পারে তাঁদের ঝুলিতে। নেট দুনিয়ায় ‘পাওয়ার কাপল’ হিসেবে পরিচিত এই দম্পতির জীবনে এমন লম্বা-চওড়া সাফল্যের খতিয়ান কতটা প্রভাব ফেলতে পারে? পরিচিতদের মতে, মাটির মানুষ তাঁরা। তা-ই থাকবেন। তবে চিকিৎসা সংক্রান্ত গবেষণার স্বপ্ন হয়তো আরও উঁচু উড়ান ধরবে।