এই সেই মহাদৈত্য। ঢুকে পড়েছে সৌরমণ্ডলে। ছবি- নাসার সৌজন্যে।
ধেয়ে আসছে এক অকল্পনীয় চেহারার মহাদৈত্য। সৌরমণ্ডলের একেবারে বাইরের প্রান্ত থেকে। ৩০ লক্ষ বছরেরও বেশি সময় পরে। আবার।
আপাদমস্তক বরফে গড়া যার শরীর। যে শরীর থেকে সবেমাত্র মাথাটা বেরিয়ে আসতে দেখা গিয়েছে। প্রকাণ্ড লেজটা এখনও গজায়নি।
চেহারায় এতটাই সুবিশাল যে, গোড়ার দিকে তাকে অনেকেই মনে করেছিলেন হয়তো প্লুটোর মতোই কোনও বামন গ্রহ (‘ডোয়ার্ফ প্ল্যানেট’)।
ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসছে মহাদৈত্যের মাথা!
কিন্তু পরে ভুল ভাঙে জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের। তাঁরা দেখেছেন, সেই আপাদমস্তক বরফে মোড়া মহাদৈত্যের মাথাটা ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসছে সূর্যের দিকে ছুটে আসার পথে। সে যতই কাছে আসবে ততই তার মাথাটা বড় হবে। গজাবে লেজ আর সেটাও প্রকাণ্ড হয়ে উঠবে উত্তরোত্তর। সূর্যের টানে। ধূমকেতু হয়ে উঠবে পুরোদস্তুর।
এ বার চেনা গেল মহাদৈত্যকে
এই মহাদৈত্য যে আদতে একটি প্রকাণ্ড ধূমকেতু, তা বুঝতে পেরে সে কোন পথ ধরে ধেয়ে আসছে সৌরমণ্ডলে, কোন পথ ধরে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করবে আর তার পর কোন পথ ধরে ফিরে যাবে তার সাকিন বরফের মহাসাম্রাজ্য ওরট্ ক্লাউডে অঙ্ক কষে সেই সব হিসেবনিকেশও করে ফেলেছেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। তাঁদের সেই গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান গবেষণা পত্রিকা ‘অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল জার্নাল লেটার্স’-এ। বুধবার।
কেন এমন নাম
এই মহাদৈত্যের প্রথম হদিশ পেয়েছিলেন পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানী অধ্যাপক। পেদ্রো বার্নাদিনেলি ও গ্যারি বার্নস্টিন। তাঁদের নামেই নামকরণ করা হয়েছিল এই মহাদৈত্যাকার মহাজাগতিক বস্তুর। ‘বার্নাদিনেলি-বার্নস্টিন’। এটি যে ধূমকেতুই সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার পর জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এখন এই মহাদৈত্যকে ডাকছেন ‘বার্নাদিনেলি-বার্নস্টিন ধূমকেতু’ বলে। ধূমকেতুদের ক্যাটালগে তার আরও একটি নাম রয়েছে। ‘সি/২০১৪-ইউএন২৭১’।
সূর্যপ্রণামে এসে চড়া দক্ষিণা!
এই সৌরমণ্ডলে অষ্টম গ্রহ নেপচুনের (প্লুটোর গ্রহের মর্যাদা সম্প্রতি ফের কেড়ে নিয়েছেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা) পর রয়েছে দু’-দু’টি বরফের সাম্রাজ্য ও মহাসাম্রাজ্য। নেপচুনের কক্ষপথ পেরনোর পরেই যে বরফের সাম্রাজ্যটি আছে তার নাম ‘কুইপার বেল্ট’। তার পরে রয়েছে বরফের একটি সুবিশাল মহাসাম্রাজ্য। তার নাম ‘ওরট্ ক্লাউড’। সূর্য থেকে পৃথিবীর যা দূরত্ব তাকে বলা হয় এক ‘অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিট’ বা ‘এইউ’। ওরট্ ক্লাউডের শুরু সূর্য থেকে কম করে ২ হাজার এইউ দূরত্ব থেকে। যা সূর্য থেকে এক লক্ষ এইউ দূরত্ব পর্যন্ত বিস্তৃত। বরফের এই মহাসাম্রাজ্য আদতে বরফের একটি মহাদৈত্যাকার গোলক।
মহাদৈত্যের প্রথম হদিশ মেলার সময়। উপরে উজ্জ্বল গোলকটিই সেই মহাদৈত্য। ছবি- নাসার সৌজন্যে।
বরফের এই দু’টি সাম্রাজ্য ও মহাসাম্রাজ্য থেকেই নির্দিষ্ট সময় অন্তর বেরিয়ে আসে বরফের বিশাল বিশাল খণ্ড। সেগুলি সূর্যের দিকে যতই এগোতে থাকে ততই তাদের বরফ সূর্যের তাপে গলতে থাকে। তার পর সূর্যের জোরালো অভিকর্ষের টানে তাদের মাথা (‘কোমা’) ও লেজ (‘টেল’) তৈরি হয়। তখনই সে হয়ে পড়ে মাথা আর লেজওয়ালা ধূমকেতু। সময় আরও গড়ালে যত বার সেই ধূমকেতু সূর্যপ্রণাম করতে (সূর্যকে প্রদক্ষিণ) আসে তত বারই তাকে চড়া দক্ষিণা দিতে হয় সূর্যপ্রণামের জন্য। তার বরফ গলে লেজ আরও লম্বা হতে থাকে। এই ভাবে বার বার সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতে করতে কোনও কোনও ধূমকেতুর সবটুকু বরফ শেষ হয়ে গেলে তা প্রকাণ্ড গ্রহাণু (‘অ্যাস্টারয়েড’) হয়ে যায়। হয়ে যায় আপাদমস্তক পাথরখণ্ড।
৩০ লক্ষ বছর পর ফের সূর্যপ্রণামে আসা
গবেষকরা জানিয়েছেন, বার্নাদিনেলি-বার্নস্টিন ধূমকেতুটি ৩০ লক্ষ বছর পর ফের ঢুকছে সৌরমণ্ডলে। ওরট্ ক্লাউড থেকে ছুটে এসে। সূর্যপ্রণামের উদ্দেশে। এ বার সেটি আসবে এমন দূরত্বে, গত ৩০ লক্ষ বছরের মধ্যে এতটা কাছে আর আসেনি ধূমকেতুটি। সেটি থাকবে নেপচুনের কক্ষপথ থেকে কিছুটা দূরে। সূর্য থেকে ১৮ এইউ দূরত্বে।
গবেষকরা এও জানিয়েছেন, সূর্য থেকে যখন ৪০ হাজার ৪০০ এইউ দূরত্বে ছিল এই মহাদৈত্য, তখনই সে ঢুকতে শুরু করে সৌরমণ্ডলে। কিন্তু অতটা দূরত্বে তার হদিশ পাননি জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। তার প্রথম হদিশ মেলে ২০১৪ সালে। তখন সূর্য থেকে তার দূরত্ব ছিল ২৯ এইউ। তবে সেটি কী ধরনের মহাজাগতিক বস্তু, তা তখন থেকে বুঝে ওঠাই সম্ভব হচ্ছিল না বিজ্ঞানীদের। তখন তাঁরা ভেবেছিলেন এটি হয়তো প্লুটোর মতোই কোনও বামন গ্রহ, যেহেতু আকারে এত সুবিশাল।
সৌরমণ্ডলের জন্ম-কথা লেখা আছে এই মহাদৈত্যের শরীরেই
কলকাতা থেকে শান্তিনিকেতনের দূরত্ব যতটা তারও সওয়া দু’গুণ দূরত্ব হলে যা হয়, সেটাই এই মহাদৈত্যাকার ধূমকেতুর ব্যাস। ১৫৫ কিলোমিটার বা ৯৬ মাইল। গত ৩০ লক্ষ বছরের মধ্যে এই মহাদৈত্যটি সূর্যের সবচেয়ে কাছে আসবে ২০৩১ সালে। সেই সময় সূর্য থেকে তার দূরত্ব থাকবে প্রায় ১১ এইউ। যার অর্থ, নেপচুনের কক্ষপথ থেকে কিছুটা দূরে। ফলে, এখন থেকে ২০৩১ সাল পর্যন্ত কখনওই খালি চোখে দেখা যাবে না এই মহাদৈত্যকে।
তবে টেলিস্কোপে তাকে এত ভাল ভাবে দেখার সুযোগ আর পাননি জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। তাঁদের উৎসাহের কারণ, এই ধূমকেতুগুলির বুকেই যে লেখা থাকে সৌরমণ্ডলের জন্ম-রহস্য। কথা ও কাহিনি। কী ভাবে কোন কোন রাসায়নিক মৌল দিয়ে তৈরি হয়েছিল এই সৌরমণ্ডল।
যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে একটুও হারিয়ে যায়নি। বরফের বুকেই থেকে গিয়েছে মৃত্যুঞ্জয়ী হয়ে!