ইনসেটে, অধ্যাপক সোমনাথ দত্ত।
যে পাড়ায় কোনও না কোনও ঘটনার জেরে প্রায়ই পুলিশ ঢোকে, টহল দেয়, সেই পাড়ার সৌভাগ্য একটাই— ডাকাত পড়ে না সেখানে। চুরি করতে ঢোকে না চোরও। আর যে পাড়া শান্ত স্বাভাবিক, চলে নিয়মবাঁধা পথে, সেখানেই চোর-ডাকাতের উপদ্রব বেশি। মানবশরীরে সংক্রমণ ও দ্রুত বংশবৃদ্ধির জন্য সার্স-কোভ-২ ভাইরাসও খোঁজে ‘শান্ত স্বাভাবিক পাড়া’। যেখানে রক্ত বয়ে চলে না-অম্লত্ব না-ক্ষারত্বের দিকে ঝুঁকে। একেবারে ‘শ্রীনিরপেক্ষ’ হয়ে। আমাদের ধমনীতে রক্তের এই স্বাভাবিক ছন্দই করোনাভাইরাসের সবচেয়ে বেশি পছন্দের। আর আমাদের রক্তের সেই চেনা ছন্দেই আমরা হই কুপোকাত!
শুধু তা-ই নয়; যাবতীয় আবর্জনা ফেলতে পাড়ার এককোণে থাকা ময়লা ফেলার জায়গাটায় সচরাচর কারও নজর পড়ে না। তাই রাতের অপেক্ষায় লুকিয়ে থাকার জন্য পাড়ার ময়লা ফেলার জায়গাটিকেই বেছে নেয় চোর। সার্স-কোভ-২ ভাইরাসও তেমনটাই করে। মানব দেহকোষে শরীরের যাবতীয় বর্জ্য নষ্ট করার জন্য যে দুটি ‘অ্যাসিড চেম্বার’ বা বর্জ্য নষ্ট করার প্রকোষ্ঠ (‘ওয়েস্টেজ চেম্বার’) রয়েছে, কোষে ঢুকে দ্রুত বংশবৃদ্ধি ঘটানোর জন্য তার একটিকেই বেছে নেয় করোনাভাইরাস।
কোষের ভিতরের সেই প্রকোষ্ঠের নাম ‘এন্ডোজোম’। ওই প্রকোষ্ঠে ঢুকেই ভাইরাসটি পেয়ে যায় একেবারে আদর্শ পরিবেশ! নিজেদের কোষপ্রাচীর ভেঙে ফেলে। ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে ভাইরাসের দেহের আরএনএ। তার পর মানব দেহকোষের কয়েকটি প্রোটিনই ভাইরাসের আরএনএ-র দ্রুত প্রতিলিপি তৈরিতে (‘রেপ্লিকেশন’) সহায়ক হয়। শুরু হয় ভাইরাসের দ্রুত বংশবৃদ্ধি। তাতে ভাইরাসের ‘শ্রীবৃদ্ধি’ ঘটে। আর মানুষের কপাল পোড়ে।
বিষয়টা কী ভাবে ধরা পড়ল?
অণুবীক্ষণ যন্ত্র ব্যবহারের সর্বাধুনিক পদ্ধতি ‘ক্রায়ো ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপি’-র মাধ্যমে এই ঘটনা চাক্ষুষ করেছেন তিন বাঙালি বিজ্ঞানী ও গবেষক। ভারতে এই প্রথম। তিন জনের অন্যতম সোমনাথ দত্ত। তিনি দেশের দ্বিজোত্তম বিজ্ঞান গবেষণা প্রতিষ্ঠান বেঙ্গালুরুর ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স (আইআইএসসি)’-এর মলিকিউলার বায়োফিজিক্স বিভাগের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর। বাকি দু’জন তাঁর গবেষক ছাত্রী ঈষিকা প্রামাণিক এবং নয়নিকা সেনগুপ্ত। তাঁদের গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান গবেষণা পত্রিকা ‘স্ট্রাকচার: সেল প্রেস’-এ।
ওষুধ আবিষ্কারের দরজা খুলল
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই গবেষণা আগামী দিনে সার্স-কোভ-২ ভাইরাসের সংক্রমণ রোখার ওষুধ আবিষ্কারের পথটা খুলে দিল। এমন ওষুধ যা মানব দেহকোষে ভাইরাসের ঢুকে পড়ার পথটাকেই বন্ধ করে দিতে পারে। এই গবেষণা এ-ও বোঝাল, কেন টিকা নেওয়ার পরেও করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঘটতে দেখা যাচ্ছে? কেন টিকা নেওয়ার পরেও মানবশরীরে তৈরি হওয়া অ্যান্টিবডিগুলিকে ধোঁকা দিতে পারছে করোনাভাইরাসের কয়েকটি প্রজাতি (‘স্ট্রেন’) বা রূপ (‘ভেরিয়্যান্ট’)?
শান্ত, স্বাভাবিক পাড়াই যেমন চোর, ডাকাতদের বেশি পছন্দের, ঠিক তেমনই আমাদের ধমনীতে একেবারে ‘শ্রীনিরপেক্ষ’ হয়ে রক্তের বয়ে চলাটা যে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঘটানোর জন্য খুবই পছন্দের সেটা বুঝলেন কী ভাবে গবেষকরা?
গবেষণাপত্র (বাঁ দিকে) ও তিন গবেষক। অধ্যাপক সোমনাথ দত্ত (উপরে), ইশিকা প্রামাণিক (নীচে বাঁ দিকে) এবং নয়নিকা সেনগুপ্ত (নীচে ডান দিকে)। -নিজস্ব চিত্র।
পিএইচ কী জিনিস? মানবধমনীতে রক্তের স্বাভাবিক ছন্দটা কী?
এটা বুঝতে গেলে ধমনীতে প্রবাহিত রক্তের একটি বিশেষ ধর্মকে বুঝতে হবে। অম্লত্ব আর ক্ষারত্ব মাপার জন্য আমাদের দেহে প্রবাহিত রক্ত-সহ বিভিন্ন তরল (‘ফ্লুইড’) পদার্থের একটা দাঁড়িপাল্লা আছে। যার মাত্রা ০ থেকে শুরু হয়ে ১৪ পর্যন্ত বিস্তৃত। ধমনীতে প্রবাহিত রক্ত সুস্থ, স্বাভাবিক অবস্থায় এই দাঁড়িপাল্লার কাঁটায় যদিও সামান্য একটু ঝুঁকে থাকে ক্ষারত্বের দিকেই। তার মান থাকে ৭.৩৫ থেকে ৭.৪৫-এর মধ্যে। গড়ে ৭.৪। এই মান ৭-এর থেকে কমে ০-র দিকে এগোতে থাকলে রক্ত উত্তরোত্তর অম্লধর্মী হয়ে পড়ে। যাকে বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলা হয়, ‘অ্যাসিডোসিস’। আর এই মান ৭-এর থেকে বেড়ে ১৪-র দিকে এগোতে থাকলে রক্ত ক্ষারধর্মী হয়ে পড়ে। বিজ্ঞানের পরিভাষায় যাকে বলা হয়, ‘অ্যালকালিসিস’। এই দাঁড়িপাল্লাটাকেই চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরিভাষায় বলা হয়, ‘পিএইচ (পোটেনসিয়াল হাইড্রোজেন) ফ্যাক্টর’। ফুসফুস, কিডনি ও শ্বাসপ্রশ্বাসের বিভিন্ন রোগ এবং বিপাকক্রিয়ার অস্বাভাবিকতাই রক্তের পিএইচ-এর এই হ্রাস-বৃদ্ধির কারণ। আমাদের ‘জীবন’ জল ভেঙে দু’ধরনের আয়ন বা আধানযুক্ত কণা তৈরি করে। একটি হাইড্রোজেন আয়ন। ধনাত্মক আধানের। অন্যটি হাইড্রক্সিল আয়ন। ঋণাত্মক আধানের। ধমনীতে প্রবাহিত রক্তে হাইড্রোজেন আয়নের পরিমাণ বেড়ে গেলে রক্ত অম্লধর্মী হয়ে পড়ে। আর হাইড্রক্সিল আয়নের পরিমাণ বেড়ে গেলে রক্ত হয়ে পড়ে ক্ষারধর্মী।
কী কী দেখেছেন গবেষকরা?
গবেষকরা দেখেছেন, স্বাভাবিক অবস্থায় ধমনীতে প্রবাহিত রক্তের পিএইচ-এর মাত্রা যখন গড়ে ৭.৪ থাকে, তখনই তা করোনাভাইরাসের কাছে প্রিয় পরিবেশ হয়ে ওঠে সংক্রমণ ঘটানোর জন্য। এই পরিবেশ পেলেই ভাইরাসের বাইরের দিকে থাকা শুঁড়ের মতো স্পাইক প্রোটিনের অগ্রভাগটি (যার একাংশকে বলা হয় ‘রিসেপ্টর বাইন্ডিং ডোমেন’ বা ‘আরবিডি’) আরও বেশি উন্মুক্ত হয়ে পড়ে। তার ফলে তাকে আমন্ত্রণ জানানোর সুযোগ বেড়ে যায় মানবদেহের ফুসফুস, কিডনি ও হৃদযন্ত্রের কোষগুলির একেবারে বাইরের স্তরে থাকা এসিই-২ রিসেপ্টর প্রোটিনগুলির। মানবদেহের এই রিসেপ্টর প্রোটিনগুলিই সার্স-কোভ-২ সহ অন্য ভাইরাসদেরও কোষে ঢোকার দরজাটা খুলতে সাহায্য করে। গবেষকরা এও দেখেছেন, মানবদেহে প্রবাহিত অন্যান্য তরলের পিএইচ-এর মাত্রা কমতে কমতে ৬.৫ হয়ে গেলে ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের অগ্রভাগের কিছু কিছু অংশ (আরবিডি) আগে যতটা উন্মুক্ত ছিল, ততটা উন্মুক্ত আর থাকছে না। সেই অংশগুলি গুটিয়ে যাচ্ছে। হয়ে পড়ছে ‘ক্লোজ্ড’। এমনটা হলে আর ভাইরাসকে আমন্ত্রণ জানাতে হাত বাড়িয়ে দেওয়ার তেমন সুযোগ পায় না মানব দেহকোষের বাইরের স্তরে থাকা এসিই-২ রিসেপ্টর প্রোটিনগুলি।
ফলে, সে ক্ষেত্রে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের ঘটনা প্রায় ঘটেই না অথবা কম ঘটে। মানবশরীরের বর্জ্য পদার্থগুলিকে নষ্ট করে ফেলার জন্য প্রতিটি কোষের ভিতরেই থাকে দু’টি ‘অ্যাসিড চেম্বার’। একটির নাম- ‘লাইসোজোম’। অন্যটি- ‘এন্ডোজোম’। দু’টিরই ভিতর ও বাইরে প্রবাহিত বিভিন্ন তরলের পিএইচ-এর মাত্রা থাকে ৬.৫ অথবা তারও নীচে। তার মানে, পিএইচ-এর দাঁড়িপাল্লার কাঁটাটি লাইসোজোম ও এন্ডোজোমের ভিতরে প্রবাহিত বিভিন্ন তরলের ক্ষেত্রে থাকে অম্লতার দিকে ঝুঁকে। পিএইচ-এর নিরিখে সেখানকার তরলগুলি তাই অম্লধর্মী।
গ্রাফিক- শৌভিক দেবনাথ।
গবেষকরা দেখেছেন, মানবকোষের ভিতরের এই দু’টি প্রকোষ্ঠের মধ্যে নিজেদের বংশবৃদ্ধির জন্য লাইসোজোমের চেয়ে এন্ডোজোমকেই বেশি পছন্দ করে সার্স-কভ-২ ভাইরাস। তার ভিতরে প্রবাহিত তরলের যে অম্নত্বকে হাতিয়ার করে কোষের বর্জ্য পদার্থগুলিকে নষ্ট করে এন্ডোজোম, সেই অম্লত্বই কোষে ঢুকে পড়া ভাইরাসটির নিজের কোষপ্রাচীর ভেঙে ফেলার সহায়ক হয়। এর পরেই ভাইরাসের আরএনএ-টি তাদের কোষের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে। শুরু হয়ে যায় মানবকোষে ভাইরাসের আরএনএ-র দ্রুত প্রতিলিপি তৈরির প্রক্রিয়া। শুরু হয় ভাইরাসের দ্রুত বংশবৃদ্ধি। এও দেখা গিয়েছে, এন্ডোজোমের ভিতরে প্রবাহিত তরলের পিএইচ-এর মাত্রা যখন ৬.৫, তখন সার্স-কভ-২ ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনগুলির ৫৪ শতাংশই আর খোলা বা উন্মুক্ত থাকে না। গুটিয়ে থাকে।
এই গবেষণার অভিনবত্ব কোথায়?
অভিনবত্ব এই যে, মানবশরীরে প্রবাহিত অন্যান্য তরলের পিএইচ-এর মাত্রা যখন ৮, ৭.৪ এবং ৬.৫ থাকে, সেই তিনটি ক্ষেত্রেই করোনাভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের অগ্রভাগের অংশগুলির চেহারা কী ভাবে বদলে যাচ্ছে, কোন কোন অংশ কী পরিমাণে উন্মুক্ত হচ্ছে বা গুটিয়ে যাচ্ছে, তা পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে দেখা হয়েছে। বোঝার চেষ্টা হয়েছে, এই অংশগুলির কোথায় কতটা উন্মুক্ত হয় বা গুটিয়ে থাকে সংক্রমণের সময়। এর ফলে, মানবকোষে ঢোকার আগে ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের অগ্রভাগের উন্মুক্ত অংশগুলির ঠিক কোন কোন জায়গাগুলিকে আমাদের দেহে তৈরি হওয়া অ্যান্টিবডিগুলি বেঁধে ফেলতে পারবে, তা বোঝা সম্ভব হবে। ফলে, টিকা নেওয়ার পরেও ভাইরাসের কয়েকটি স্ট্রেন বা ভেরিয়্যান্ট যে মানবদেহের অ্যান্টিবডিগুলিকে এখনও ধোঁকা দিতে পারছে, সেটার সম্ভাবনা কমানো যেতে পারে। খুলে যেতে পারে ওষুধ বা আরও কার্যকরী টিকা আবিষ্কারের পথটাও।
অন্যতম গবেষক বেঙ্গালুরুর ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স’-এর মলিকিউলার বায়োফিজিক্স বিভাগের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর সোমনাথ দত্ত বলছেন, “ভারতে এই প্রথম সার্স-কোভ-২ ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের অগ্রভাগের বিভিন্ন অংশের গঠনকাঠামো দেখা সম্ভব হয়েছে ক্রায়ো ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপি পদ্ধতিতে। দেখা হয়েছে ওই অংশগুলি কখন কোথায় কোথায় খুলে যায় আর কোথায়ই বা সেগুলি গুটিয়ে যায়। শুধু তা-ই নয়, এও দেখা গিয়েছে মানবশরীরে বিভিন্ন তরলের ভিন্ন ভিন্ন পিএইচ-এর ক্ষেত্রে ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের অগ্রভাগের বিভিন্ন অংশের উন্মুক্ত আর গুটিয়ে থাকা অংশগুলির রূপান্তর ঘটে কী ভাবে। এর আগে অন্যান্য গবেষণায় দেখা গিয়েছিল ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের অগ্রভাগটি হয় উন্মুক্ত থাকে বা কোথাও গুটিয়ে থাকে। অথবা একই সঙ্গে উন্মুক্ত ও গুটিয়ে থাকে। আমরাই প্রথম এদের মধ্যবর্তী পর্যায়গুলিকেও দেখাতে পেরেছি। যেমন, ঘোরার সময় পাখার ব্লেডগুলির পর পর দু’টি অবস্থানের বিভিন্ন মধ্যবর্তী পর্যায় থাকে।’’
গ্রাফিক- শৌভিক দেবনাথ।
সোমনাথ জানাচ্ছেন, এও দেখা গিয়েছে এই রূপান্তর শুধু করোনাভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের অগ্রভাগের মাঝের অংশ বা রিসেপ্টর বাইন্ডিং ডোমেন-ই নয়; সেই প্রোটিনের দুই প্রান্তিক অংশতেও একই ঘটনা ঘটছে। তার ফলে বোঝা গেল, স্পাইক প্রোটিনের এই দু’টি অংশেরই গঠনকাঠামো বদলে যায়। ফলে সংক্রমণ রুখতে স্পাইক প্রোটিনের ঠিক কোন কোন অংশকে মানবদেহে তৈরি হওয়া অ্যান্টিবডি দিয়ে বেঁধে ফেলা যাবে, সেটা বোঝার কাজটা কিছুটা সহজ হল। যা আগামী দিনে ওষুধ বা আরও কার্যকরী টিকা আবিষ্কারের পথটা খুলে দিতে পারে।
পিএইচ মাত্রার তারতম্য, ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের বিভিন্ন অংশের রূপান্তর
দুই প্রধান গবেষক সোমনাথের দুই ছাত্রী নয়নিকা ও ঈষিকা জানাচ্ছেন, মানবদেহে প্রবাহিত বিভিন্ন তরলের পিএইচ-এর মাত্রা যখন ৭.৪ থাকে, এমন ৬৮ থেকে ৭০ শতাংশ ক্ষেত্রে ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের অগ্রভাগটি বেশি করে খুলে যায়। কমে যায় তার গুটিয়ে থাকা অংশের সংখ্যা। অন্য দিকে, পিএইচ-এর মাত্রা যখন ৬.৫ হয়ে যায়, এমন মাত্র ৫০ শতাংশ ক্ষেত্রে ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের অগ্রভাগটি বেশি খুলে যায়। ফলে, এই ক্ষেত্রে ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনটিকে কাছে টেনে আনার সুযোগ কম পাবে মানবকোষের বাইরের স্তরে থাকা এসিই-২ রিসেপ্টর প্রোটিনগুলি।
এই গবেষণা কোন কোন পথ খুলে দিতে পারে?
সোমনাথের কথায়, “কেন কোনও কোনও টিকায় তৈরি হওয়া কোনও বিশেষ এক ধরনের অ্যান্টিবডি সার্স-কোভ-২ ভাইরাসের সবক’টি প্রজাতি বা রূপকে নিষ্ক্রিয় করতে পারছে না, আমাদের গবেষণা সেটা বুঝে ওঠার ক্ষেত্রে সহায়ক হয়ে উঠতে পারে। টিকা বা অন্য যে কোনও ভাবেই হোক, কেন অনেক রকমের অ্যান্টিবডি তৈরি করতে হচ্ছে ভাইরাসটির বিভিন্ন প্রজাতি বা রূপকে নিষ্ক্রিয় করতে সেটাও বোঝার জন্য সাহায্য করতে পারে আমাদের গবেষণা। হয়তো এটা বোঝাও সহজতর হবে ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনকে বেঁধে ফেলার লক্ষ্যে পৌঁছতে কেন সব টিকার কার্যকারিতা ১০০ শতাংশ হয় না। সে ক্ষেত্রে স্পাইক প্রোটিনের অগ্রভাগের বিভিন্ন অংশের গঠনগত কাঠামোর এই ধাপে ধাপে পরিবর্তন আগামী দিনে নিখুঁত ওষুধ ও আরও কার্যকরী টিকা আবিষ্কারের দরজাটাও খুলে দিতে পারে।”
দুর্গাপুরের সোমনাথের পরিক্রমা
দুর্গাপুরের গোপালমঠ এলাকার সন্তান সোমনাথ রসায়নশাস্ত্রে অনার্স নিয়ে বি এসসি পাশ করেন বর্ধমানের ত্রিবেণী দেবী ভালোটিয়া কলেজ থেকে। তার পর ২০০৪-এ কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বায়োকেমিস্ট্রি-তে এম এসসি। কলকাতার ‘ইনস্টিটিউট অব কলেরা অ্যান্ড এনটেরিক ডিজিজেস’ থেকে পিএইচ ডি-র পর আমেরিকার মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পোস্ট ডক্টরাল। দেশে ফিরে অধ্যাপনা শুরু করেন আইআইএসসি-তেই।
দুই বিশেষজ্ঞ। বেঙ্গালুরুর আইআইএসসি-র অধ্যাপক রাঘবন বরদারাজন (বাঁ দিকে) এবং খড়্গপুর আইআইটি-র অধ্যাপক অমিত ঘোষ (ডান দিকে)।
এমন কাজ ভারতে আগে হয়নি: অধ্যাপক রাঘবন বরদারাজন
বেঙ্গালুরুর ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স’-এর মলিকিউলার বায়োফিজিক্স বিভাগের অধ্যাপক রাঘবন বরদারাজন বলছেন, “আমি যতদূর জানি, তাতে বলতে পারি, রক্ত ও মানবদেহে প্রবাহিত বিভিন্ন তরলের বিভিন্ন পিএইচ মাত্রায় করোনাভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের বিভিন্ন অংশের গঠনকাঠামো ও তাদের পরিবর্তনগুলি যে ভাবে পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে দেখিয়েছেন গবেষকরা তা ভারতে এর আগে আর হয়নি। তাঁরা সর্বাধুনিক যে পদ্ধতিতে (ক্রায়ো ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপি) এটা দেখাতে পেরেছেন, এ দেশে সেটাও সর্বপ্রথম।”
বরদারাজন জানাচ্ছেন, এর আগে বেশির ভাগ গবেষণায় পিএইচ-এর স্বাভাবিক মাত্রার (বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় তরলের) চেয়ে হয় উপরে, না হলে নীচে করোনাভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের গঠনগত কাঠামো আর তার বদলগুলি পর্যবেক্ষণ করা হয়েছিল। এই গবেষণাই প্রথম দেখাল, মানবদেহে প্রবাহিত রক্তের পিএইচ-এর মাত্রা যখন স্বাভাবিক (৭.৪) থাকে, তখন ভাইরাসটির স্পাইক প্রোটিনের অগ্রভাগটি আরও বেশি খুলে যায়। গবেষণার এই ফলাফল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের অগ্রভাগটা এই ভাবে খুলে যাচ্ছে বলেই মানব দেহকোষের এসিই-২ রিসেপ্টর প্রোটিন তাকে কাছে টানার সুযোগ পাচ্ছে। মানব দেহকোষে ঢোকার দরজাটা খুলতে সাহায্য করছে সার্স-কভ-২ ভাইরাসকে। এ ছাড়াও বিভিন্ন মধ্যবর্তী পর্যায়ে স্পাইক প্রোটিনের অগ্রভাগের নানা ধরনের গঠনকাঠামো আর ধাপে ধাপে তাদের পরিবর্তনগুলিও এই গবেষণাই প্রথম দেখাতে পারল।
তবে এই গবেষণা ওষুধ বা আরও কার্যকরী টিকা আবিষ্কারের পথটা কতটা খুলে দেবে, সে ব্যাপারে তিনি এখনও নিশ্চিত নন। জানিয়েছেন সেই বরদারাজন, বিভিন্ন প্রোটিনের গঠনকাঠামো, ভাঁজ, বিশেষ এক ধরনের ইনফ্লুয়েঞ্জা এবং ‘এইচআইভি-১’ ভাইরাস সংক্রমণ রোখার টিকা ও ওষুধ বানানোর ক্ষেত্রে যাঁর উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। তাঁর কথায়, “সার্স-কোভ-২ রোখার ওষুধ এবং আরও কার্যকরী টিকা আবিষ্কারের পথ এই গবেষণায় এখনই কতটা খুলবে জানি না। তবে বিভিন্ন টিকা নেওয়ার পরেও কেন সংক্রমণের ঘটনা ঘটছে তা আরও ভাল ভাবে বুঝতে অবশ্যই সাহায্য করবে বিজ্ঞানীদের। যা আগামী দিনে ওষুধ ও আরও কার্যকরী টিকা আবিষ্কারের দরজা খুলে দিতে পারে।”
ক্রায়ো ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপির ভূমিকা যথেষ্ট: অধ্যাপক অমিত ঘোষ
এই গবেষণাটি শুধুই যে অভিনব তা নয়; তার ফলাফল সুদূরপ্রসারী হতে পারে বলে মেনে নিচ্ছেন খড়্গপুরের ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (আইআইটি)’-র স্কুল অব এনার্জি সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং-এর অধ্যাপক অমিত ঘোষ। তাঁর কথায়, “ক্রায়ো ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপি পদ্ধতির সাহায্য নেওয়ার ফলেই ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের বিভিন্ন অংশের রূপান্তরগুলি এত নিখুঁত ভাবে বোঝা সম্ভব হয়েছে গবেষকদের। ভারতে এই প্রথম এই পদ্ধতিতে স্পাইক প্রোটিনের বিভিন্ন অংশের রূপান্তরগুলি দেখা হয়েছে। এর ফলে, আগামী দিনে সার্স-কোভ-২ ভাইরাসের সংক্রমণ রোখার জন্য ওষুধ ও আরও কার্যকরী টিকা আবিষ্কারের কাজটা কিছুটা সহজ হল বলেই মনে হচ্ছে।”
গবেষণার পরবর্তী ধাপগুলি কী কী?
দুই মুখ্য গবেষক ঈষিকা ও নয়নিকা জানাচ্ছেন, রক্তে পিএইচ-এর মাত্রা ৭.৪ থাকলে (যাকে স্বাভাবিক অবস্থা বা ‘ফিজিওলজিক্যাল পিএইচ’ বলা হয়), সার্স-কভ-২ ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের অগ্রভাগের উন্মুক্ত ও গুটিয়ে থাকা অংশগুলিকে কী ভাবে কতটা বেঁধে ফেলে বা আদৌ বেঁধে ফেলতে পারে কি না বিভিন্ন ওষুধের অণু, অ্যান্টিবডি বা নানা ধরনের পেপটাইড অণু, এ বার সেই বিষয়গুলি খতিয়ে দেখা হবে গবেষণায়। যা আগামী দিনে ওষুধ বা আরও কার্যকরী টিকা আবিষ্কারের পথটা দেখাতে পারে। সেই কাজ সময়সাপেক্ষ। তবে তার ভিতটা কিন্তু গড়ে দিলেন সোমনাথ আর তাঁর দুই গবেষক ছাত্রীই।
ছবি ও গ্রাফিক তথ্য সৌজন্যে: অধ্যাপক সোমনাথ দত্ত।
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।