science news

রক্তের ‘এ’ গ্রুপে কোভিড বেশি ভয়াবহ? ‘ও’ গ্রুপে কম? প্রশ্ন তুলল গবেষণা

সাম্প্রতিক একটি গবেষণা এই প্রশ্নগুলি তুলে দিল। গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক চিকিৎসা-জার্নাল ‘নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন’-এ।

Advertisement

সুজয় চক্রবর্তী

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৯ অগস্ট ২০২০ ০৯:০০
Share:

আমাদের শরীরে কোভিডের দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার ক্ষেত্রে কি সহায়ক হয়ে উঠছে রক্তের বিশেষ কোনও একটি গ্রুপ? সেই গ্রুপের রক্ত যাঁর, কোভিড কি তাঁর শরীরেই আরও মারাত্মক হয়ে উঠছে? অন্য গ্রুপগুলির রক্ত যাঁদের, সেই রোগীদের শরীরে কি কোভিড ততটা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারছে না? পাচ্ছে কিছুটা প্রতিরোধ?

Advertisement

সাম্প্রতিক একটি গবেষণা এই প্রশ্নগুলি তুলে দিল। গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক চিকিৎসা-জার্নাল ‘নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন’-এ।

গবেষণা চালানো হয়েছে ইউরোপের দু’টি দেশ স্পেন ও ইটালিতে। করোনা সংক্রমণের হার ও মৃতের সংখ্যায় যে দু’টি দেশই রয়েছে সামনের সারিতে। গবেষণাটি নির্দিষ্ট জিন ও ক্রোমোজোমের সঙ্গে রোগীদের দেহে করোনা সংক্রমণ ভয়াবহ হয়ে ওঠার একটি সম্পর্ক (‘কোরিলেশন্স’ বা ‘অ্যাসোসিয়েশন’) খুঁজে পেয়েছে বলে দাবি গবেষকদের। অভিনব পর্যবেক্ষণটি নিয়ে বিজ্ঞানী মহলে শোরগোলও পড়ে গিয়েছে।

Advertisement

এ গ্রুপ ‘সহায়ক’? ও গ্রুপ ‘রক্ষাকর্তা’?

গবেষকদের দাবি, তাঁরা দেখেছেন, ‘এ’ গ্রুপের (পজিটিভ ও নেগেটিভ) রক্তবাহকদের শরীরে কোভিড-১৯ ভাইরাস বেশি ভয়াবহ হয়ে উঠছে। অন্যান্য গ্রুপের রক্তবাহকদের থেকে অন্তত ৪৫ শতাংশ বেশি। কিন্তু ‘ও’ গ্রুপের (পজিটিভ ও নেগেটিভ) রক্তবাহকদের শরীরে কোভিড-১৯ ভাইরাস ততটা ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারছে না। অন্যান্য গ্রুপের মতোই ও গ্রুপের অন্তত ৬৫ শতাংশ রক্তবাহকের দেহে করোনা সংক্রমণ ঘটছে।

তাঁদের এও দাবি, ‘এবি’ এবং ‘বি’ গ্রুপের (পজিটিভ ও নেগেটিভ) রক্তবাহকদের শরীরেও কোভিড-১৯ ভাইরাস এ গ্রুপের রক্তবাহক রোগীদের মতো ততটা ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারছে না। তবে আমাদের শরীরে কোভিডের দ্রুত ভয়াবহ ওঠা রোখার ব্যাপারে ও গ্রুপের মতো ততটা কার্যকরী নয় এবি এবং বি গ্রুপের রক্ত। এবি গ্রুপের ক্ষমতা ও গ্রুপের চেয়ে কম। বি গ্রুপের ক্ষমতা এবি গ্রুপের চেয়েও কম।

স্পেন ও ইটালির করোনায় চরম সঙ্কটাপন্ন আট লক্ষেরও বেশি মানুষের জিনোম পরীক্ষা করেছেন বলে জানিয়েছেন গবেষকরা। তাঁদের সঙ্গে তুলনা করেছেন আরও বহু মানুষকে, যাঁরা করোনায় আক্রান্ত হননি।

একটা হাইপোথিসিস, কোনও থিয়োরি/মডেল নয়

তবে ম্যাসাচুসেট্‌স জেনারেল হসপিটালের অধ্যাপক চিকিৎসক অনহিতা দুয়া ‘আনন্দবাজার ডিজিটাল’-কে বলেছেন, ‘‘এটা নিশ্চিত ভাবে বলা যাবে না, করোনা সংক্রমণ আমাদের দেহে ভয়াবহ হয়ে ওঠার ক্ষ‌েত্রে শুধু রক্তের নির্দিষ্ট কোনও গ্রুপেরই ভূমিকা রয়েছে। একটা ‘কোরিলেশন’ বা ‘অ্যাসোসিয়েশন’ (পারস্পরিক সম্পর্ক) খুঁজে পাওয়া গিয়েছে মাত্র। শুধুমাত্র জিন-স্তরে। আরও অনেক কারণ থাকতে পারে। তবে এটাও অন্যতম কারণ হয়ে উঠতে পারে। তাই বলব, এ গ্রুপের রক্তবাহকদের অযথা আতঙ্কিত হয়ে ওঠার কারণ নেই। আবার এটাও বলব না, ও গ্রুপের রক্তবাহকরা খুব স্বস্তিতে থাকতে পারেন। এটা একটা হাইপোথিসিস। কোনও থিয়োরি নয়। কোনও মডেলও নয়।’’

একই ধরনের গবেষণা চালানো হয়েছিল সার্স ভাইরাসের হানাদারির সময়। ২০০২-এর নভেম্বর থেকে ২০০৩-এর জুলাই পর্যন্ত যা হংকংয়ে ৮ হাজার ৯৮ জনকে সংক্রমিত করেছিল। সেখানেও দেখা গিয়েছিল, অন্যান্য ব্লাড গ্রুপের চেয়ে ও গ্রুপের রক্তবাহকরাই ওই ভাইরাসের সঙ্গে যুঝতে পেরেছিলেন বেশি।

আরও পড়ুন- পানীয় জলে বিষ মেশায় এই দুই ব্যাকটেরিয়া, হদিশ মিলল এই প্রথম

আরও পড়ুন- বিষে বিষে বিষক্ষয়! ভয়ঙ্কর মানসিক রোগ সারানোর পথ দ‌েখালেন তিন বাঙালি

এর বহু আগেই অবশ্য আন্তর্জাতিক স্তরে স্বীকৃত বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গিয়েছে, ম্যালেরিয়া, হেপাটাইটিস, র মতো বহু রোগ নির্দিষ্ট রক্তের গ্রুপের রোগীদের ক্ষেত্রেই বেশি সংক্রামক বা ভয়াবহ হয়ে ওঠে। ক্যানসারের মতো রোগের ভয়াবহ ওঠার ক্ষেত্রেও বড় ভূমিকা থাকে রক্তের গ্রুপের।

রক্তের গ্রুপ কী ও কেন?

মানবশরীরে রক্তের গ্রুপ মূলত হয় চার ধরনের। ‘এ’, ‘বি’, ‘এবি’ এবং ‘ও’। প্রতিটি গ্রুপই আবার দু’ধরনের হতে পারে। পজিটিভ ও নেগেটিভ। ফলে, সঠিক ভাবে বলতে হলে, মানবদেহে মোট আট ধরনের রক্তের গ্রুপ হয়। যেমন, এ পজিটিভ, এ নেগেটিভ, ও পজিটিভ, ও নেগেটিভ ইত্যাদি। এই সবক’টি মিলিয়ে বলা হয়, ‘এবিও ব্লাড গ্রুপ’। এবিও ব্লাড গ্রুপকে নিয়ন্ত্রণ করে মূলত যে জিন, সেটি থাকে আমাদের নবম ক্রোমোজোমে। নদী যেমন গতিধারায় বিভিন্ন শাখা নদীতে ভেঙে যায়, তেমনই রক্তের প্রতিটি গ্রুপের জন্যই থাকে নির্দিষ্ট এক-একটি জিন। এ গ্রুপের জন্য এ জিন, বি গ্রুপের জন্য বি জিন, ইত্যাদি।

রক্তের এই চারটি গ্রুপ পজিটিভ হবে নাকি নেগেটিভ, তা নির্ভর করে আমাদের শরীরে আরও এক ধরনের রক্ত সংবহনতন্ত্রের উপর। তার নাম ‘রেশাস (আরএইচ)’। এই গ্রুপেরও অনেক সাব-গ্রুপ রয়েছে। রক্তের এই রেশাস গ্রুপটিকে নিয়ন্ত্রণ করে যে জিন, সেটি থাকে আমাদের প্রথম ক্রোমোজোমে। এই গ্রুপেরও অনেক প্রকারভেদ রয়েছে। তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ- আরএইচডি।

আরও পড়ুন- সূর্যের করোনায় এই প্রথম হদিশ ‘ক্যাম্পফায়ার’-এর

আরও পড়ুন- নিজের ছোড়া ‘বাণ’ থেকে আমাদের বাঁচায় সূর্যই! দেখালেন মেদিনীপুরের সঞ্চিতা

কারও শরীরে আরএইচডি পজিটিভ গ্রুপের রক্ত থাকলে তখন তাঁর রক্তের গ্রুপ হয় এ পজিটিভ বা বি পজিটিভ হবে। না হলে হবে এবি পজিটিভ অথবা ও পজিটিভ। আর কারও শরীরে আরএইচডি নেগেটিভ গ্রুপের রক্ত থাকলে তখন তাঁর রক্তের গ্রুপ হয় এ নেগেটিভ বা বি নেগেটিভ হবে। না হলে হবে এবি নেগেটিভ অথবা ও নেগেটিভ। বেশির ভাগ মানুষেরই রক্তের গ্রুপ হয় পজিটিভ। তাই নেগেটিভ গ্রুপের রক্ত পেতে এত ঘাম ঝরাতে হয় আমাদের।

রক্তের গ্রুপ আমরা পেয়ে থাকি মা, বাবার কাছ থেকে। এর উপর আমাদের বা পরিবেশের কোনও হাত নেই। তবে আমাদের রক্তের গ্রুপ কেন বিভিন্ন হয়, তারা আমাদের শরীরের গঠনে নির্দিষ্ট কী কী ভূমিকা নেয়, তা এখনও নিশ্চিত ভাবে জেনে-বুঝে ওঠা সম্ভব হয়নি বিজ্ঞানীদের পক্ষে। বিভিন্ন ভাইরাস ও রোগের হানাদারির ক্ষেত্রে তারা কে কতটা সহায়ক বা প্রতিরোধী, সে সম্পর্কেও খুব সামান্যই জানা সম্ভব হয়েছে।

ব্লান্‌ডেল পাঁচ রোগীকে কেন বাঁচাতে পারেননি?

রক্তের বিভিন্ন গ্রুপ আবিষ্কার করেছিলেন অস্ট্রিয়ায় ইমিউনোলজিস্ট কার্ল ল্যান্ডস্টিনার। পরে তিনি নোবেল পুরস্কার পান। তার আগে উনবিংশ শতাব্দীর একেবারে শুরুতে লন্ডনের এক নামজাদা চিকিৎসক জেমস ব্লান্‌ডেল রোগীদের বাঁচানোর জন্য অন্য ১০ জনের রক্ত ১০ জন রোগীকে দিয়েছিলেন। যা ‘ব্লাড ট্রান্সফিউশন’ নামে এখন খুবই প্রচলিত চিকিৎসা পদ্ধতি। কিন্তু ব্লান্‌ডেল যে ১০ জনের রক্ত বদলেছিলেন, তাঁদের মধ্যে মাত্র পাঁচ জনকে বাঁচাতে পেরেছিলেন। বাকি পাঁচ জনকে বাঁচাতে পারেননি। ব্লান্‌ডেল তখনও জানতেন না সকলের রক্ত নিতে পারে না মানুষ। এও জানতেন না মানুষ শুধুই কয়েকটি বিশেষ গ্রুপের রক্ত নিতে পারে।

কলকাতার ব্লাড ট্রান্সফিউশন বিশেষজ্ঞ ঋতম চক্রবর্তী জানাচ্ছেন, এবিও এবং আরএইচ মিলিয়ে রক্তের যে আট রকম গ্রুপ আছে, তাদের প্রত্যেকেরই আছে নির্দিষ্ট আলাদা আলাদা অ্যান্টিবডি ও আলাদা আলাদা অ্যান্টিজেন। এই অ্যান্টিবডিগুলি আমাদের দেহের স্বাভাবিক প্রতিরোধী ব্যবস্থার অংশবিশেষ। আর অ্যান্টিজেনগুলি তৈরি হয় শর্করা আর প্রোটিন দিয়ে। যেগুলি লোহিত রক্তকণিকার উপরে আস্তরণ তৈরি করে।

বিভিন্ন গ্রুপের রক্তের অ্যান্টিবডিগুলি বাইরে থেকে শরীরে ঢোকা (‘ফরেন’) অ্যান্টিজেনগুলিকে চিনে ফেলতে পারে। আর সঙ্গে সঙ্গে তারা দেহের প্রতিরোধী ব্যবস্থার কাছে বার্তা পাঠায় সেগুলিকে ধ্বংস করে ফেলার জন্য। সে জন্যই যে কারও থেকে নিয়ে যে কোনও গ্রুপের রক্ত অন্য কারও শরীরে ঢোকালে তা রোগীর পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে ওঠে।

ধরুন, আমার শরীরে রয়েছে এ পজিটিভ গ্রুপের রক্ত। ডাক্তার যদি আমাকে বি অথবা এবি গ্রুপের রক্ত দেন, তা হলে আমি মারা যাব। কারণ, আমার দেহের এ পজিটিভ গ্রুপের রক্তে স্বাভাবিক ভাবেই তৈরি হয়ে গিয়েছে বি অ্যান্টিবডি। সেই অ্যান্টিবডি অন্য কারও শরীর থেকে নেওয়া বি গ্রুপের রক্তের অ্যান্টিজেনকে দেখা মাত্রই চিনে ফেলবে। আর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দেহের প্রতিরোধী ব্যবস্থাকে বলবে সেগুলিকে মেরে ফেলতে। ফলে, আমার রক্ত জমাট (‘ক্লটিং’) বেঁধে যাবে। তার ফলে ব্যাঘাত ঘটবে রক্ত সংবহনে। নাক, মুখ দিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসবে। শ্বাসকষ্ট বাড়তে থাকবে। পরিণতি হবে মৃত্যু।

একই ভাবে আমার শরীরে যদি বি পজিটিভ গ্রুপের রক্ত থাকে, তা হলে স্বাভাবিক ভাবেই তৈরি হয়ে যেত এ অ্যান্টিবডি। ফলে, তখনও আমাকে এ অথবা এবি গ্রুপ দেওয়া হলে আমার রক্ত জমাট বেঁধে যেত। তার ফলে ব্যাঘাত ঘটত রক্ত সংবহনে। নাক, মুখ দিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসত। শ্বাসকষ্ট বাড়তে বাড়তে পরিণতি হত মৃত্যু। ফলে, প্রথম ক্ষেত্রে যেমন আমাকে এ অথবা ও গ্রুপের রক্ত দেওয়া হলে বেঁচে যাব, তেমনই দ্বিতীয় ক্ষেত্রে বেঁচে যাব আমাকে বি অথবা ও গ্রুপের রক্ত দেওয়া হলে।

ব্লান্‌ডেল এটা জানতেন না বলেই ১০ জন রোগীর মধ্যে মাত্র পাঁচ জনকে বাঁচাতে পেরেছিলেন।

এবিও গ্রুপের নিয়ন্ত্রক জিনের ভূমিকা পাচনতন্ত্র, শ্বাসতন্ত্রেও

কলকাতার মেডিক্যাল কলেজের ব্লাড ট্রান্সফিউশন বিভাগের অধ্যাপক প্রসূন ভট্টাচার্য জানাচ্ছেন, আমাদের দেহে রক্তের এবিও গ্রুপকে নিয়ন্ত্রণ করে যে বিশেষ জিনটি, তার যে শুধুই রক্তের উপরেই নিয়ন্ত্রণ রয়েছে, তা কিন্তু নয়। আমাদের দেহে নানা ধরনের কলা ও অঙ্গেও সক্রিয় এই জিনটি। এই জিনটি খুবই কার্যকরী আমাদের পাচনতন্ত্র ও শ্বাসতন্ত্রে। ফলে, রক্তের বিভিন্ন গ্রুপের বাহকরা যখন কোনও ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়ার হানাদারি বা কোনও রোগের বিরুদ্ধে ল়ড়াই করেন, তখন এই জিনটির জন্য তাদের সেই লড়াই আর তার ফলাফল নানা ধরনের হতে পারে। যেমন দেখা গিয়েছে, বি গ্রুপের রক্তবাহকদের ক্যানসারের আশঙ্কা কিছুটা কম হয়। আবার ও গ্রুপের রক্তবাহকদের শরীরে ম্যালেরিয়া ততটা ভয়াবহ হয়ে ওঠে না। ম্যালেরিয়ায় তাঁদের মৃত্যুর আশঙ্কাও কম। আবার ডায়ারিয়া হয় যে ভাইরাসের জন্য সেই নরোভাইরাস সংক্রমণ বেশি হয় ও গ্রুপের রক্তবাহকদের।

দু’টি হাইপোথিসিস

ম্যাসাচুসেট্‌স জেনারেল হসপিটালের অধ্যাপক অনহিতা দুয়া ‘আনন্দবাজার ডিজিটাল’-কে জানিয়েছেন, করোনা সংক্রমণ কেন বেশি ভয়াবহ হয়ে উঠতে দেখা গিয়েছে এ গ্রুপের রক্তবাহকদের ক্ষেত্রে, তা ব্যাখ্যা করার চেষ্টায় দু’টি হাইপোথিসিস দেওয়া হয়েছে।

বিশিষ্ট হেমাটোলজিস্ট হরি মেনন জানাচ্ছেন, একটি হাইপোথিসিস বলছে, এ গ্রুপের রক্তে জমাট বাঁধার প্রবণতা স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা বেশি। আর সেটা ও গ্রুপের রক্তে প্রায় স্বাভাবিকই। দেখা গিয়েছে, করোনা সংক্রমণ যে রোগীদের দেহে ভয়াবহ হয়ে ওঠে, তাঁদের রক্ত জমাট বেঁধে যায়। কেন এ গ্রুপের রক্তবাহকদের দেহে সংক্রমণ ভয়াবহ হয়ে উঠতে দেখেছেন গবেষকরা, এটা তার একটা সম্ভাব্য কারণ হতে পারে।

দ্বিতীয় হাইপোথিসিসটি হল, এই ভাইরাসটি সংক্রমিতের রক্তের (এ গ্রুপের) অ্যান্টিজেন বহন করেই আর এক জনকে সংক্রমিত করার চেষ্টা করছে। সে ক্ষেত্রে, দ্বিতীয় জন যদি ও গ্রুপের রক্তবাহক হন, তা হলে তাঁর রক্তের অ্যান্টিবডি সঙ্গে সঙ্গেই স‌েই বিদেশি অ্যান্টিজেনকে চিনতে পারছে। ফলে, ভাইরাসটি সেই দ্বিতীয় জনের দেহে ততটা ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারছে না।

গবেষণা উচ্চ মানের, প্রয়োজন র‌্যান্ডমাইজেশনের

মেডিক্যাল কলেজের ব্লাড ট্রান্সফিউশন বিভাগের অধ্যাপক চিকিৎসক প্রসূন ভট্টাচার্য বলছেন, ‘‘তার মানে এও নয়, ও গ্রুপের কোনও রক্তবাহক ও গ্রুপেরই আর এক রক্তবাহককে কখনওই সংক্রমিত করবেন না বা করতে পারবেন না। কারণ, রক্তের কোনও গ্রুপের অ্যান্টিবডির ক্ষমতা এক জন থেকে অন্য জনে বদলে যায়। অ্যাফ্রো-আমেরিকানদের মধ্যে ও গ্রুপের রক্তবাহকের সংখ্যা বেশি দেখা যায়। আমেরিকায় তাঁরাই অন্য জাতিগোষ্ঠীর মানুষের চেয়ে করোনায় সংক্রমিত হয়েছেন বেশি। তবে এটি খুবই উচ্চ মানের গবেষণা। যা করা হয়েছে একেবারে জেনেটিক স্তরে। এ বার এই গবেষণার আরও র‌্যান্ডমাইজেশন দরকার। আরও বেশি সংখ্যক মানুযের উপর পরীক্ষা চালাতে হবে। আরও অনেক দেশের মানুষের উপর পরীক্ষা চালাতে হবে। আরও বেশি সংখ্যায় বিভিন্ন জন বা জাতিগোষ্ঠীর (‘পপুলেশান স্টাডি’) উপর পরীক্ষা চালাতে হবে। গবেষকরা একটা পর্যবেক্ষণের কথা বলেছেন মাত্র। যা অভিনব।’’

সিদ্ধান্ত নয়, নানা পর্যবেক্ষণের একটি মাত্র

একই কথা বলেছেন কলকাতার আর এক বিশিষ্ট হেমাটোলজিস্ট শর্মিলা চন্দ্র। তাঁর কথায়, ‘‘কোনও সন্দেহ নেই, এটা খুবই উচ্চমানের গবেষণা। প্রকাশিত হয়েছে নিউ ইংল্যান্ড জার্নালের মতো একটি পিয়ার রিভিউড চিকিৎসা জার্নালে। তবে গবেষকরা জেনেটিক স্তরে সামান্য কিছু কোরিলেশন বা অ্যসোসিয়েশন পর্যবেক্ষণ করেছেন। কোভিড সংক্রমণের পর থেকে গত ৬/৭ মাসে এমন আরও অনেক পর্যবেক্ষণ হয়েছে। যেমন, দেখা গিয়েছে, কো-মরবিডিটির প্রাবল্যে কোনও রোগীর দেহে বেশ ভয়াবহ হয়ে উঠছে কোভিড। বেশি ভয়াবহ হয়ে উঠছে প্রবীণদের ক্ষেত্রে। আমার কাছে এই পর্যবেক্ষণগুলি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এমন নানা ধরনের পর্যবেক্ষণ এখন প্রতিনিয়তই করবেন বিজ্ঞানীরা। কোনওটিই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নয়। যার ভিত্তিতে চিকিৎসা চালাবেন চিকিৎসকেরা। তা ছাড়া কোনও চিকিৎসকই কোনও রোগীর রক্তের গ্রুপ দেখে তীঁর রোগ শনাক্ত বা সেই রোগীর চিকিৎসা করেন না।’’

শর্মিলার প্রশ্ন, ‘‘কলকাতাতেই তো কত মানুষ রোজ আক্রান্ত হচ্ছেন করোনায়। তাঁদের বেশির ভাগেরই কি রক্তের গ্রুপ এ? আমারও তো এ গ্রুপ। আমি এখনও আক্রান্ত হইনি তো।’’

জেনোটাইপ পরীক্ষা হয়েছে, উল্লেখযোগ্য গবেষণা

কলকাতার দুই ব্লাড ট্রান্সফিউশন বিশেষজ্ঞ ঋতম চক্রবর্তী ও সুদীপ্তশেখর দাস, দু’জনেই বলছেন, ‘‘এটা খুবই উল্লেখযোগ্য গবেষণা। চিনেও ফেব্রুয়ারিতে প্রায় একই ধরনের গবেষণা চালানো হয়েছিল। তবে সেটি ছিল ফেনোটাইপ। সেখানে শুধুই রোগীদের রক্তের গ্রুপ পরীক্ষা করা হয়েছিল। দেখা গিয়েছিল, এ গ্রুপের রক্তবাহক রোগীদের ক্ষেত্রেই কোভিড বেশি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। কিন্তু স্পেন ও ইটালির গবেষকদের এই গবেষণা আরও উচ্চ পর্যায়ের। জেনোটাইপ। সেখানে জেনেটিক স্তরে কোরিলেশন বা অ্যাসোসিয়েশন খুঁজে দেখার চেষ্টা হয়েছে। কিছুটা হলেও সেটা পাওয়া গিয়েছে। দেখা গিয়েছে, কোভিড আমাদের ফুসফুসকে অকেজো করে দিচ্ছে। গবেষকরা সেই ফুসফুসের একটি অত্যন্ত কার্যকরী জিন যে ক্রোমোজোমে থাকে সেই তৃতীয় ক্রোমোজোমটিও পরীক্ষা করে দেখেছেন। এটাও এই গবেষণার গুরুত্বপূর্ণ দিক।’’

আতঙ্ক নয়, সন্ধান…

যেমন গবেষকরা লিখেছেন গবেষণাপত্রে, প্রায় সেই একই সুরে বিশিষ্ট হেমাটোলজিস্ট ও ব্লাড ট্রান্সফিউশন বিশেষজ্ঞরাও বলেছেন, অযথা আতঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই। সবে ৬/৭ মাস হয়েছে। কোভিডকে এখনও পুরোপুরি চিনে-বুঝে ওঠা সম্ভব হয়নি। যেটুকু তথ্য পাওয়া সম্ভব হচ্ছে, তার ভিত্তিতেই পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা চালানো হচ্ছে। চালাতে হচ্ছে। ভাইরাসটি আমাদের শরীরে কী ভাবে কাজ করে, কোথায় কোথায় কতটা ক্ষয়-ক্ষতি করে সেটা জানতে ও বুঝতে। তার ফলে, নানা ধরনের তথ্য বেরিয়ে আসছে। যা পরবর্তী কালে সত্য প্রমাণিত হতে পারে আবার না-ও পারে। সন্ধানই এগিয়ে নিয়ে যায় বিজ্ঞানকে। অযথা আতঙ্ক ছড়ানো বিজ্ঞানের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য নয়।

এ ক্ষেত্রেও এক ধাপ এগিয়ে গেল চিকিৎসা বিজ্ঞানের গবেষণা।

গ্রাফিক: তিয়াসা দাস।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement