Satyajit Ray

আলোর সাতটি রংগানের সাত সুরের মতো

বলতেন সুব্রত মিত্র। আলোছায়ার প্রতিটি খুঁটিনাটিতেই ছিল কড়া নজরদারি। তাঁর হাতে ক্যামেরা থাকলে নিশ্চিন্ত হতেন সত্যজিৎ রায়ও। বাংলা ছবির সিনেম্যাটোগ্রাফি তাঁর হাত ধরেই আন্তর্জাতিক হয়ে ওঠে।

Advertisement

শুভজিৎ বসু

শেষ আপডেট: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২১ ০৬:৩২
Share:

কলাকুশলীদের সেভাবে আর কত জনই বা চেনেন! কিন্তু সুব্রত মিত্রকে চিনেছিলেন সত্যজিৎ রায়। সুব্রত-সত্যজিতের যুগলবন্দিতে তৈরি হয়েছিল সিনেম্যাটোগ্রাফির নতুন ভাষা। কাজ নিয়ে অসম্ভব খুঁতখুঁতে ছিলেন সুব্রত। আলোর ঔজ্জ্বল্য থেকে ছায়ার ঘনত্ব, সবেতেই ছিল কড়া নজরদারি। তাঁর হাতে ক্যামেরা তুলে দিয়ে সত্যজিৎ রায়ের মতো মানুষও নিশ্চিন্ত হতেন। বাস্তব দৃশ্য যে কত কাব্যময় হতে পারে, তা দেখিয়ে বিশ্বের নামী পরিচালকের নজর কেড়েছিলেন তিনি। বর্ষার আগমন, পদ্মে বৃষ্টির ফোঁটা, কাশবন, বৃষ্টিতে অপু-দুর্গার ভেজার দৃশ্য কখনও ভোলার নয়।

Advertisement

সুব্রত মিত্রর জন্ম ১৯৩০ সালের ১২ অক্টোবর। এক সাধারণ মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারে। স্কুলে পড়ার সময় থেকেই নেশা ছিল বিদেশি চলচ্চিত্র। কলেজে পড়ার সময় ভেবেছিলেন হয় আর্কিটেক্ট হবেন, না হলে চিত্রগ্রাহক। ১৯৫২ সালে সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’-র চিত্রগ্রাহক হিসেবে তাঁর অভিষেক এবং সকলেই জানেন, শুরুতেই কী ম্যাজিক তিনি তৈরি করেছিলেন। কিন্তু এই বিখ্যাত আলোকচিত্রীর প্রাপ্য মর্যাদা দিতেও মানুষের অস্বস্তি হয়েছে এক দিন। নিখুঁত হওয়ার জন্য সুব্রত মিত্রর প্রয়াস ছিল একশো ভাগ আন্তরিক। তাই এক বার এক বিজ্ঞাপনের শুটিংয়ে চায়ের লিকারের রং ঠিক পছন্দ হচ্ছে না বলে তিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা চা নিয়েই গবেষণা করে গেলেন। শুটিং টিম ভেবেছিল, ভদ্রলোকের মাথায় বোধহয় গোলমাল আছে!

ফরাসি দেশের প্রবাদপ্রতিম চলচ্চিত্রকার জঁ রেনোয়া তার ‘দ্য রিভার’ ছবির শুটিং করতে চল্লিশের দশকের প্রায় শেষ দিকে কলকাতায় এসেছিলেন। সঙ্গে ছিলেন তাঁর ভাইপো আলোকচিত্রী ক্লোদ রেনোয়া। সেই সেটে পর্যবেক্ষক হিসেবে থাকার সুযোগ পেয়েছিলেন সুব্রত মিত্র। জঁ রেনোয়ার কাজের ধরন তাঁকে বিস্মিত করে। তিনি মনোযোগী ছাত্রের মতো ছবি এঁকে এঁকে আলোর ব্যবহার, অভিনেতাদের চলাচল, ক্যামেরার অবস্থান সম্পর্কে অক্লান্ত ভাবে নোট নিলেন। তাঁকে লক্ষ করেছিলেন রেনোয়া। এক দিন সুব্রতর ডাক পড়ল। জঁ রেনোয়া সুব্রতর পর্যবেক্ষণ এবং নেওয়া নোট দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। এর পর ক্লোদ রেনোয়া লাইট কনটিনিউটির জন্য তাঁর সেই খাতারই শরণাপন্ন হলেন। বলা যেতে পারে সেখান থেকেই ভারতীয় চলচ্চিত্রে আধুনিকতার সূত্রপাত। এই ছবির সেটেই সুব্রতর সঙ্গে বন্ধুত্বের সূচনা আর এক শিল্পীর। তিনি শিল্প নির্দেশক বংশী চন্দ্রগুপ্ত। তিনি এই ছবিতে সেটের কাজ করছিলেন। ছুটির দিনে শুটিং দেখতে আসতেন তরুণ সত্যজিৎ। তিনি তখনও সে ভাবে ছবি করেননি। দিনের পর দিন গভীর আলোচনা চলতে দু’জনের মধ্যে। এ ভাবেই এক দিন সত্যজিতের মনে হয়েছিল সুব্রত মিত্রর ক্যামেরার চোখ এখন পুরোপুরি প্রস্তুত। তবুও তিনি ছিলেন সেকেন্ড অপশন। ‘পথের পাঁচালী’-র জন্য পরিচালকের প্রথম পছন্দ ছিলেন ‘ছিন্নমূল’ খ্যাত নিমাই ঘোষ। কিন্তু তখন তামিল সিনেমার চাপ নিমাইবাবুকে ছাড় দেয়নি। ফলে সুযোগ পেলেন সুব্রত মিত্র। সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ সুব্রতবাবুর অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?— “... এর আগে আমি কখনও মুভি ক্যামেরায় হাত দিইনি! কোনও ক্যামেরাম্যানকে অ্যাসিস্টও করিনি। ফলে পরের দিন কী করব এই চিন্তায় আমি রাতের পর রাত ঘুমোতে পারতাম না। প্রযুক্তিগত বা নান্দনিক দিক থেকে ‘পথের পাঁচালী’-তে বহু অসাধারণ শট যেমন আছে, তেমন আবার অনেক খারাপ শটও আছে।”

Advertisement

এর পর আর তাঁকে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ‘অপু’ ট্রিলজি (১৯৫৫-৫৬) থেকে ‘নায়ক’ (১৯৬৬), তাঁকে ছাড়া কাউকে ভাবেননি সত্যজিৎ। পাশাপাশি ছিল জেমস আইভরির সঙ্গে ‘দি হাউসহোল্ডার’-সহ চারটি ছবি, রমেশ শর্মার ‘নিউ দিল্লি টাইমস’, বাসু ভট্টাচার্যের ‘তিসরি কসম’-এর মতো আরও সব মাইলস্টোন।

চলচ্চিত্রে আলোর ব্যবহারকে বিখ্যাত স্প্যানিশ সিনেম্যাটোগ্রাফার নেস্তর আলমেনদ্রস নানা ভাবে বর্ণনা করেছেন ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত ‘ফিল্ম কালচার’ পত্রিকায়। কিন্তু পুরনো ধ্যানধারণা বদলে গেল যখন লুচিনো ভিসকন্তির সাদা-কালো ছবি ‘লা তেরা ত্রেমা’ (১৯৪৮) ও রঙিন ‘সেনসো’ (১৯৫৪) আর ভিত্তোরিয়ো দা সিকার ‘উমবের্তো ডি’-তে (১৯৫২) নবাগত ইটালিয়ান সিনেম্যাটোগ্রাফার জি আর আলডো প্রাকৃতিক আলোর সঙ্গে নির্দিষ্ট মাত্রার কৃত্রিম আলো যুক্ত করে অতিরিক্ত আলো বাউন্স অফ করিয়ে দিলেন। এই নিরীক্ষা বিষয়ে অবগত না থেকেও তরুণ সুব্রত মিত্র ডিফিউজ়ড লাইটিং-এর উদ্ভাবন করলেন সত্যজিৎ রায়ের ‘অপরাজিত’ (১৯৫৬) ছবিতে। বৃষ্টির ভয়ে শিল্প নির্দেশক বংশী চন্দ্রগুপ্ত খোলা জায়গায় বেনারসের পুরনো বাড়ির ভিতরটা তৈরি না করে করেছিলেন স্টুডিয়োর ভিতরেই। সমস্যা হচ্ছিল আলো নিয়ে। সত্যজিৎ রায় এবং বংশী চন্দ্রগুপ্ত দু’জনেই হতাশ হয়েছিলেন, যে সেট স্টুডিয়োর ভিতরে হওয়ায় আর কোনও ভাবেই ডিফিউজ়ড ন্যাচরাল স্কাইলাইট পাওয়া যাবে না। হতাশ হননি সুব্রত মিত্র। তখনই তিনি উদ্ভাবন করেন ‘বাউন্স লাইটিং’-এর ম্যাজিক। একটা সাদা কাপড় ফ্রেম করে তাতে স্টুডিয়োর কৃত্রিম আলো বাউন্স করিয়ে এনেছিলেন একেবারে আকাশের মতো আলো। তাঁর হাত ধরেই বাংলা ছবির সিনেম্যাটোগ্রাফি আন্তর্জাতিক হয়ে ওঠে।

আলডো যেমন রং বিষয়ে তাঁর নিজস্ব চিন্তাধারার স্বাক্ষর রেখেছিলেন ‘সেনসো’ ছবিতে, সুব্রত মিত্র তেমনই এক অন্য মাত্রা যুক্ত করলেন সত্যজিতের প্রথম রঙিন ছবি ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’-য়। আলমেনদ্রস বলেছিলেন ক্যামেরাম্যানই ছবির প্রথম দর্শক, শুধু তাই নয়, তাঁর চোখ দিয়েই দর্শক ছবিটি দেখে। সুব্রত মিত্র লুক থ্রু-র সময় সর্বদা মনে রাখতেন, ক্যামেরায় তাঁর নৈপুণ্যই দর্শককে দৃষ্টি দান করবে, তাঁকে ছাড়া দর্শক সৌন্দর্যের ঐশ্বরিক রসদ খুঁজে পাবে না। আলোর অপেরা ঘিরে তাঁর সৃষ্টির ধারায় এখনও অনবরত ভিজে চলেছেন সিনেমাপ্রেমীরা। সুব্রত মিত্রর প্রসঙ্গে বলা হত, “সুব্রতবাবুর কাছে ক্যামেরার লেন্স হচ্ছে স্বরলিপির নোট।” তিনি তাঁর ছাত্রদের শেখাতেন, আলোর রেশিয়োয় সাতটি বর্ণালি হচ্ছে সা রে গা মা পা ধা নি সা।

‘পথের পাঁচালী’-র বালিকা দুর্গা যখন কচুপাতায় মুখ লাগিয়েছিল তখন যেন সূর্যরশ্মিও কী রকম তরতাজা হয়ে উঠেছিল। মেঘলা নরম আলো, বিস্তৃত ধানখেতে অপু, কাশবনে সাদা আলোর জৌলুস সবই যেন মিলেমিশে একাকার। সুব্রত মিত্র ছাড়া যে এটা সম্ভব হত না, মেনে নেন সব চলচ্চিত্রবোদ্ধাই। ‘চারুলতা’-র জন্য তাঁকে নিতে হল অন্য কৌশল। সত্যজিৎ স্থানের গুরুত্ব ও মাত্রা বাড়াতে চাইলেন। সুব্রতও কাঠের বাক্সের সাহায্যে বাউন্স লাইটিং-এর এক অনন্য সতেজতা নিয়ে এলেন। আর তাঁর লেন্সে ধরা ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’-র রূপসী পাহাড় এক কথায় অতুলনীয়। আধুনিক প্রযুক্তির যুগেও তাঁর কাজ একই রকম বিস্ময় উদ্রেক করে।

সুব্রত মিত্র কিছুতেই সন্তুষ্ট হতেন না, আরও বেশি ভাল করার খিদে তাঁকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াত। ‘চারুলতা’-র মাধবী মুখোপাধ্যায়ের যে স্বর্গীয় সৌন্দর্য, তা আর কখনও ধরা পড়েছে কি? ঠিক তেমনই ‘তিসরি কসম’-এ ওয়াহিদা রহমান। সুব্রত মিত্র প্রতি বারই ডুবুরির মতো নেমে গিয়েছেন অতল সমুদ্রে, খুঁজে এনেছেন শ্রেষ্ঠ মুক্তোটি।

সুব্রত মিত্রকে ১৯৮৬ সালে ন্যাশনাল ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড দিয়ে সম্মানিত করা হয় শ্রেষ্ঠ সিনেম্যাটোগ্রাফির জন্য। ওই একই বছর পান ‘পদ্মশ্রী’ খেতাবও। মারা যাওয়ার পাঁচ বছর আগে পেয়েছিলেন ‘ইস্টম্যান কোডাক লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড ফর এক্সেলেন্স ইন সিনেম্যাটোগ্রাফি’।

১৯৯৭ সালে মারা যাওয়ার আগে পর্যন্ত তিনি ছিলেন সত্যজিৎ রায় ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট-এর এক জন ইমেরিটাস প্রফেসর।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement