ছবি: প্রসেনজিৎ নাথ।
পূর্বানুবৃত্তি: টিভি দেখতে-দেখতে ত্রিশ বছর আগের ঘটনা একে-একে মনে পড়ে যায় অন্নুর। মনে পড়ে সেই ছেলেটির সঙ্গে কাটানো সময়ের কথা। সে দিন অপালা তাকে বলেছিল মানিকের সঙ্গে সময় নষ্ট না করে প্রীতের প্রতি মনোযোগ দিয়ে ভবিষ্যৎ সুনিশ্চিত করতে। পাঁচ বছর আগে, অন্নুর বিয়ের রজত জয়ন্তীর ঠিক আগের দিনই, অপালা তাকে জানিয়েছিল মানিকের মৃত্যুসংবাদ।
অন্নুর মনে হচ্ছিল ওর কানে কেউ গলানো সিসে ঢেলে দিচ্ছে। অপালা কেন নিষ্ঠুরের মতো আজকের দিনে এ সব শোনাচ্ছে? ওর অবচেতনে কি আজও কোনও বিদ্বেষ বা অসূয়া কাজ করে চলেছে? এ দিকে কানে ভাসছে আর্তকণ্ঠে বলা মানিকের সেই কথাগুলো, ‘‘ঠিক কত দূরে গেলে তোমার কাছ থেকে সত্যিকারের দূরে যাওয়া হবে, জানি না। পালিয়ে বেড়ানো বা লুকিয়ে থাকার পক্ষে পৃথিবীটা বড্ড ছোট।’’ যখন ও জানতে চেয়েছিল আর কোনও দিন কোনও ভাবে দেখা হবে কি না, তখন ওর বিয়ের দিন ঠিক হয়ে গিয়েছে। শেষ চেষ্টা করেছিল সে দিন লম্বা ছুটি নিয়ে ইউনিভার্সিটি থেকে বাড়ি চলে যাওয়ার আগে। নিমন্ত্রণও করেছিল সেই সঙ্গে।
বিষণ্ণ গলায় মানিক বলেছিল, ‘‘‘শ্যামা’ নৃত্যনাট্যে উত্তীয়-কে কোনও দিনই আমার আদর্শ পুরুষ-চরিত্র মনে হয়নি, যাকে প্রেমের দোহাই দিয়ে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেওয়া যায়! তা-ও আবার অন্যের মিথ্যে অপবাদের ভিত্তিহীন অপরাধের দায় মাথায় নিয়ে। সে দিক থেকে আমার আদর্শ বজ্রসেন ক্রমাগত দোটানায় ভুগেছে শুধু এই ভেবে যে, কী করা উচিত! তার জীবনদাত্রী আর প্রেমিকাকে বুকে টেনে নেওয়া, না কি এক হৃদয়হীনা, স্বার্থসর্বস্ব হত্যাকারিণীকে নিষ্ঠুর ভাবে অপমান করে দূরে ঠেলে দেওয়া— যে এক জন নিরপরাধ, দুর্বলচিত্ত প্রেমিকের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তাকে মৃত্যুমুখে পাঠিয়েছে! ভাগ্যের পরিহাস দেখো, এখানে আমি উত্তীয়। অথচ বজ্রসেনও তো হতে পারতাম!’’
মানিকের ইঙ্গিত বুঝে অনামিকার মুখ অপমানে কালো হয়ে গিয়েছিল, আহতস্বরে বলেছিল, ‘‘একদম প্রথম দিকের ঝগড়াঝাঁটি বাদ দিলে, তোমার নিষ্ঠুর ব্যবহারের কোনও প্রতিবাদ আমি করিনি, কারণ জানি সব দোষই আমার। তোমার সান্নিধ্য কেন জানি না আমার ভাল লাগে, তুমি আমায় গুরুত্ব না দেওয়া পর্যন্ত আমি অতীত-ভবিষ্যৎ ভাবিনি, তোমার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টাই শুধু করে গিয়েছি। হ্যাঁ, আমি লোভী, আমার লোভ হয়েছিল... যা আমার প্রাপ্য নয় তার প্রতি লোভ করে আমি তোমায় ঠকিয়েছি, অন্য এক জনকে ঠকিয়েছি আর সবচেয়ে বেশি ঠকিয়েছি বোধহয় নিজেকে। যার মাশুল বাকি জীবন আমায় দিতে হবে একান্তে আফসোস করে আর চোখের জল ফেলে...’’
বেশি কড়া কথা বলা হয়ে গিয়েছে বুঝতে পেরে মানিক কিছুটা সামলে নিয়েছিল, ‘‘আমি কিন্তু কাউকেই ঠকাতে চাইনি, চেয়েছিলাম তোমার হাসিখুশি চেহারাটা ফিরিয়ে আনতে, তোমার মনে যে ভার চেপে বসে আছে বলে মনে হয়েছিল আমার, সেটা কিছুটা হালকা করতে। যদি তুমি চাও, আমি কুড়ি-পঁচিশ বছরও তোমার জন্যে অপেক্ষা করতে রাজি আছি। তুমি তো জানো, মন-ভোলানো প্রেমের কথা আমার আসে না।’’
কষ্টের মাঝেও হেসে উঠেছিল অন্নু, ‘‘পাগল কোথাকার, অত বছর বাদে আমাদের বয়সও তো পঞ্চাশ ছাড়িয়ে ষাটের দিকে হাঁটবে। আমি তো খারাপ মেয়ে, আমাকে তুমি না হয় ঘৃণাতেই মনে রেখো। তার পর বিয়ে করে সংসারী হও। আমাকে ভুলে যাওয়াই তো ভাল। এ কথা আর কারও কাছে কোনও দিন প্রকাশ করতে পারব না, এমনকি ক’দিন পরে তোমার ভাষায় স্বামীর অস্থাবর সম্পত্তি হিসেবে, অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তোমার কাছেও হয়তো অস্বীকার করব। কিন্তু কঠোর বাস্তব হল, ঠিক আজকের দিনে তোমার দিকেই আমার মনের দাঁড়িপাল্লা বেশি ঝুঁকে আছে।’’
অবুঝের মতো মানিক বলেছিল, ‘‘তা হলে মন যা চায়, তা-ই করছ না কেন? কার্যত এখনও তুমি স্বাধীন!’’ করুণ হেসে অন্নু উত্তর দিয়েছিল, ‘‘সব কিছু কি চাইলেই করা যায়? আর আমায় লোভ দেখিয়ো না। কেন সব মেনে নিচ্ছি? তোমায় আমি অনেক উঁচু জায়গায় বসিয়েছি যে! আর শুনতে ক্লিশে মনে হলেও জানবে, পোকায়-কাটা ফুলে দেবতার পুজো হয় না! তুমি হয়তো প্রশ্ন করবে, তা হলে তোমাকে কাছে টানলাম কেন, আর যখন এসেই গেলে তখন আরও কাছে আসতে বাধাই বা দিলাম না কেন? এ সবের উত্তর আমার কাছেও নেই। তোমার হাজার অভিযোগ আমার বিরুদ্ধে, আরও বাড়বে, সব মুখ বুজে মেনে নিচ্ছি। শুধু যদি কখনও দেখা করার বা কথা বলার ইচ্ছে হয়...’’
কঠোর মুখ করে মানিক বলেছিল, ‘‘দেখা করার বা কথা বলার ইচ্ছে আমার সে দিন থেকে থাকবে না, যে দিন থেকে তুমি আর আজকের তুমি থাকবে না। না জেনে অন্যের প্রেমিকাকে ভালবেসে ফেলেছি, কিন্তু মরে গেলেও অন্যের স্ত্রীকে ভালবাসা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। নিশ্চয়ই তুমি দীর্ঘ দিন ধরে অনেক হিসেব করেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছ। শুধু দুঃখ এই যে, শীতে আগুন পোহানোর জন্যে গরিবের কুঁড়েঘরটাই যে কেন রাজমহিষীর নজরে পড়ল! আমি তো কাউকে চ্যালেঞ্জ করতে যাইনি কোনও কিছুতে!’’
একটু সময় নিয়ে মানিক থমথমে গলায় বলে, ‘‘তুমি জানো না, ছোটবেলা থেকে বাবা-মার মুখে হাসি ফোটাব বলে বহু প্রতিকূলতার মধ্যেও আমার লেখাপড়া, রিসার্চ করতে আসা। আর এখন জীবনে কিছু করা তো দূরস্থান, বেঁচে থাকার যৌক্তিকতাই খুঁজে পাচ্ছি না। তোমার তো একটা লক্ষ্য স্থির ছিল জীবনের, সেখানেও কাবাব মে হাড্ডি হয়ে গলায় ফুটলাম। শেষবেলায় তোমায় আঘাত ছাড়া আর কী দেব? আমি তো আমার মুখ চেয়ে বেঁচে-থাকা বাবা-মার কথা ভেবে নিজেকে শেষ করে দিতেও পারব না। ঠিক কত দূরে গেলে তোমার কাছ থেকে সত্যিকারের দূরে যাওয়া হবে, জানি না। পৃথিবীটা বড্ড ছোট, পালিয়ে বেড়ানো বা... ’’
আজ চোখের জলে ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসা টিভি স্ক্রিনে কথা বলতে থাকা মানুষটার দিকে তাকিয়ে অতগুলো বছর আগে বলা কথাগুলোর সত্যতা মর্মে-মর্মে অনুভব করে অন্নু। নিজেকে জিজ্ঞেস করতেও ভরসা হয় না, এই জল ওর গোপন ভালবাসার জন বেঁচে থাকার আনন্দে, না কি ওর জীবনের যে-শনি ওর সুখের সংসারটাকে মন ভরে উপভোগ করতে দিল না, সে নিপাত হয়েও হয়নি, এটা জেনে।
৪
আজকাল বিবেক বোসের যাতায়াত বেড়েছে অনিকেতের ঘরে। গভীর রাত্রি না হলে তিনি আসেন না, তাও আবার যখন তিন পেগেরও বেশি অ্যালকোহল অনিকেতের পেটে পড়ে। কাল রাতেও— তখন ক’টা বাজে অনিকেত ঠিক করে বলতে পারবে না, কারণ ঘড়ি দেখে সময় হিসেব করার ক্ষমতা তখন ওর লুপ্ত হয়েছিল— সেই মুহূর্তে তিনি এসে হাজির। যেমন হয়, তিনি এমন ভাবে বন্ধ ঘরে ঢুকলেন, যেন দরজাটা খোলাই ছিল ওঁর জন্যে, তার পর ঘরের কোণে রাখা স্টিলের ফাঁকা ওয়েস্ট পেপার বিনটা উল্টে রেখে তাতে পা দু’টো ঝুলিয়ে বসে তিনি কপট এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন, ‘‘না হে, তুমি একেবারে বখেই গেলে শেষ তক! তোমার বাবা-মাকে কী জবাব দেব বলো তো এর পর দেখা হলে, তাঁদের সুবোধ মানিকের গুণপনা নিয়ে?’’
অনিকেতের তখন কথা জড়িয়ে এসেছে, সে অবস্থাতেও বিদ্রুপ করতে ছাড়ে না, ‘‘বাবা-মাকে জবাবদিহি করতে হলে তোমায় তো আর-একটু উপরতলায় উঠতে হবে! সেখানেই যাও না বরং, মাঝরাতে বুকের জ্বালা জুড়োতে বসেছি সবাইকে লুকিয়ে... তাতেও কেন বাদ সাধতে এলে, প্রভু?’’
মুখের আদল একদম ওরই মতো, এমনকি পাতলা হয়ে আসা হেয়ারলাইনটাও... শুধু চেহারাটাই যা পাঁচ বছরের শিশুর। ওর রিডিউসড ফোটোকপি আবার লম্বা শ্বাস ছাড়ে, ‘‘তাও কি হয়, ভাইটি! তোমাকে ফ্রি সার্ভিস দেওয়াটাই তো আমার আসল কাজ, সে জন্যেই তো সর্বত্র আমার অবাধ গতি, এমনকি তোমার স্বর্গীয়দের কাছেও। এইমাত্র অনামিকার ঘর থেকে ঘুরে এলাম, ও-ও এখনও ঘুমোয়নি... তোমাকেই শাপশাপান্ত করছে বলে মনে হল যেন! কী জানি, ভুলও হতে পারে। বয়স তো কম হল না!’’
এ বার অনিকেতের কান খাড়া হয়। এই নামটা এখনও কেন যে ওকে হন্ট করে, ও জানে না। মুখ ফসকে বেরিয়ে যায়, ‘‘ওকে কাঁদতে দেখলে না কি? আমার কথা মনে পড়ে ওর কখনও?’’ বলেই মনে-মনে জিভ কাটে, ওর এই গোপন ব্যথা আর আকাঙ্ক্ষার কথা চিরকালই নিজের মধ্যে চেপে রাখার চেষ্টা করেছে। ওর প্রতিপক্ষও যথেষ্ট ঘোড়েল, ওর উদ্বেগ আর কৌতূহলটা যেন বোঝেইনি এমন ভান করে বলল, ‘‘কান্নাকাটি করার মতো মেয়ে সে নয়, সে তুমি ভালই জানো। তা ছাড়া যাকে চেয়েছিল, যেমন ভাবে চেয়েছিল জীবনটাকে উপভোগ করতে, সে ভাবেই তো সব কিছু ঘটেছে ওর ক্ষেত্রে। তা হলে ওর জীবনে কান্নার জায়গা কোথায়? দেখলাম, পাশে ওর স্বামী, প্রীত না কী যেন নাম, শুয়ে নাক ডাকাচ্ছে আর ও সমানে ‘শয়তান’, ‘বদমাশ’ ইত্যাদি বলে কাকে যেন গালি দিয়ে যাচ্ছে। কিছুটা মনের ভিতরে ঢোকার ক্ষমতা তো পেয়েছি, তাতেই মনে হল তোমাকে লক্ষ্য করেও হতে পারে... কারণ এক বার যেন বলল, ‘এত বছর ধরে চোখের আড়ালে গিয়েও কেন মন থেকে একেবারে দূর হচ্ছে না আপদটা?’ কী বুঝলে!’’ তার পর চোখ টিপে ইশারা করে মুচকি হাসল, ‘‘ভাল কথা, ওকে কোনও দিন কাঁদতে দেখেছ না কি তুমি?’’
কিছু না ভেবেই জড়ানো গলায় অনিকেত উত্তর দিল, ‘‘এক বারই কাঁদতে দেখেছিলাম। সেটাও দুঃখে বা বেদনায় নয়, বদনাম আর ব্ল্যাকমেলের ভয়ে। তার পরই তো নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে ভাবতে শুরু করলাম আমাদের সম্পর্ককে। অনেক কিছুতে মিল থাকলেও এ সম্পর্ক যে রাধাকৃষ্ণের প্রেম হবে না, সে তো এ যুগের রাধার রি-অ্যাকশন থেকেই টের পেলাম। ফলে দ্বাপরের মতো এই ঘোর কলিতেও...’’
ওর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বিবেক বলে, ‘‘হুঁ, বৃন্দাবন-পর্বের পর আর কোথাও শ্রীরাধিকার কোনও উল্লেখ নেই পুরাণ বা ভাগবতে। তোমার জীবন থেকেও তাই সব দুর্বলতা, বেদনা, আগ্রহ, আকাঙ্ক্ষা মুছে দিয়েছ এ ব্যাপারে! কিন্তু ভায়া, ভেবে দেখলে মনে হচ্ছে দোষটা সিংহভাগ তোমারই। এক জন আয়ান ঘোষ আছে জেনেও তোমার ও দিকে পা বাড়ানো উচিত হয়নি...’’
মুহূর্তে গলার স্বর স্বাভাবিক হয়ে ওঠে অনিকেতের, ‘‘তুমি যদি আকারে এতটা ছোট না হতে, সত্যি বলছি নিজের বিবেকের গলা টিপে মারতে আমার এতটুকু দ্বিধা হত না। যে লোকটা কোনও দিনই মেয়েদের দিকে ভাল করে তাকিয়ে দেখল না, সে যাবে জেনেশুনে পরকীয়া করতে? এই বুদ্ধি নিয়ে তুমি বিবেকের ভুমিকায় নেমেছ! যাও তুমি আমার চোখের সামনে থেকে, এত কষ্টের নেশা আমার, তার মৌতাত মাটি করতে এসেছ, উজবুক!’’
খর্বকায় বিবেক রাগ করে না, উলটে হাসে, ‘‘আহা, এত রাগ করো কেন ভাই? তোমাকে ভালবাসি বলেই না খোঁজখবর নিই! আর চেহারার কথা বলছ? রাস্তাঘাটে চেনাজানা যে সব বিবেকের সঙ্গে দেখা হয় অধিকাংশের সঙ্গে আমাকে অনেকটা মাথা ঝুঁকিয়েই বাক্যালাপ করতে হয়, কয়েকজনকে তো ভাল করে দেখতেও পাওয়া যায় না, এতটাই হাল খারাপ তাদের। সব সুস্থ-স্বাভাবিক বিবেকই পাঁচ বছরের বাচ্চার মাপে হয়, ব্যক্তির বয়স আর পাপের বোঝা বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে হাঁড়ির হাল হতে থাকে তার বিবেকের। সে যাক, তা হলে তুমি বলছ, জেনেশুনে তোমরা কিছু করোনি, হিন্দি সিনেমার গানের মতো ‘প্যার কিয়া নেহি যাতা, প্যার হো যাতা হ্যায়..’ ভাই, তোমাদেরটাও কি.... হেঁ-হেঁ...’’
লাল চোখে অনিকেত শাসায়, ‘‘ভাল হবে না বলে দিচ্ছি, ফের যদি ব্যঙ্গবিদ্রুপ করো... সে কেন এমনটা করেছিল তার জবাব সে-ই ভাল দিতে পারবে, তবে আমি দুর্বল হয়েছিলাম আমার প্রতি ওর দুর্বলতা আছে, সেটা অনুভব করার পর। আমাদের ক্ষেত্রে তো লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট হয়নি, বরং বেশ খানিকটা কথা-কাটাকাটি আর চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়েই শুরুটা হয়েছিল। সে যা-ই হোক, তার সবটাই ওর ছেলেখেলা ছিল, সেটা আমার মন কখনওই মানতে চায়নি। কিন্তু নানা ঘাটের জল-খাওয়া মাথাটা প্রথম থেকেই অন্য রকম সম্ভাবনার কথা ভাবতে চেয়েছিল আমাদের সম্পর্ক নিয়ে।’’
বিবেক জুলজুল করে তাকিয়ে থাকে অনেক ক্ষণ, তারপর সম্মোহন করার ভঙ্গিতে খুব ধীরে-ধীরে প্রশ্ন করে, ‘‘মাথা কী ভাবছিল সেটা শেয়ার করতে আপত্তি আছে? খুব অসুবিধে থাকলে বলতে হবে না, কিন্তু বললে একটু হালকা হতে, এই আর কী! এতগুলো বছর এই ভূতের বোঝা তো একলাই বয়ে বেড়াচ্ছ!’’
অনিকেত একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, ‘‘নাঃ, অসুবিধে আর কী! তিন কাল তো শেষ করেই ফেললাম, বাঁচার বয়সও আর বেশি নেই, ইচ্ছেও আছে বলে মনে হয় না। সব সম্পর্ক ছিন্ন করে যখন চলেই এলাম, তখন বেঁচে থাকার ইচ্ছেটাই একেবারে চলে গিয়েছিল। অথচ মরতে গেলেও বাবা-মায়ের চিন্তা পথরোধ করে দাঁড়াচ্ছিল। বারবারই মনে হত, ছেলে হিসেবে কোনও কর্তব্যই তো পালন করতে পারলাম না, এমন একটা ইস্যুতে এসকেপিস্টের মতো মরে গিয়ে ওঁদের শেষ জীবনটা নরক করে দিয়ে যাব! এক পুত্রহারা বাউল দম্পতিকে দেখে আরও বেশি করে সেটা মনে হতে লাগল।’’
বিবেক ঘাড় নেড়ে সায় দেয়, ‘‘সে তো এক দিকে ভালই করেছিলে, শেষ দিন পর্যন্ত ওঁরা জানতেও পারেননি কী যন্ত্রণা তুমি বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছ! তোমার সামনেই তাঁদের বার্ধক্যের মৃত্যুই হয়েছে, তোমাকে নিয়ে তাঁদের তেমন অনুযোগও ছিল না, কেবল বিয়ে কেন করছ না, এটা ছাড়া।’’
আত্মগত ভাবে অনিকেত বলে চলে, ‘‘বীরভূমের তারাপীঠের কাছে কালীপাহাড়ী বলে একটা আশ্রমের মতো জায়গা আছে। সেখানে সব কিছু থেকে পালিয়ে কিছু দিন লুকিয়ে ছিলাম, নিজের কাছ থেকে... নিজের প্রারব্ধের কাছ থেকে। সে এক অদ্ভুত জায়গা! দিনের বেলা কিছু দূরে এক দিকে হাইওয়ে, অন্য দিকে আরও কিছু দূরে রেলস্টেশন। রাত্রি হলে ঘন অন্ধকার, একটানা ঝিঁঝির ডাক আর শুকনো পাতার উপর দিয়ে সরীসৃপের চলার সরসর শব্দ। মনে হবে, সভ্যতা থেকে অনেক দূরে কোনও গহন অরণ্যে নির্বাসনে আছি। আশ্রমে রেডিয়োতেও নিষেধাজ্ঞা! সাপ আর তেঁতুলেবিছে অধ্যুষিত সেই জঙ্গলঘেরা জায়গায় গীতা আর শঙ্করাচার্যের লেখা মোহমুদ্গর— মোহকুঠার পড়তে-পড়তে এক দিন বোধিলাভ হল...’’
ওর নিভু-নিভু আওয়াজকে উসকে দেওয়ার জন্যে বিবেক খোঁচা দেয়, ‘‘নিশ্চয়ই বুঝতে পারলে যে, তোমার বোকামি আর সারল্যের সুযোগ নিয়ে অহঙ্কারী মেয়েটা টাইমপাস করে গিয়েছে। কারণ তার জীবনের অঙ্ক তো আগে থেকেই কষা ছিল। কোথায় তার সর্বগুণান্বিত প্রেমিক আর কোথায় তুমি— সুকুমার রায়ের সৎপাত্র গঙ্গারাম! তা ছাড়া আরও একটা ব্যাপার আছে, তুমিই তো বললে যে ঝগড়া দিয়ে তোমাদের পরিচয়ের সূত্রপাত। শাস্ত্রে তো আছেই যে, মধুমাখা ছুরি দিয়ে শত্রুনিপাতের মজ়া হি কুছ অওর হ্যায়! কী, ঠিক বলেছি কি না?’’
ক্রমশ