Colonial Rule in India

ভারতের গ্রীষ্মও ছিল ইংরেজদের শত্রু

বিলেত থেকে যে সব সায়েব প্রথম রওনা দিত ভারতে আসার জন্য, তাদের উদ্দেশে ১৮১০ সালে টমাস উইলিয়ামসন তাঁর ‘ইস্ট ইন্ডিয়া ভাদে-মেকাম’ গ্রন্থে লিখেছিলেন, চার ডজন সুতির জামা সঙ্গে নেওয়া দরকার।

Advertisement

নিখিল সুর

শেষ আপডেট: ২৬ মে ২০২৪ ০৭:২৫
Share:

ছবি: রৌদ্র মিত্র।

এক বার ভেবে দেখো, নাচের সময় তোমার প্রিয় সঙ্গিনীর সাজগোজ প্রচণ্ড গরমে নষ্ট হতে বসেছে, তাঁর শরীর অবসন্ন হয়ে পড়ছে, আর তুমি তাঁর কপালে ফুটে ওঠা মুক্তোর দানার মতো স্বেদবিন্দু মুছিয়ে দিচ্ছ তোমার মসলিন রুমাল দিয়ে”— কথাটা লিখেছিল একটা ইংরেজি পত্রিকা, উনিশ শতকের গোড়ার দিকে।

Advertisement

যে সব সায়েব-মেম প্রথম ভারতে আসত, তাদের কোনও ধারণাই থাকত না এ দেশের গ্রীষ্মের চেহারা সম্পর্কে। তাই বজায় রাখতে সচেষ্ট হত তাদের বিলিতি চালচলন, পোশাক-আশাক। এ দেশের মাটিতে পা দিয়ে এখানকার মানুষের আচরণ, অভ্যেসগুলি তারা যে কেবল অবাক চোখে দেখত তা-ই নয়, অমার্জিত মনে করে এড়িয়েও চলত। অনেককে দেখা যেত, বিনা ছাতায় হেঁটে চলেছে গ্রীষ্মের প্রচণ্ড রোদ উপেক্ষা করে। এই চূড়ান্ত বোকামির চরম মাশুল দিতে সময় লাগত না। দেখা যেত, অল্প দিনের মধ্যেই তাদের কেউ গোরস্থানেচলেছে পরিচিতজনের কাঁধে চেপে। সৌজন্যে সানস্ট্রোক, সর্দিগর্মি।

লর্ড ম্যাকার্টনে কলকাতায় এসে সায়েবদের পালকি ও ঘোড়ার গাড়িতে যাতায়াত করতে দেখে মনে করেছিলেন, সেটা বাড়াবাড়ি বিলাসিতা। তাই নিজেই কিছু দিন রোদে-তাপে হাঁটাহাঁটি করলেন এবং অসুস্থ হয়ে পড়লেন। দেখা দিল ক্ষুধামান্দ্য, ঘন ঘন মাথা ধরা। এক দিন প্রবল জ্বর নিয়ে ফিরলেন কর্মস্থল থেকে। ডাক্তার বললেন, তিনি খুবই ভুল করেছেন রোদের মধ্যে পায়ে হেঁটে। হাজার যোজন দূরে থাকা, ভারতের গ্রীষ্ম সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ বিলেতের কর্মকর্তারা ফতোয়া জারি করেছিলেন, সিভিলিয়ানরা ঘোড়ায় সওয়ার হতে এবং পালকিতে চাপতে পারবেন না। এই নির্দেশে উদ্বিগ্ন হয়ে কলকাতার কাউন্সিল ১৭৫৫ সালের ৭ ডিসেম্বর তাঁদের কাছে আর্জি পেশ করল, অন্তত গ্রীষ্মকালটায় তাঁদের নির্দেশ মুলতুবি রাখা হোক। কর্মকর্তারা শেষ পর্যন্ত বাতিল করেন এই হুকুম, সমস্যার গুরুত্ব বুঝতে পেরে।

Advertisement

বিলেত থেকে যে সব সায়েব প্রথম রওনা দিত ভারতে আসার জন্য, তাদের উদ্দেশে ১৮১০ সালে টমাস উইলিয়ামসন তাঁর ‘ইস্ট ইন্ডিয়া ভাদে-মেকাম’ গ্রন্থে লিখেছিলেন, চার ডজন সুতির জামা সঙ্গে নেওয়া দরকার। সুতির জামা ভারতের মতো গ্রীষ্মপ্রধান দেশে অপরিহার্য। লিনেন এ দেশে স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকারক। আর টাই একেবারেই অপ্রয়োজনীয়। সুতির জামার সঙ্গে নিতে হবে চার ডজন রুমাল। সেটা লিনেনের হতে পারে। কিন্তু তার সঙ্গে আরও চার ডজন সুতির রুমাল অপরিহার্য।

গ্রীষ্মকালে কলকাতার সায়েবরা সাধারণত দুপুরের পর দফতরে কাজকর্ম করত না। ১৭৫৪-তে একটি নির্দেশে বলা হয়েছিল, সিভিলিয়ানরা সকাল ন’টা থেকে বারোটা পর্যন্ত দফতরে উপস্থিত থাকবে। পরবর্তী কালে কাজের চাপে বাতিল হয়ে যায় এই নিয়ম। ওয়ারেন হেস্টিংস ও কর্নওয়ালিসের মতো যাঁরা খুব সকালে বিছানা ছাড়তেন, তাঁরা দুপুরে ‘ডিনার’ সেরে দরজা-জানালা খোলা রেখে ঘণ্টা দুয়েক দিবানিদ্রা দিয়ে শরীরটাকে চাঙ্গা করে নিতেন গরমের ঠেলায়। বলে রাখা দরকার, আঠারো-উনিশ শতকে এ দেশের সায়েবরা ‘ডিনার’ সেরে ফেলত বেলা দুটো নাগাদ। এ কালের ‘লাঞ্চ’ শব্দটার সাক্ষাৎ পাওয়া যায় না কোনও নথিতে।

গ্রীষ্মের হাত থেকে কিছুটা রেহাই পেতে সায়েবরা কিছু ব্যবস্থা করেছিল নিজেরাই। তারা খসখসের ব্যবহার শিখেছিল এ দেশে এসে। তবে সায়েবরাই যে এই বস্তুটি প্রথম ব্যবহার করে, এমনটা নয়। ১৬৬৫-তে বার্নিয়ে যে ‘কাশ কান্য’-র কথা লিখেছিলেন, তা এক ধরনের খড়ের বাড়ি, যা আসলে সুগন্ধি শেকড়। সায়েবরা এই সুগন্ধি ঘাসের শেকড় দিয়ে তৈরি করা পর্দা গ্রীষ্মকালে জলে ভিজিয়ে টাঙিয়ে রাখত দরজায়। বাইরের বাতাস ঘরে এলে ঘরটা যেমন ঠান্ডা হত, তেমনি সুগন্ধে ভরে যেত ঘর।

কলকাতার গরমে সায়েব-মেমদের কিছুটা আরাম দিত টানা-পাখা। কলকাতায় ধনী-অভিজাত মহলে সাবেকি বড় বড় তালপাতার পাখার ব্যবহার থাকলেও সায়েবরা তা গ্রহণ করেনি। টানা-পাখার জন্ম কিন্তু এ দেশে নয়। বস্তুটি বিদেশি। শোনা যায়, এটি আবিষ্কার করেন খলিফা মনসুর (৭৫৩-৭৭৪ খ্রিস্টাব্দ), তবে সুলতানি বা মোগল যুগে এর উল্লেখ পাওয়া যায় না। বাংলায় টানা-পাখার প্রচলন ঘটান সম্ভবত আঠারো শতকের শেষ দিকে চুঁচুড়ার ওলন্দাজরা। কলকাতায় এই পাখার ব্যবহার ১৭৮০-র আগে হয়নি বলেই মনে হয়। কারণ হেস্টিংস ও ফিলিপ ফ্রান্সিসের সন্দেহ ছিল টানা-পাখার কার্যকারিতা নিয়ে।

ভারতে ইংরেজ কর্মচারীদের ঘন ঘন স্থান পরিবর্তন করতে হত কাজের সুবাদে। গ্রীষ্মে তাদের কাছে অপরিহার্য ছিল শোলার টুপি। বিলিতি টুপি এ দেশের গরমে উপযুক্ত ছিল না। যারা এক বার শোলার টুপি ব্যবহার করত, তারা বুঝতে পারত, এ টুপি গ্রীষ্মের প্রখর রোদে মাথা বাঁচানোর পক্ষে শ্রেষ্ঠ উপকরণ। যত দিন এর ব্যবহার সম্পর্কে সায়েবরা অনভিজ্ঞ ছিল, তারা নানা উপায়ে মাথাটা রক্ষা করত রোদের তাপ থেকে। ক্যাপ্টেন হার্ভে লিখেছেন, তিনি একটা খড়ের বিড়ে তৈরি করতেন প্রথমে। কপি অথবা কলাপাতা দিয়ে মাথা ঢেকে তার উপর চাপিয়ে দিতেন খড়ের বিড়েটা। যারা প্রথম বিলেত থেকে আসত, সঙ্গে আনত হেলমেটের মতো টুপি। কিন্তু ভারতের মাটিতে পা দিয়েই তারা এই মস্তকভূষণ ত্যাগ করে পরে নিত শোলার টুপি। অবশ্য, মহাবিদ্রোহের আগে এই টুপি চড়েনি সায়েবদের মাথায়।

গ্রীষ্মকালে ভারতে অনেক সায়েব কষ্ট পেত নিজেদের আঁটোসাঁটো পোশাক পরিহার করতে না পারার জন্য। শাসকের জাতি তারা, নেটিভদের মতো ঢিলেঢালা পোশাক পরলে তাদের ভাবমূর্তি মলিন হবে, এই ভ্রান্ত ধারণার শিকার হয়ে গ্রহণ করতে পারত না ভারতীয় পোশাক। সদ্য আগত মাদ্রাজের সায়েবদের চোখ ধাঁধানো পোশাক দেখে তাদের আগে ভারতে আসা বন্ধুবান্ধবরা ছুড়ে দিত বিরূপ মন্তব্য। লোকালয় থেকে দূরে অবস্থিত কুঠির সায়েবরাও অভ্যস্ত ছিল বিলিতি পোশাকে নিজেদের সাজিয়ে রাখতে। প্রচণ্ড গরমেও পরে থাকত ওয়েস্ট কোট ও ব্রিচেস। মাদ্রাজের এক জন আইনজীবীর ছিল একাশিটা ওয়েস্ট কোট।

অথচ খোদ গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের জীবন ছিল অনাড়ম্বর। রোজ ভোরে উঠতেন। স্নান করতেন ঠান্ডা জলে। বছরে দুটো সুটের অর্ডার করতেন এবং একটা ফ্রক-কোট। একেবারে সাদামাটা পোশাক পরে যখন পায়চারি করতেন বাগানে, নিজেকে মনে করতেন বড় সুখী মানুষ। অধিকাংশ সায়েবদের জীবনদর্শন ছিল, ‘খাও-দাও, ফুর্তি করো’। সেই জীবনদর্শন ভারতের মাটিতে ছিল অচল। হেস্টিংস সে পথ মাড়াননি বলে তিরিশটা বছর দিব্যি কাটিয়ে দিয়েছিলেন ভারতে। বেঁচেছিলেন পঁচাশি বছর।

১৮১০-এর দশক থেকেই সায়েবরা ভারতীয় পোশাকের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিল। উনিশ শতকের প্রথম দুই দশকেও কিছু বয়স্ক সায়েব গরমের কারণে দিনের বেলায় ভারতীয়দের মতো ঢিলেঢালা পোশাক পরে আরাম উপভোগ করতেন বারান্দায় বসে। কিন্তু সাহস করতেন না সেই পোশাক পরে বাইরে যেতে। অনেক সায়েব ঠেকে শিখেছিলেন গ্রীষ্মে নেটিভদের পোশাক পরতে। ভিক্টর জ্যাকুইমন্ট ১৮৩১-এর ১৪ মে বেশ বড়মুখ করে বলেছিলেন, “আমি ইউরোপীয় পোশাক ও ইউরোপীয় আদব-কায়দা ধরে রেখেছি, কারণ ওগুলো সমীহ আদায় করতে পারে।” কিন্তু মাত্র আড়াই মাস পরে, অগস্টের চার তারিখে বলতে বাধ্য হন, তিনি ইউরোপীয় পোশাক ত্যাগ করে পছন্দ করেছেন প্রাচ্যের পোশাক।

কৃষ্ণনগরে থাকার সময় স্যর উইলিয়াম জোন্স সুতির ঢিলেঢালা পোশাক পরতেন, বাঙালিদের মতো। থাকতেন কাঠ-খড় দিয়ে তৈরি একটা বাংলোয়। সাধারণ সায়েব-মেমরা এমন বাড়িতে থাকার কথা ভাবতেই পারত না। কলকাতার সায়েবদের বাড়িগুলো সুন্দর হলেও গ্রীষ্মপ্রধান দেশের উপযোগী ছিল না। বরং সে তুলনায় বোম্বাইয়ের বাংলোগুলি ছিল অনেক বেশি আরামদায়ক। বোম্বাইয়ে বিলেত থেকে সদ্য আগত এক মেমসায়েব তাঁর স্বামীর বাংলো দেখে প্রথমে হতাশ হয়েছিলেন। একতলা লম্বা একটা বাড়ি। খড়ের ছাউনি। মনে হয়েছিল ইংল্যান্ডের কোনও গোয়ালঘর। কিন্তু ভিতরে ঢুকে মুগ্ধ নাহয়ে পারেননি।

ভারতে গ্রীষ্মের তাপের প্রভাবে মেমসায়েবরা বদলাতে বাধ্য হন বিলিতি পোশাক। ভারতে আসার আগে গাইড-বুক পড়ে ভারতে আসার সময় ভিক্টোরীয় জবড়জং রেশম ও ভেলভেটের বদলে সঙ্গে নিতেন সুতি ও মসলিনের পোশাক। অবশ্য ভুলে যেতেন না নাচের জন্য বিশাল ও ভারী বল-গাউন সঙ্গে নিতে। কিন্তু ভারতে এসে গ্রীষ্মকালে সে পোশাক পড়ে থাকত অবহেলায়। গরমে অতিষ্ঠ হয়ে বাড়িতে পরে থাকতেন কেবল শেমিজ় ও পেটিকোট।

ভারতে আসার পর গ্রীষ্মকালেও তাদের বিভিন্ন কারণে যেতে হত এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায়। রেল চালু হওয়ার আগে ভ্রমণের জন্য চাপতে হত ঘোড়া অথবা ‘পনি’ টানা গাড়িতে। অনেক সময় যাত্রা বিঘ্নিত হত প্রচণ্ড দাবদাহে পশুগুলো আর গাড়ি টানতে না পারলে। রেল চালু হলেও খুব একটা সুরাহা হয়নি মেমসায়েবদের। গ্রীষ্মকালে রেল ভ্রমণের সময় তারা জলে ভেজানো রুমাল দিয়ে জড়িয়ে রাখত মাথাটা। রেল চলাকালীন গরম বাতাসে মৃত্যুর সম্ভাবনা ছিল যথেষ্ট। তাই রেল কর্তৃপক্ষ প্রত্যেক স্টেশনে মজুত রাখত কফিন। ভারতে আসার আগে মেমসায়েবরা এ দেশের ‘লু’-এর কথা শুনেছিলেন শুধু। এ দেশে পা দিয়ে উপলব্ধি করেন, তাঁরা যেন প্রবেশকরেছেন অগ্নিকুণ্ডে।

১৮৩৩-এর সেপ্টেম্বরে যে দিন কলকাতায় প্রথম বরফ আসে, সে দিনটা ছিল সায়েবদের কাছে একটা উৎসবের দিন। তবে সে বরফ বিলিতি ছিল না, ছিল আমেরিকান। বোস্টনবাসী মার্চেন্ট ফ্রেডরিক টিউডর ১৮৩৩-এর ১২ মে ‘টাস্কানি’ জাহাজে ভারতের জন্য রফতানি করেন ১৮০ টন বরফ। পথে অনেকটাই গলে যায়। জাহাজ আসে প্রথমে বোম্বাই বন্দরে। বন্দর কর্তৃপক্ষ রেহাই দেন আমদানি শুল্ক থেকে। কলকাতায় সায়েবদের যখন জানানো হয় চল্লিশ টন বরফ নিয়ে একটা জাহাজ এগিয়ে আসছে কলকাতার দিকে, উত্তেজনায় ভেসে গিয়েছিল কলকাতার সায়েব-মেমরা। ‘টাস্কানি’ জাহাজের ক্যাপ্টেন রোজারকে গভর্নর জেনারেল লর্ড বেন্টিঙ্ক সম্মানিত করেছিলেন একটা সুন্দর ফুলদানি উপহার দিয়ে।

ইংরেজরা তাদের রীতিনীতি সম্পর্কে এতটাই রক্ষণশীল ছিল যে, প্রচণ্ড গ্রীষ্মেও বদলাতে চাইত না সে সব রীতিনীতি, সেটা অস্বস্তির কারণ জেনেও। শীতের দেশের মানুষ যে হেতু, তাই নিয়মিত স্নানের অভ্যেস ছিল না অনেকেরই। এ দেশে এসেও বজায় রাখার চেষ্টা করতেন সেই অভ্যেস। শেষ পর্যন্ত ১৮০৬-এ মাদ্রাজের ইউরোপীয় হাসপাতালের সার্জেন নিয়মিত স্নানের উপকারিতা সম্পর্কে রিপোর্ট দাখিল করলে মাদ্রাজে সায়েবদের সমস্ত হাসপাতালে শাওয়ারের ব্যবস্থা করা হয়। ১৮৩০-এর মধ্যে দেখা যায়, সব বাংলোতে রয়েছে শোবার ঘর সংলগ্ন বাথরুম। ১৮৪৩-এ এক অজ্ঞাতনামা ‘গ্রিফিন’ (ভারতে নবাগত সায়েব) লিখেছিলেন, যে সব গরিব সায়েবদের সঙ্গতি ছিল না গ্রীষ্মকালে কোনও শৈলাবাসে যাওয়ার, তারা প্রচণ্ড গরমের হাত থেকে মুক্তি পেতে বাধ্য হয়ে মাঝরাতে স্নান করতঠান্ডা জলে।

তাপপ্রবাহ কেবল এ কালের দুশ্চিন্তার বিষয় নয়, সে কালেও তা কম মারাত্মক ছিল না। থিয়ন উইলকিনসন লিখেছেন, সানস্ট্রোক বা সর্দিগর্মিতে সায়েবদের মৃত্যুর ঘটনা খুব বিরল ছিল না। মাদ্রাজের গভর্নর লর্ড পিগট ১৭৭৭-এ মারা যান তাপপ্রবাহে। ১৮৫৭-তে কানপুরে স্যর জি পার্কার শিকার হন সর্দিগর্মির। সেনাদের প্যারেড করানো হত দুপুর নাগাদ। কিন্তু চড়া রোদে প্যারেড করালে বিপদের আশঙ্কায় প্যারেডের সময় পরিবর্তন করে সকালকে বেছে নেওয়া হয়। পুরনোপন্থী এক কর্নেল এই পরিবর্তন অনুমোদন না করে তাঁর রেজিমেন্টকে হুকুম করেন ভরদুপুরে প্যারেড করার। ১৮৫৫ সালের জুলাই মাসে এক জন সেনা তাঁর বাবাকে লিখেছিলেন, “বদ্ধ উন্মাদ কর্নেল আমাদের দুপুরের পরে প্যারেড করার অর্ডার দিয়েছেন। অথচ অন্যান্য রেজিমেন্টের প্যারেডের ব্যবস্থা হয়েছে সকালে।” গ্রীষ্মের সময় সেনা ও অফিসারদের অনেক ক্ষেত্রে অবিশ্বাস্য সহ্যশক্তির পরিচয় দিয়ে মার্চ করতে হত কয়েকশো মাইল। তার মাশুল দিতে হত অনেক সময়। এক জন কম্যান্ডিং অফিসার শোকে কাতর হয়েছিলেন, “অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয় যে, আমি ক্যাপ্টেন জেমস ক্রফোর্ডকে হারিয়েছি মাত্র দু’ঘণ্টার মধ্যে। তিনি আক্রান্ত হয়েছিলেন প্রচণ্ড জ্বরে।”

উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে অর্থবান, সম্ভ্রান্ত সায়েবরা গ্রীষ্মের হাত থেকে রক্ষা পেতে চলে যেতেন শিমলা, দার্জিলিং-এর মতো শৈলশহরে। ব্রিটিশ ভারতের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী হিসেবে শিমলা সেজে উঠেছিল বিলিতি কায়দায়। কারণ ইংরেজরা সমতলের গ্রীষ্মের সঙ্গে পেরে উঠতে পারেনি। শিমলাকে ইংরেজরা আদর করে নাম দিয়েছিল ‘ছোট বিলেত’। ১৮৬৪-তে শিমলা সরকারি ভাবে ব্রিটিশ ভারতের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী ঘোষিত হওয়ার পর কয়েক দশকের মধ্যে প্রায় পাঁচ হাজার ইংরেজ চলে যায় শিমলায়, কেবল গ্রীষ্মের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য।

গ্রীষ্মের কবল থেকে রক্ষা পাওয়াই কেবল সায়েবদের সমস্যা ছিল না। রামের দোসর সুগ্রীবের মতো গ্রীষ্মের দোসর ছিল শতেক রোগ। সায়েবদের তুলনায় মেমসায়েবরা সাধারণত এই সমস্যা থেকে কিছুটা মুক্ত ছিলেন। কারণ, সায়েবদের মতো তাঁদের প্রয়োজন হত না বাইরে রোদে-তাপে বেরোনোর। ফিলিপ ফ্রান্সিস এক চিঠিতে লিখেছিলেন, “পেটের গন্ডগোলে আমি বিপর্যস্ত। আমার ধারণা, আসল শয়তানটা হল এখানকার গরম।”

১৬৭৩-এ ভারতে আগত এক বিদেশি পর্যটক মন্তব্য করেছিলেন, ভারতে এক-একটা ঋতুকে শাসন করে এক-একটা রোগ, যেমন গ্রীষ্মকালে কলেরা। কলেরার কাছে সে কালের সায়েবরা ছিল অসহায়। তাদের সমাধিক্ষেত্রে গেলে প্রমাণ পাওয়া যায় এ কথার।

মেজর হেনরি ডিবিউডের পত্নীর সমাধিতে লেখা ছিল, “ভারতে ফিরে আসার দু’মাসের মধ্যে জেন অ্যানের মৃত্যু হয়েছিল ১৮৪১-এর ২৭ ফেব্রুয়ারি কলেরার আক্রমণে, মধ্যরাতের আগেই আচম্বিতে মৃত্যু ডেকে আনত কলেরা।” ১৮৫১-তে রওলিনস তাঁর বাবাকে লিখেছিলেন, “আমি সবেমাত্র ফিরছি কুমারী ফেডরিংটনকে সমাধিস্থ করে। বেচারা অসুস্থ ছিল মাত্র ছ’ঘণ্টা। বৃহস্পতিবারে সে বল-এ নেচেছিল আমার সঙ্গে। কী উচ্ছল, প্রাণবন্ত সে দিন দেখেছিলাম তাকে। আর এক দিন পরই শনিবারে সে চলে গেল কলেরায়। কী ভয়ঙ্কর অনিশ্চিত জীবন এই ভারতে।” বস্তুত, আঠারো এবং উনিশ শতকের প্রথমার্ধে ভারত ছিল সায়েব-মেমদের গোরস্থান।

আলেকজ়ান্ডার হ্যামিলটন, শ্রীমতী কিন্ডার্সলি প্রমুখ সকলেই আঠারো শতকে কলকাতায় সায়েবপাড়ায় ব্যাপক হারে অকালমৃত্যুর জন্য দায়ী করেছেন শহরের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও জলহাওয়াকে। উনিশ শতকেও মৃত্যু-মিছিল অব্যাহত ছিল। ১৮১৪ থেকে ১৮৩৩, এই কুড়ি বছরে পার্ক স্ট্রিটের গোরস্থানে গোর দেওয়া হয়েছিল ২৬৭৫ জন সায়েবকে। তাদের মধ্যে ১১৫২ জনের বয়স ছিল একুশ থেকে তিরিশের মধ্যে। তবে এই ব্যাপক হারে মৃত্যুর জন্য অনেকাংশে দায়ী ছিল সায়েবদের জীবন-যাপনের পদ্ধতি। ভারতের মতো গ্রীষ্মপ্রধান দেশে তারা খাদ্য ও পানীয় গ্রহণের ক্ষেত্রে ছিল চরম অসংযত। এ দেশের এই উৎকট গরমে তারা গোগ্রাসে প্রচুর পরিমাণে গোমাংস, ভেড়ার মাংস এবং শূকরের মাংস গ্রহণ করত। রাজস্থান এবং মধ্য ভারতে সায়েবরা ডিনারে খেত মাখনে মুরগি সেদ্ধ করে, তার মধ্যে মশলা, কিসমিস ও বাদাম পুরে আমের আচার দিয়ে। রবিবারে রান্না হত হরিণ, ময়ূর ও খরগোশের মাংস। পরিমাণে বিপুল। পান করত পারস্য থেকে আমদানি করা সিরাজ ও আরক। ফরাসি পর্যটক বার্নিয়ে খুব অবাক হয়েছিলেন ভারতের মতো গ্রীষ্মপ্রধান দেশে সায়েবদের খাবার ও আরক পানের বহর দেখে। প্রবল গ্রীষ্মে আরক-পান ছিল অত্যন্ত ক্ষতিকারক। এই বেহিসেবি ভোজন ও মদ্যপানের খেসারত হিসেবেও দিতে হত প্রাণ।

১৮০৫-এ লেখক হ্যাডলে দুটো ঘটনার উল্লেখ করেছেন। যেখানে দু’জনের মৃত্যু হয়েছিল প্রচণ্ড গরমে অতিরিক্ত পরিমাণ ভোজন ও পান করার পর।

কেউ মারা গেলে সাধারণত চেষ্টা করা হত শবদেহ রাতে গোরস্থানে নিয়ে যাওয়ার জন্য। দুটো কারণে— দিনের রোদের তাপ এড়ানো এবং শবযাত্রা মেমসায়েবদের দৃষ্টির আড়াল করা। বিশেষ করে গ্রীষ্মকালে সায়েব-মেমদের মৃত্যু এমনই নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছিল যে, কোনও মৃত্যুই আর তেমন আঘাত দিত না চেতনাকে। ১৮২৬-এর ২৭ জুলাই লেডি ওয়েস্ট বোম্বাইয়ে থাকার সময় লিখেছিলেন, “এখানে যে দিন কেউ মারা যায়, পরদিন তাকে সমাধিস্থ করা হয়। তৃতীয় দিনে বিক্রি করে দেওয়া হয় তার আসবাবপত্র। চতুর্থ দিনে সকলে ভুলে যায় তাকে।”

কলকাতার গ্রীষ্মে কাহিল হওয়ার অভিজ্ঞতা স্মরণ করে অ্যাটকিনসন কলকাতার এক অকল্পিত ছবি এঁকেছিলেন তাঁর কবিতায়— “কলকাতা! তুমি কেমন ছিলে তখন?/ প্রচণ্ড দাবদাহে দিবাভাগে দহনের আঁচ/ তারাখচিত রাতে উপচে পড়া আর্দ্রতা, বিছানায় অস্থিরতা;/ সন্ধের পর্যটকরা সকালে নিথর।”

আঠারো-উনিশ শতকে কলকাতা সায়েবদের দিয়েছে যেমন, নিয়েছেও তেমনই তাঁদের কাছ থেকে। কলকাতার এ নেওয়া বড় নির্মম। বড় মর্মান্তিক। গ্রীষ্মে কলকাতা ভয়ঙ্কর হয়ে মৃত্যুর থাবা বসিয়ছিল অনেক সায়েবের জীবনে। যারা মৃত্যুর সঙ্কেত পেয়ে স্বদেশে ফিরে গিয়েছিল তড়িঘড়ি, তারা অনেকেই মাটি নিয়েছিল সেখানে। ভারতে অদৃশ্য শত্রু গ্রীষ্মের কাছে হার মেনে ভারতকে তারা অভিশাপ দিয়েছিল কি না, সে কথা লেখা নেই ইতিহাসে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement