একুশশো বছর আগেকার প্রাচীন রোমের দার্শনিক এবং রাজনৈতিক তত্ত্ব বিশারদ মার্কাস টুলিয়াস সিসেরো-কে ল্যাটিন ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাগ্মী এবং প্রবন্ধ রচয়িতা হিসেবে মনে করা হয়। সিসেরো বেশ উৎসাহ নিয়ে বর্ণনা করেছেন মেলোসের ডায়াগোরাস-এর কথা। ডায়াগোরাস খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকের এক গ্রিক কবি এবং নৈয়ায়িক। তাঁর সময়কালে তাঁকে বলা হত ‘নাস্তিক’। এই নাস্তিককে আস্তিক করার চেষ্টাও হয়েছে। ঈশ্বরের মহিমা বোঝানোর উদ্দেশ্যে এক বার নাকি ডায়াগোরাস-কে সার-সার প্রস্তরখণ্ডের উপর আঁকা নাবিকদের ছবি দেখিয়ে বলা হয়, “এই নাবিকরা সামুদ্রিক ঝঞ্ঝার সময় প্রার্থনা করেছিলেন, এবং তার ফলে রক্ষা পেয়েছিলেন জাহাজডুবি থেকে।” উত্তরে ডায়াগোরাস জিজ্ঞেস করেন, “যাঁরা প্রার্থনা করা সত্ত্বেও জাহাজডুবিতে মারা যান, কোন প্রস্তরখণ্ডে তাঁদের ছবি আঁকা হয়েছে?”
এ নিবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে নাস্তিকতার প্রসঙ্গটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ডায়াগোরাসের চিন্তাপদ্ধতি। সিসেরোর দেওয়া বিবরণ অনুসারে, ডায়াগোরাস কিন্তু এই ঘটনার মাধ্যমে মানুষের যুক্তির এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার পদ্ধতির এক চিরায়ত দুর্বলতার দিকেই আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। আমরা যা চাক্ষুষ দেখি, প্রধানত তার উপরে ভিত্তি করেই গড়ে ওঠে আমাদের বিশ্বাসের নকল গড়। না-দেখা সত্যকে প্রায়ই পদ্ধতিগত ভাবে অগ্রাহ্য করে চলি আমরা। কখনও হয়তো বা খানিক অবচেতনেই, না বুঝে। সেই সঙ্গে এটাও ঠিক যে, সাফল্যের প্রতি আমাদের দুর্বার মোহ। সাফল্য যেন এক মরীচিকার মতো আমাদের ছুটিয়ে ফেরে। একেই বলে ‘সারভাইভারশিপ বায়াস’। অর্থাৎ যে টিকে গিয়েছে, বেঁচে গিয়েছে, জয়ী হয়ে ফিরেছে, তার দীপ্তির সম্মোহনে ছুটে চলা। মানুষ তাই শিখতে চায় জীবন-যুদ্ধে বিজয়ীর কাছ থেকে। না, এর মধ্যে অন্যায়ের কিছু নেই। কিন্তু ঘটনা হল, মানুষ প্রায়শই এর মাধ্যমে অবজ্ঞা করে চলে পরাজিতের হেরে যাওয়ার অভিজ্ঞতাকে, তার অমূল্য শিক্ষাকে। দুনিয়াটা আসলে জয়ীর চারণভূমি। বিজয়ীকে নিয়েই লেখা হয় মহাকাব্য। পরাজিতকে নিয়ে আলোচনা, পর্যালোচনা খুবই বিরল। সে কারণে জীবনের নানা ক্ষেত্রেই জয়ের সম্ভাবনাকে বেশি করে ভেবে ফেলি আমরা। এমনকি কতটা যে বেশি, তাও ঠিক বুঝে উঠতে পারি না।
রাস্তার হোর্ডিংয়ে কিংবা খবরের কাগজে বিভিন্ন কোচিং সেন্টারের বিজ্ঞাপনে অনেক সময়ই দেখা যায় তাদের কত জন ছাত্র কোন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সফল হয়েছে— বিশ, পঞ্চাশ, কিংবা একশো— তার সগৌরব ঘোষণা। কখনও বা এই সফল ছাত্রদের নাম কিংবা ছবি-সহযোগেও প্রচার চলে। আবার কখনও কোনও হাসপাতাল কিংবা ক্লিনিকের বিজ্ঞাপনেও দেখা যায়, কোনও জটিল চিকিৎসায় কত জন আরোগ্য পেয়েছেন সেই হাসপাতালে। বিজ্ঞাপনের যুগে শুধু সাফল্যের আলোটুকু প্রচার করায় দোষের কিছু নেই। সমস্যা হল, এ সব বিজ্ঞাপনে অনেক সময়ই থাকে না একটা অতি-গুরুত্বপূর্ণ তথ্য— তা হল, মোট কত জন ছাত্র ছিল সেই কোচিং সেন্টারে, বা মোট কত জনের উপর সেই জটিল চিকিৎসাটা করা হয়েছে সেই হাসপাতালে। ভেবে দেখলে বোঝা যাবে, এই তথ্য দেওয়া না থাকলে বিজ্ঞাপনটা অসম্পূর্ণ। একশো জন সাফল্য পেয়েছে তিনশো ছাত্রের মধ্যে না দশ হাজারের মধ্যে, সেই অতি-গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা বলা না থাকলে কোচিং সেন্টারের দক্ষতার যথার্থ ও নৈর্ব্যক্তিক মূল্যায়ন অসম্ভব। ফলে তৈরি হয় ‘সারভাইভারশিপ বায়াস’। যার মধ্য দিয়ে পদ্ধতিগত ভাবে আমরা উপেক্ষা করে চলি হেরে-যাওয়া মানুষদের, অর্থাৎ ওই কোচিং সেন্টারে পড়েও যাঁরা সফল হননি, তাদের ব্যর্থতার মধ্যে লুকিয়ে থাকা প্রয়োজনীয় তথ্য। আর অতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়ে ফেলি উদ্বর্তনের মধ্য দিয়ে জয়ীদের ইতিবৃত্তে। তৈরি হয় এক ধরনের ভ্রান্তিবিলাস। সফলদের লক্ষ করে এই চেরি সংগ্রহের কাজটা অনেক ক্ষেত্রেই অনিচ্ছাকৃত। তবে কিছু সময় যে ইচ্ছে করেই ভুল করা বা করানো হয় না, সে কথা হলফ করে বলা কঠিন।
‘সারভাইভারশিপ বায়াস’ এবং কী ভাবে সেই ভ্রান্তিকে পরিহার করে ব্যবহারিক জীবনে জাদুস্পর্শ আনা সম্ভব, তার একটা বড়সড় উদাহরণ রয়েছে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পটভূমিতে। গল্পটা বিখ্যাত রাশিবিজ্ঞানী এবং গণিতজ্ঞ আব্রাহাম ওয়াল্ডের প্রজ্ঞার পরিচায়ক। যুদ্ধের সময় অনেক যুদ্ধবিমানই গোলাগুলির আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ফিরে আসছিল। আবার ফিরছিলও না কিছু বিমান, গুলির আঘাতে ধ্বংসপ্রাপ্ত হচ্ছিল যেগুলো। প্রতিপক্ষের গুলি থেকে রক্ষা করতে মিলিটারি চাইছিল বিমানে ধাতুর এক অতিরিক্ত আস্তরণ দিতে, সোজা কথায় বিমানকে একটা বর্ম পরাতে। কিন্তু এই ধাতুর আস্তরণ বড্ড ভারী, পুরো বিমান জুড়ে এই বর্ম পরানো অসম্ভব। মিলিটারি তখন যে প্লেনগুলি আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে ফিরে এসেছে তাদের গায়ের গুলির গর্ত পরীক্ষা করে যে সব জায়গায় আঘাত তীব্রতম, সেখানে ধাতুর অতিরিক্ত আস্তরণ দিয়ে সুরক্ষা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিল। সেই সঙ্গে তারা নিউ ইয়র্কের কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে আব্রাহাম ওয়াল্ডের গবেষণা দলকে দায়িত্ব দিল, কী ভাবে যুদ্ধবিমানকে আরও বেশি সুরক্ষা দেওয়া যায় তার উপায় বাতলাতে। ওয়াল্ড কিন্তু বিষয়টার মধ্যে খুঁজে পেলেন ‘সারভাইভারশিপ বায়াস’-এর উপস্থিতি। কারণ, তিনি ঘটনাটাকে দেখলেন উল্টো দৃষ্টিভঙ্গিতে। তিনি ভেবে দেখলেন, যে যুদ্ধবিমানগুলো ফিরে এসেছে সেগুলো তো আঘাত পেয়েই ফিরেছে। এরা ‘সারভাইভার’ বা উদ্বর্তিত। তাই এখানে ‘না-পাওয়া’ তথ্য লুকিয়ে আছে যে বিমানগুলো গুলির আঘাত পেয়ে আর ফিরতে পারেনি, তাদের আঘাতের জায়গায়। তিনি আন্দাজ করলেন, সেই বিমানগুলোতে নির্ঘাত গুলি লেগেছে অন্য জায়গায়, ফিরে-আসা বিমানের আঘাতের জায়গায় নয়। আর সেই বিমানগুলো যে হেতু ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে, তাদের আঘাতের সেই জায়গাগুলো নির্ঘাত বেশি নড়বড়ে, বেশি দুর্বল। তাই মিলিটারির উচিত বিমানের সেই অংশগুলিকে পোক্ত করা, সুরক্ষা জোগানো। ধাতুর বর্ম পরানো উচিত সেখানেই। কারণ, সেটাই অ্যাকিলিসের গোড়ালি, বিমানের দুর্বলতার জায়গা। আব্রাহাম ওয়াল্ডের এই ব্যতিক্রমী বিশ্লেষণের ফলশ্রুতিতে জোরদার করা হল বিমানের ইঞ্জিন এবং অন্যান্য দুর্বলতম জায়গাগুলো। এবং, ঘটনা হল, এর ফলে অনেকটাই বেড়ে গেল বিমান এবং বিমান-কর্মীদের নিরাপত্তা, বেঁচে গেল প্রচুর জীবন। তাই ‘সারভাইভারশিপ বায়াস’-এর চরিত্র বুঝতে পারলে পাল্টে যেতে পারে আমাদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। তবে এটাও ঠিক, লুকিয়ে-থাকা এই সব তথ্য সর্বক্ষেত্রে গর্ত থেকে টেনে বার করে আনা সহজ নয়। এ যুগের অন্যতম বিশিষ্ট চিন্তাবিদ নাসিম নিকোলাস তালেব তাঁর বেস্টসেলার বই
‘দ্য ব্ল্যাক সোয়ান’-এ এ ধরনের লুকিয়ে-থাকা তথ্যকে ‘সাইলেন্ট এভিডেন্স’, অর্থাৎ ‘নীরব প্রমাণ’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।
আসলে আমাদের জীবনের বহু প্রকাশভঙ্গিকেই ভুল দিশায় প্ররোচিত করে চলেছে এই ‘সারভাইভারশিপ বায়াস’। আমরা বাড়ি থেকে পালানো কিছু তরুণের গল্প শুনি, যাঁরা পরবর্তী কালে হয়ে উঠেছেন সফল বলিউড বা হলিউড অভিনেতা। আমরা মোহিত হই, ভাবি এ বুঝি সত্যিই ‘তেরি মেরি কহানি’। কিন্তু কত তরুণ যে অভিনেতা কিংবা গায়ক হওয়ার তীব্র তাড়নায় সব ছেড়ে মুম্বই গিয়েও কিছুই করে উঠতে পারেননি জীবনে, সে তথ্য আমাদের কাছে থাকে না। সম্ভবত আমরা খুব একটা আগ্রহীও নই সে হিসাব-নিকাশে। তথ্যটুকু থাকলে হয়তো দেখা যেত যে, তথাকথিত সফলেরা বিরলের মধ্যে বিরলতম। কোনও এক ফুচকা-বিক্রেতাকে ক্রিকেট তারকা হয়ে উঠতে দেখে আমরা উদ্বেলিত হই, ভাবি এ নিশ্চয়ই খুবই সহজসাধ্য। বুঝতে পারি না, একই সমতলে দাঁড়িয়ে-থাকা অন্য শত-সহস্র জনের কাছে জীবন এমন করে সোনার কাঠির ছোঁয়া নিয়ে হাজির হবে না। আমরা বুঝতেও কি চাই? ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমী কিংবা হগওয়ার্টসের ম্যাজিকের গল্পে আমাদের যে সহজাত আকর্ষণ।
রেকর্ড কোম্পানির দরজায় দরজায় ঘুরছিল চার জন তরুণ গিটারবাদক। এবং প্রত্যাখ্যাত হচ্ছিল বার বার। তাঁদের এমনও বলা হয়েছিল যে, গিটারের দলগুলোই ক্রমে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। এই চার তরুণই কিন্তু ভবিষ্যতে হয়ে উঠবেন দুনিয়ার ‘সেনশেসন’। ‘দ্য বিটলস’ পরিগণিত হবে দুনিয়ার সর্বকালের সফলতম ব্যান্ড হিসাবে। এই সব ম্যাজিক-গল্প আমাদের আকর্ষণ করতেই থাকবে। আমরা মনে রাখব না, কিংবা মনে রাখতে চাইব না, বা আমরা কখনওই ঠিকঠাক হিসাব পাব না যে, কত সহস্র ব্যান্ড সাফল্যের লেশমাত্র দেখতে ব্যর্থ হয়েছে। আমরা বার বার বলতে থাকব বিল গেটস, স্টিভ জোবস কিংবা মার্ক জ়াকারবার্গের মতো উদ্যোগপতি এবং অতি-ধনীদের কথা, যাঁরা কলেজ-ড্রপআউট, অর্থাৎ ডিগ্রি না পেয়েই মাঝপথে কলেজ ছেড়েছেন। কিন্তু তার অর্থ কি এটাই যে, কলেজ ডিগ্রির কোনও মূল্য নেই জীবনে? কলেজ ড্রপ-আউট কিংবা টুয়েলভ ফেল হলেই আমাদের জীবনে খুলে যাবে অনন্ত সম্ভাবনার সিংহদ্বার? কত কলেজ-ড্রপআউট যে জীবনে অর্থপূর্ণ কিছুই অর্জন করতে পারেননি তার হিসাব কে রাখবে? সঠিক হিসাব থাকলে দেখা যেত গেটস-জোবস-জ়াকারবার্গরা এক অতি-ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভগ্নাংশ। প্রতিটি জ়াকারবার্গের আড়ালে খুঁজে পাওয়া সম্ভব হাজার-হাজার উদ্যোগপতিকে, যাঁরা দু’চোখে স্বপ্ন নিয়ে খুলেছিলেন তাঁদের সাধের স্টার্টআপ, কিন্তু তাঁদের আসরে কেউ যোগ দেয়নি। তাঁরা যে ছিলেন, সে খবরও কেউ রাখে না।
৬৫ বছর বয়সে এক দাড়িওয়ালা মার্কিন ভদ্রলোক হাতে পান জীবনের প্রথম সোশ্যাল সিকিয়োরিটির চেক, ৯৯ ডলারের। সেটাকেই মূলধন করে খুলে ফেললেন মুরগির মাংস-ভাজা বিক্রির ব্যবসা। সময়ের পথ বেয়ে আজ যার ব্র্যান্ড ভ্যালু ছয় বিলিয়ন ডলারের বেশি। দুনিয়ার ১৪৭টা দেশে উপস্থিতি। আমরা বিলক্ষণ জানি, যে কেউ একটা তেলেভাজার দোকান শুরু করলেই তা ফুলে-ফেঁপে কেন্টাকি ফ্রায়েড চিকেন বা ‘কেএফসি’ হয়ে উঠবে না, ৬৫ বছর বয়সে শুরু করে তো দূরের কথা। তবু ওই যে, রূপকথা আমাদের ভারী পছন্দের। কারণ, সেখানে পছন্দের রাজপুত্রটি দৈত্যকে মেরে উদ্ধার করবে রাজকন্যাকে, জয় হবে রাজপুত্তুরের। বিজয়ীর গল্পেই তো আমাদের আকর্ষণ, আমাদের চোখের চিরকালীন মায়াকাজল।
বাস্তবে বেশির ভাগ স্টার্টআপই ব্যর্থ হয়। অধিকাংশ মানুষই জীবনে সফল হন না, বিখ্যাত হন না, ধনী হন না। তবে তার অর্থ এই নয় যে, মানুষ সফল হওয়ার চেষ্টাটুকুও করবে না। চেষ্টা অবশ্যই করবে, কিন্তু বাস্তব সম্পর্কে সম্যক ধারণা রেখে সাফল্যের সম্ভাবনা যথাযথ অনুমান করেই চেষ্টাটা করা উচিত। কারণ, ওই যে, দুনিয়া জুড়ে সাফল্যের সম্ভাবনাকে অনেক ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে অনুমান করার প্রবণতা। অধিকাংশ মানুষই মনে করেন, সাফল্যই সব কথা বলে। তা যে নয়, ব্যর্থতার গল্পের মধ্যে যে শিক্ষা লুকিয়ে থাকে তা যে সাফল্যকে ছোঁয়ার জন্যও কার্যকরী ও সহায়ক হতে পারে, সে ধারণা আমাদের থাকে না প্রায়ই।
‘সারভাইভারশিপ বায়াস’ আসতে পারে নানা ভাবে। যেমন, কোনও একটা সমীক্ষা হল, কিছু দিন পরে আবার হয়তো সমীক্ষাটা করা হল কোনও বিষয়ের অনুপাত পরিবর্তিত হয়েছে কি না দেখার জন্য। কিন্তু দুটি সার্ভেতে যদি সমীক্ষাভুক্ত মানুষজন মোটামুটি একই ধরনের জনগোষ্ঠী থেকে না আসেন, ফলাফল তুলনীয় হতে পারে না। সাম্প্রতিক একটা উদাহরণ নেওয়া যাক। কোভিড অতিমারির একেবারে প্রথম লগ্নে ২০২০-র এপ্রিলে ব্রিটেনে একটা সমীক্ষা হয়, গৃহবন্দি থাকার ফলে জনগণের মধ্যে উদ্বেগ ও অবসাদ কী ভাবে কাজ করছে তা বুঝতে। পরবর্তী মাসগুলোয় আবার করা হয় সমীক্ষাটা। দেখা যায়, অতিমারি দীর্ঘায়িত হতে থাকলেও ব্রিটিশ জনতার উদ্বেগ আর অবসাদ কমছে। কিন্তু সত্যিই কি তাই? সমীক্ষাগুলি খুঁটিয়ে দেখলেন গবেষকরা। দেখা গেল, প্রথম সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের ৪০ শতাংশই পরবর্তী সমীক্ষাগুলিতে আর অংশ নেননি। বিশেষত, প্রথম সমীক্ষায় যাঁদের উদ্বেগ-অবসাদ দেখা গিয়েছিল তাঁরা পরের সমীক্ষায় অংশ নিতে বিশেষ আগ্রহী ছিলেন না। পরের সমীক্ষাভুক্তরা মোটামুটি তাঁরাই, প্রথম সমীক্ষায় যাঁদের উদ্বেগ-অবসাদ ছিল না। এও কিন্তু এক ধরনের ‘সারভাইভারশিপ বায়াস’, যার ফলশ্রুতিতে সময়ানুক্রমিক সমীক্ষায় ক্রমেই ‘সারভাইভার’রা— অর্থাৎ প্রথমে যাঁদের উদ্বেগ-অবসাদ ছিল না— অংশ নিতে থাকেন। আর সমীক্ষালব্ধ ফল আমাদের চালিত করে ভুল পথে।
‘সারভাইভারশিপ বায়াস’ আসতে পারে জীবনের নানা দিশায়, বিভিন্ন পথ ধরে। এ সবের শিকড়ের অনুসন্ধান সহজ নয়। তা হলে জীবনযাত্রার বিভিন্ন উপাদানকে ‘সারভাইভারশিপ বায়াস’মুক্ত করার উপায় কি সত্যিই আছে? যদি থাকে, তা হলে কী সেই উপায়? বোঝাই যাচ্ছে, নিরাসক্ত ভাবে আমাদের সাফল্য এবং ব্যর্থতা উভয়ের তথ্যই সংগ্রহ করা উচিত, নির্ভুল অনুপাতে। কিন্তু সে বড় শক্ত কাজ। দুনিয়া জয়ীকে বরমাল্য পরায় বটে, কিন্তু ব্যর্থতা নিয়ে বড্ড নিরাসক্ত। তাই সঠিক অনুপাতে ‘নীরব প্রমাণ’ সংগ্রহ করা বড় সহজ কাজ নয়। তবু, জীবনযাত্রার যে কোনও বিষয়ের ঠিক সম্ভাবনার অনুমান করতে এই ‘নীরব প্রমাণ’ই সেরা হাতিয়ার। এর জন্য প্রয়োজন ডায়াগোরাসের মানসিকতা, যা আমাদের প্রশ্ন করতে শেখায়। আর দরকার আব্রাহাম ওয়াল্ডের মতো বিজ্ঞানীর প্রজ্ঞা, যা বিজয়ীর আপাত-প্রকাশ্য তথ্যের হৃদয় নিংড়ে বার করে আনতে পারে লুকিয়ে-থাকা পরাজিতের ত্রুটি-বিচ্যুতির খতিয়ান। সে অবশ্য অনেক উঁচু দরের মনীষার কাজ।
আমরা যদিও সাফল্য নামক মরীচিকার পিছনে ছুটে ফিরি, আর ক্লান্ত হতে থাকি। দিনরাত।